ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪

রাইড শেয়ারিং: রাইডার ও ব্যবহারকারীরা কী সমস্যা দেখেন

মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

প্রকাশিত : ২১:০৮, ১৩ মে ২০১৯ | আপডেট: ১৮:০৯, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৯

বর্তমানে একুশে টেলিভিশন’র নিজস্ব প্রতিবেদক। তিনি দৈনিক ইত্তেফাক, ডেইলি নিউএইজ, এনটিভি’র কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক ছিলেন ও বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি’র নেতৃত্ব দিয়েছেন। একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৭’তে প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘আসমত আলীর অনশন’ প্রকাশিত হয়। তার বহু গবেষণা প্রবন্ধ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থাপিত হয়েছে।

বর্তমানে রাইড শেয়ারিং একটি প্রযুক্তি নির্ভর স্বচ্ছ পরিবহনের মাধ্যম হয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে যোগ করেছে ভিন্ন মাত্রা। ব্যস্ততম শহরে কিছুটা স্বস্তি ও নির্ভরতা বয়ে এনেছে এ রাইড শেয়ারিং। তবে নানা সমস্যার সঙ্গে কিছু অপূর্ণতা রয়েছে। রাইডার যেমন এটি ব্যবহারে কিছু সমস্যা দেখেন আবার রাইড ব্যবহারকারীও দেখেন নানা সমস্যা। তাদের মতে, এসব সমস্যা সমাধা করা না গেলে অচিরেই রাইড শেয়ারিং তার স্বকীয়তা হারাবে।

রাইডাররা মনে করছেন, তারা তাদের প্রাপ্য মজুরি বা সঠিক ভাড়াটি পাচ্ছেন না। রাইড ব্যবহারকারীদেরকেই বেশি সুবিধা দেয় অ্যাপস প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে ব্যবহারকারীরা মনে করছেন রাইডাররা তাদেরকে ঠকাচ্ছেন নাানভাবে।

গত কয়েকদিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে রাইডার ও ব্যবহারকারীদের সঙ্গে কথা বললে তারা একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে অনেক সমস্যার কথা জানান।

মাসুদ রানা যিনি ঢাকার রাস্তায় প্রায় দেড় বছর ধরে পাঠাও ও উবার অ্যাপসের মাধ্যমে এ মটোরবাইক চালিয়ে আসছেন। রাজধানীর বনানী এলাকায় তার সঙ্গে কথা হলে তিনি কিছু সমস্যা তুলে ধরে বলেন, প্রথমে আমাদের যেসব সুবিধা দেওয়া হতো এখন সে সকল সুবিধা দেওয়া হয় না। এখন অ্যাপস প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে রাইডের টার্গেট বেশি দেওয়া যা পূরণ করা সম্ভব হয় না এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে তাদের যে বোনাস দেওয়ার কথা ছিল তা দেওয়া হয় না। শুরুতে ওয়েটিং চার্জ থাকলেও এখন তেমন একটা নেই। পাঠাও প্রতিদিন ১৬ রাইডের টার্গেট দেয় বলে জানান রাইডার মাসুদ। সপ্তাহে ৪০ টি রাইড দিলে ৩০০টাকা, ৬০ টিতে ৫০০ টাকা, ৮০ টিতে ২৪০০টাকা এবং ১০৫ টিতে ৩৬০০ টাকা দেয় অ্যাপস প্রতিষ্ঠান উবার। তবে এই টার্গেট রাইডারের জন্য সহজ নয়। অ্যাপসের মাধ্যমে ভাড়া কম বলেও জানান এ রাইডার।

রাজধানীর কাওরান বাজারে কথা হয় সহজের বাইক রাইডার সুমনের সাথে। তিনি জানান, প্রকৃত ভাড়ার চয়ে জিপিএস’র ভাড়া কম আসে। জিপিএস গুগলের মাধ্যমে সরল রাস্তার ম্যাপ অনুযায়ী ভাড়া দেখায় কিন্তু ঐ গন্তব্যে পৌঁছতে অনেক ঘুরতে হয়। প্রতি রাইড থেকে তিনি ১৪ শতাংশ কমিশন দেন সহজ প্রতিষ্ঠানকে। এখানে তিনি আবার ওয়েটিং চার্জও পান না।

পাঠাও রাইড শেয়ারিং এ মটোরবাইক চালান জসিম উদ্দিন। খণ্ডকালীনভাবে তিনি রাইড শেয়ারিং এ বাইক চালান। রাজধানীর প্যান প্যাসেফিক সোনারগাঁও হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ সময় কথা বলেন জসিম। তিনি বলেন, ‘রাইড শেয়ারিং বেশি করে কাস্টমার ওরিয়েন্টড। এখানে ভাড়া কম।’

পাঠাওকে প্রতি রাইডে ২০ শতাংশ কমিশন দেওয়া জসিম মনে করেন, অ্যাপস প্রতিষ্ঠান বেশি কমিশন নেয়। অ্যাপসের সমস্যার কারনে মাঝে মধ্যে ভাড়ায় গরমিল দেখা যায়। এক দিন তিনি গুলশান থেকে বাংলামোটরে আসার আগে দেখেন ভাড়া ১৪০ টাকা তবে ব্যবহারকারীকে নামিয়ে দেওয়ার পর অ্যাপস তাকে ২২টাকা ভাড়া দেখায়। এখানে ঐ ব্যবহারকারী প্রকৃত সমস্যা বুঝে আমাকে পূর্বে দেখানো ভাড়াই দিয়েছিলেন। এক সময় যে চাকচিক্য বা স্বচ্ছলতা এই রাইড শেয়ারিং অ্যাপসে দেখা গেলেও সেই অবস্থা এখন আর নেই। এখন তেমন লাভ না হওয়ায় রাইডাররা ফিরে যাচ্ছেন। তবে ভাড়ার বিষয়টি নতুন করে ভাবা দরকার।

অনেক রাইডার অ্যাপস ব্যবহার না করে চুক্তিতে রাইড শেয়ারিং করেন। চুক্তিতে যাওয়ার বিষয়ে রাইডাররা জানান, অ্যাপসের মাধ্যমে ভাড়া কম আসে বিধায় অনেকে সরাসরি চুক্তিতে যান। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে সহজ’র এক রাইডারের সঙ্গে কথা বলার সময়ে এক যাত্রীকে পেয়ে তিনি চুক্তিতে চলে যান। অ্যাপসে না গিয়ে কেন চুক্তিতে যাচ্ছেন জানতে চাইলে রাইডার কিছু না বলে মুখে হাসি ছড়ান। চুক্তিতে যেতে ইচ্ছুক ওই যাত্রী রাজিবকে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘হঠাৎ করে অ্যাপসে সমস্যা দেখা দিয়েছে অথচ আমাকে জরুরি ভিত্তিতে গুলশান যেতে হবে।’

এমন চুক্তিতে যাওয়া কতটুকু নিরাপদ জিজ্ঞাসা করলে কোন উত্তর না দিয়েই তিনি চলে যান রাইডারের সঙ্গে। নাজমুজ সাকিব সাদি নামের এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী এ প্রতিবেদকের ফেইসবুকে একটি ক্ষুদে বার্তা পাঠান। তিনি বার্তায় বলেন, ‘কেউ ১০০০ টাকা আয় করলে অ্যাপস কোম্পানিকে ২৫০ টাকা দিতে হয়। সারা দিন রাস্তায় তেল খরচ হয় ৩০০ টাকার। সারা দিনের খাবার-নাস্তা বাবদ খরচ হয় ২০০ টাকা। এরপর তার মূল আয় দাঁড়ায় ২৫০ টাকা। বিষয়টিতে শোষণ স্পষ্ট হচ্ছে দাবি করে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ২৫ শতাংশের জায়গায় ২ শতাংশ কমিশন নেওয়ার প্রস্তাবের কথা বলেন তিনি।

রাইডারদের পাশাপাশি রাইড ব্যবহারকারীরাও বেশ কয়েকটি সমস্যার কথা জানান। তাদের মতে যে সমস্যাগুলো দেখা যাচ্ছে তা অল্পতেই সমাধান করা যায়। ‘রাইডারা ঝুঁকি নিয়ে বাইক চালিয়ে থাকেন। প্রতিষ্ঠানগুলোও রাইডের পরিমান দেখছে, গুনগত মান দেখছে না।’ বলছিলেন একটি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রফিকুল ইসলাম। রাইড শেয়ারিং এর যানবাহনের সংখ্যা নির্দিষ্ট করা দরকার। শুধু লাভের জন্য বেশি রেজিস্ট্রেশন দিলে এক সময় চাহিদা থাকবে না।’ বেশি রেজিস্ট্রেশন দিলে বিশৃঙ্খলা বাড়বে এবং অনেক বেকারের জন্ম হবে বলেও মনে করেন তিনি।

সরাসরি চুক্তির মাধ্যমে রাইডিং এ যাওয়াকে বড় একটা সমস্যা উল্লেখ করে রফিকুল বলেন, ‘এতে নিরাপত্তা থাকে না।’

রাজধানী ঢাকার সড়কে রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান কোন বাছবিচার না করেই বাইক বা কার রেজিস্ট্রেশন দিচ্ছে। এতে সড়কে বিশৃঙ্খলা বাড়বে বলে মনে করেন অনেক নগরবাসী। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের সূত্রে জানা যায়, মোটর বাইক ১১৭৮৪ ও কার ৮৮৫৩ (উবার), মোটর বাইক ২০০০০ ও কার ২০০০ (পাঠাও), মোটর বাইক ১১৭৮৪ ও কার ৬০১ (পিকমি), মোটর বাইক ২৬১১০ ও কার ১১৬১ (ওভাই), মোটর বাইক ৩০৮২২ ও কার ১৬৫৩ (সহজ), মোটর বাইক ৪৩৮৬ (চালডাল) রাজধানী ঢাকায় চলছে। এ ছাড়া অন্যান্য পরিবহনের মধ্যে বাস-মিনিবাস ৭০০০, সিএনজি চালিত অটো রিক্সসা ১৪০০০ ও ট্যাক্সি ক্যাব চলছে ৫০০টি।

নির্দিষ্ট সংখ্যার পর নতুন রেজিস্ট্রেশন দিতে অ্যাপস প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিধিনিষেধ দেওয়া দরকার বলে জানান ফজলে শাহরিয়ার। আইসিডিডিআরবি’র এ গবেষক প্রতিদিন রাইড ব্যবহার করে অফিসে যাওয়া-আসা করেন। তিনি একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে বলেন, ‘অনেক সময় চাহিদা বেশি বলে ভাড়া বেশি দেখায়। তবে গাড়ি বা বাইকগুলো একটু ভালো মানের হওয়া দরকার। এমন হওয়া উচিত যে, কোন ধরনের বাইক বা কার রেজিস্ট্রেশন পাবে। কেননা, বেশি টাকা খরচ করে ব্যবহারকারীরা আরামে গন্তব্যে যেতে চান।’

রাইড শেয়ারিং শুরু হওয়ার পর সারা দেশ থেকে বেকার যুবকেরা রাজধানীতে এসেছিলেন বাইক বা কার চালাতে। এতে করে তাদের বেকারত্ব কিছুটা ঘুচলেও তা স্থায়ী হচ্ছে না। বিস্তর প্রশিক্ষণ না থাকায় রাইডাররা ঢাকার রাস্তায় চলাচল করতে বেশ হিমশিম খাচ্ছেন। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে তারা যাত্রী বা ব্যবহারকারীদের সঙ্গে তারা ভালো ব্যবহার করেন না এমনটি বলছিলেন ফজলে শাহরিয়ার।

বেসরকারী একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আমিনুল মোমিন রাইড শেয়ারিং এ ভাড়া কমানোর কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘অ্যাপস প্রতিষ্ঠানের উচিত রাইডারদের কাছ থেকে কম কমিশন নেওয়া।’

অন্যদিকে যারা রাইডার হিসেবে কার বা বাইক চালান তাদেরকে ইনসুরেন্স সুবিধা দেওয়া কথা অ্যাপস প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বলা হলেও অনেক ক্ষেত্রে তা কার্যকর হয়নি বলে জানান রাইডাররা।

উল্লেখ্য, বর্তমানে ১৬ অ্যাপস প্রতিষ্ঠান রাইড শেয়ারিং এর নিবন্ধনের জন্য বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ’র (বিটিআরসি) নিকট আবেদন করেছে।

এসি

 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি