রমজানে স্বাস্থ্যকর খাবার
প্রকাশিত : ২৩:৪৩, ১৪ মে ২০১৮ | আপডেট: ১৪:০৮, ১৭ মে ২০১৮
আমাদের দেশে রমজান মাস এলেই খাওয়া দাওয়ার ধুম পড়ে যায়। মানুষ অস্থির হয়ে পড়ে কি খাবে, কি খাবেনা এসব নিয়ে। আসলে সারা পৃথিবীতে মুসলমানরা ইসলামের বিধান অনুযায়ী একই নিয়মে রোজা পালন করেন। বিভিন্ন দেশের মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাত্রা এবং বিভিন্ন রকম খাওয়া দাওয়ার অভ্যাস রয়েছে। তাই স্থান কাল-পাত্র ভেদে বিভিন্ন রকম খাওয়া-দাওয়ারও তারতম্য রয়েছে। আমাদের দেশের মানুষের যে ধরনের খাদ্যাভ্যাস রয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা করব।
রোজা পালনের জন্য প্রয়োজন সঠিক ডায়েট নির্বাচন, শারীরিক সুস্থতা, মানসিক শক্তি এবং অদম্য ইচ্ছা ও আনুগত্য। আর চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদদের মতে, কিছু নিয়ম নীতি ও পরামর্শ অনুসরণ করলে, কষ্ট ছাড়াই রোজা পালন করা যায়।
রোজায় প্রতিদিনের খাবারের মেন্যুতে আসে ভিন্নতা, তার সঙ্গে সময়ের ব্যবধানতো রয়েছেই। আপাত দৃষ্টিতে আমাদের অনেকেরই মনে হতে পারে যে, রোজায় ১৪/১৫ ঘণ্টা না খেয়ে থেকে স্বাস্থ্যহানি ঘটতে পারে। তাই ইফতারে বেশি বেশি খাওয়া ভালো। রোজায় খাবারের বিরতি কম হওয়ায় প্রয়োজনের তুলনায় বেশি খাওয়া হয়ে যায়। আবার অনেকেই বলেন, রোজায় খাবারের হিসাব নেই। তাই রোজায় রকমারি খাবারের আয়োজন বেড়ে যায়, যা কিনা স্বাস্থ্য উপযোগী নয়। তবে দৈনিক চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রেখেই খাদ্য নির্বাচন করা দরকার।
ইফতারিতে কি কি খাবেন ?
রমজান মাস এলে বিকাল বেলা থেকেই ইফতারের জন্য নানা খাবার তৈরি ও বিক্রির হিড়িক পড়ে। হরেক রকম ইফতারির পসরা সাজিয়ে দোকানিরা রাস্তার ধারে, ফুটপাতে, অলিতে-গলিতে, হাটে-বাজারে সাজিয়ে রাখে। এসব ইফতারির মধ্যে রয়েছে ছোলা, মুড়ি, পেঁয়াজু, বেগুনি, ডালবড়া, সবজি বরা, আলুর চপ, খোলা খেজুর, হালিম, জালি কাবাব, জিলাপি, বুন্দিয়া ইত্যাদি। আরও রয়েছে বিভিন্ন ফল ও ফলের রস, আখের গুড়ের শরবত, নানা রং মিশ্রিত বাহারি শরবত। তাছাড়া মুখরোচক বিরিয়ানি ও তেহারিতো আছেই।
প্রশ্ন হলো এসব মুখরোচক খাবার স্বাস্থ্য সম্মত উপায়ে তৈরি করা হয়েছে কিনা। ভেজাল তেল, বেসন ও কৃত্রিম রং মেশানো হয়েছে কিনা, সেদিকে নজর দেয়া উচিত। যে তেলে ভাজা হয়, সেই তেল এক বারের বেশি ব্যবহার উচিত নয়। কারণ একই তেল বারবার আগুনে ফুটালে কয়েক ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য তৈরি হয়, যেমন পলি নিউক্লিয়ার হাইড্রোকার্বন, যার মধ্যে বেনজা পাইরিন নামক ক্যান্সার হতে পারে এমন পদার্থের মাত্রা বেশি থাকে। তা ছাড়া অপরিষ্কারভাবে ইফতারি তৈরি করলে পেটের পীড়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সুস্থভাবে বাঁচার জন্য যত্রতত্র খোলা খাবার না খাওয়াই উচিত। খুব কম ফলই পাওয়া যাবে, যা ভেজাল মুক্ত। শরবতের কথাতো বলাই বাহুল্য। রাস্তা ঘাটে, হাটে বাজারে রকমারি শরবত তৈরি করা হয়। আমাদের জানতে হবে, এসব শরবত যে পানি দিয়ে বানানো হয়, সে পানি বিশুদ্ধ কি না। তাছাড়া ইফতারের জন্য তৈরি প্রায় সব খাবার তেলও উচ্চ চর্বিযুক্ত। সাধারণত এসব খাবার মান সম্মত তেলে এবং সঠিক নিয়মে ভাজা হয় না, তাই এসব স্বাস্থ্য সম্মত নয়।
একজন রোজাদার ইফতারে কি খাবেন তা নির্ভর করবে তার স্বাস্থ্যের অবস্থা ও বয়সের উপর। পারত পক্ষে দোকানের তৈরি ইফতারি ও সেহেরী না খাওয়াই ভালো। সুস্থ, স্বাস্থ্যবান রোজাদারের জন্য ইফতারিতে খেজুর বা খুরমা, ঘরের তৈরি বিশুদ্ধ শরবত, কচি শসা, পেঁয়াজু, বুট, ফরমালিন অথবা ক্যালসিয়াম কার্বাইড মুক্ত মৌসুমি ফল থাকা ভালো। কারণ ফলে ভিটামিন ও মিনারেল পাওয়া যায়। ফল খেলে কোষ্ঠ কাঠিন্য দূর হয় এবং সহজে তা হজম হয়। রুচি অনুযায়ী বাসার রান্না করা নুডুলসও খেতে পারেন। বেশি ভাজি ভুনা তেহারি, হালিম না খাওয়াই ভালো। কারণ এতে বদহজম হতে পারে। রুচি পরিবর্তনের জন্য দু-একটা জিলাপি খেতে পারেন। তাছাড়া গ্রীষ্মকালীন রমজানে পরিমাণ মতো বিশুদ্ধ পানি পান করা উচিত। এশা ও তারাবির নামাজের পর অভ্যাস অনুযায়ী পরিমাণ মত ভাত, মাছ অথবা মুরগির মাংস, ডাল ও সবজি খাবেন।
কি খাবেন সেহেরিতে:
রমজানে স্বাভাবিক নিয়ম পরিবর্তন করে সুবহে সাদিকের আগে ঘুম থেকে উঠে খাওয়া দাওয়া সেরে নিতে হয়। সকালের নাস্তার পরিবর্তে খুব ভোরে সারাদিনের উপবাসের সময় চলার মতো খাওয়ার প্রয়োজন হয়। শরীরটাকে সুস্থ রাখার জন্য সেহেরি খাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখতে হবে, সেহেরীর খাবার মুখরোচক, সহজ পাচ্য ও স্বাস্থ্য সম্মত হওয়া প্রয়োজন। অধিক তেল, অধিক ঝাল, অধিক চর্বি জাতীয় খাবার খাওয়া একদম উচিত নয়। ভাতের সঙ্গে মিশ্র সবজি, মাছ অথবা মাংস খাবেন। অনেকেই মনে করেন যেহেতু সারাদিন না খেয়ে থাকতে হবে, তাই সেহেরীর সময় প্রয়োজনের অতিরিক্ত বেশি বেশি খাবার খেতে হবে। তা মোটেই ঠিক নয়, কারণ চার পাঁচ ঘণ্টা পার হলেই খাদ্যগুলো পাকস্থলী থেকে অন্ত্রে গিয়ে হজম হয়ে যায়। তাই প্রয়োজনর তুলনায় বেশি না খাওয়াই ভালো, বরং মাত্রাতিরিক্ত খেলে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি।
পিপাসা নিবারণ হয়, সেই পরিমাণ পানি নিজের অভ্যাস অনুযায়ী পান করতে হবে। দীর্ঘ সময় অভুক্ত থাকার কারণে শরীরে পানি শূন্যতা দেখা দিতে পারে এবং পানি শূন্যতার কারণে শরীরে নানা জটিলতা দেখা দেয়। তাই ইফতার থেকে সেহেরি পর্যন্ত পর্যায় ক্রমে অন্তত: দেড় থেকে দুই লিটার পানি পান করবেন। অনেকে পানির পরিবর্তে লেমন অথবা রোজ ওয়াটার, ফ্রুট ওয়াটার, নানা ধরনের শরবত, ভিটামিন ওয়াটার সহ নানা ধরনের প্রক্রিয়াজাত পানীয় পান করেন। এ ব্যাপারে বৈরুতের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউট্রিশনিস্ট ফারা নাজার এর অভিমত: রোজাদারদের শুধু বিশুদ্ধ পানি পান করাই ভালো। তার মতে, কার্বোনেটেড ও সুগার ড্রিংক, চা ও কফি পান করলে শরীর থেকে অধিক পানি বের হয়ে যায়। তাই কার্বোনেটেড, বেভারেজ ও সুগার ড্রিংক বা নানা ধরনের শরবত পরিহার করা উচিত। এছাড়া কফি ও চায়ের ডাই ইউরেটিক ইফেক্ট-এর কারণে ইফতার ও সেহেরিতে চা কফি পরিহার করা কম পান করা ভালো। রোজাদারদের প্রচুর সবুজ শাকসবজি, ফলমূল আহার করা উচিত।
রমজান মাসে রোজা রাখার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি সহজেই তার স্বাস্থ্যের উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটাতে পারে, যদি ঠিক ডায়েট অনুসরণ করা হয়।
কখনোই শুধু পানি খেয়ে রোজা রাখবেন না। অতিভোজন থেকেও বিরত থাকুন। খাবার ভালো ভাবে চিবিয়ে ধীরে ধীরে খান, যা আপনার হজমে সহায়ক হবে।
ইফতার ও সেহেরি সময়ের মধ্যে অন্তত পক্ষে আট গ্লাস পানি পান করুন। গ্লাস গুনে পানি খেতে অসুবিধা হলে, সম পরিমাণ পানি বোতলে ভরে রাখুন এবং ইফতার থেকে সেহেরি সময়ের মধ্যে তার পুরোটা পান করুন। এনার্জি ড্রিংক, কার্বনেটেড ড্রিংক এবং সোডা জাতীয় পানীয়গুলো বর্জন করুন। এগুলো গ্যাস্ট্রিক এসিডিটি বাড়িয়ে দেয়।
- ইফতারে বেশি ক্যালরি সমৃদ্ধ এবং সহজে ও তাড়াতাড়ি হজম হয় এমন খাদ্য গ্রহণ করুন। সেহেরীতেও সহজ পাচ্য খাবার খান।
- ভাজা পোড়া ও অতিরিক্ত মসলা যুক্ত খাদ্য বুক জ্বালা পোড়া এবং বদহজমের সমস্যা তৈরি করে। তাই এগুলো বর্জন করুন।
- রান্নার সময় মুরগি ও হাঁসের ডালডা পরিবর্তে সয়াবিন তেল ব্যবহার করুন, তবে যতটা সম্ভব পরিমাণ কম করে ব্যবহার করুন।
- অতিরিক্ত লবণ ও লবণাক্ত খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন। কারণ এসব রোজার সময় পানির পিপাসা বৃদ্ধি করে।
- যাদের চা, কফি, সিগারেট, মদ প্রভৃতি বাজে আসক্তি আছে তাঁরা এগুলোকে মিয়ে আনতে চেষ্টা করুন। হঠাৎ এগুলো ছেড়ে দিলে মাথা ব্যথা, রোষ প্রবণতা, মেজাজ খিটখিটে হওয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পাবে।
- ঘুমানোর আগে ও সেহেরীর পরে অবশ্যই দাঁত ব্রাশ করতে ভুলবেন না। রোজা রাখা অবস্থায় সকালে ব্যায়াম না করে ইফতারের পর ব্যায়াম করা উচিত।
- খাওয়ার আগে অবশ্যই হাত ধুতে ভুলবেন না। এই সময়ে হাঁচি, কাশির মতো ছোঁয়াচে রোগ বেশি দেখা যায়, তাই যারা এতে আক্রান্ত, তাদের কাছ থেকে সাবধান থাকা উচিত।
- দিনে গরম সময়ে ঠাণ্ডা ও ছায়াযুক্ত স্থানে থাকা উচিত সম্ভব হলে শারীরিক পরিশ্রম কম করুন।
- দৈনিক কাজ কর্ম এমন ভাবে ঠিক করুন,যেন বেশ ভালো ভাবে ঘুমানো যায়।
ডিন, মেডিসিন অনুষদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
টিকে