রামমোহন যেভাবে রাজা হলেন
প্রকাশিত : ১৫:৫০, ১০ জানুয়ারি ২০২৩
কেউ যখন সত্যকে উপলব্ধি করে তা নিয়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়েন তখন তিনি অমর হন। আর সত্য যদি তিনি নিজের মধ্যে রেখে দেন সত্য শক্তিহীন হয়ে যায় এবং তিনি হারিয়ে যান।
এখন থেকে ২০০ বছর আগের কথা। এক যুবক মারা গেছেন। যুবক যেহেতু মারা গেছেন, বিবাহিত, সমাজপতিরা রায় দিলো এই তরুণী বিধবা স্বামী ছাড়া থাকবে কীভাবে? অতএব স্বামীর সাথে তাকেও চিতায় তোলো। চিতায় আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। তার স্ত্রীকে তার সাথে সেই চিতায় তুলে দেয়া হয়েছে এবং স্ত্রীর আর্তনাদ যাতে কারো কানে না ঢোকে সেজন্যে প্রবল উদ্যমে ঢাকঢোল পেটানো হচ্ছে।
বিধবা তরুণী প্রাণভয়ে চিৎকার করছে, বেরোনোর চেষ্টা করছে। আত্মীয়স্বজনরা লম্বা বাঁশ দিয়ে তাকে চিতায় চেপে ধরেছে যাতে সে চিতা থেকে বেরোতে না পারে।
এদিকে এক তরুণ, তার দেবর অর্থাৎ যুবকের ছোট ভাই তার বৌদিকে বাঁচানোর জন্যে ছোটাছুটি করছে। একে ধরছে ওকে ধরছে। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ। বৌদির এই নিষ্ঠুর পরিণতি দেখে সেই তরুণ প্রতিজ্ঞা করল যে, নিষিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত এই অমানবিক সতীদাহ প্রথা রদ করার চেষ্টা থেকে আমি কোনোদিন বিরত হবো না এবং এই তরুণের নাম হচ্ছে রামমোহন রায়।
এ পুরো ঘটনাটা রাজশেখর বসু লিখে গেছেন। রাজশেখর বসুর বাবা নন্দশেখর বসু ছিলেন এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা দখল করলেও তখনও পুরোপুরি জেঁকে বসতে পারে নি। প্রশাসন এবং আদালতে নবাবী যে হালচাল নবাবী প্রভাব অনেকটাই রয়ে গেছে এবং সেসময়ে ফার্সি ছিল রাজকীয় ভাষা। বনেদি হিন্দু যারা ছিলেন তারা সন্তানকে তখনও পাটনা লাখনৌ এই এলাকাতে পাঠাতেন আরবি ফার্সি শেখার জন্যে যাতে তারা সরকারি বড় দায়িত্ব পালন করতে পারে।
তো নয় বছর বয়সে গেলেন। ১২ বছর বয়সে ফিরে এলেন। তিন বছর শিখলেন। আরবি ফার্সিতে তিনি দক্ষ হয়ে গেলেন। এরপর তাকে পাঠানো হলো কাশীতে ভালোভাবে সংস্কৃত ভাষা জানতে। তাহলে ক'টা ভাষা হলো? আরবি ফারসি সংস্কৃত এবং পরবর্তীতে তিনি আরো ছয়টা ভাষা শিখেন। উর্দু ইংরেজি ফরাসি ল্যাটিন গ্রিক হিব্রু। এই ভাষাগুলোর যত বই আছে সেই বইয়ের সাথে সাহিত্যের সাথে তিনি পরিচিত হলেন এবং তার প্রিয় কবি ছিলেন মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি।
রামমোহন রায় কিন্তু তার প্রথম বইটা লিখেন ফারসি ভাষায়-তোহফাত উল মোহাইদ্দিন। এক ঈশ্বরবাদীদের প্রতি উপহার। ‘তোহফা’ মানে হচ্ছে উপহার। তার ভূমিকা আবার লেখেন আরবি ভাষায় এবং ১০ বছর পর ইংরেজিতে লেখেন Why Upanishad? উপনিষদ কেন?
এ থেকে আমরা তার যে পাণ্ডিত্য, পাণ্ডিত্য সম্পর্কে আঁচ করতে পারি।
রামমোহন কুলীন ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। পিতামাতা উভয়েই খুব আচারনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ। তিনি হিন্দু ধর্মের সমালোচনা করে একটা বই লিখে ফেললেন পুস্তিকা- হিন্দুদের পৌত্তলিক ধর্ম প্রণালী। বুঝতেই পারেন এরপরে কী অবস্থা হয়! তার বাবা রেগে তাকে ত্যাজ্যপুত্র করে দিলেন। তিব্বতীরা ক্ষেপে তাকে মারার জন্যে একদম জোটবদ্ধ হয়ে গেল! তিনি আসলে রোমান্টিক একজন মানুষ ছিলেন। সেই সময় হুগলী থেকে নেপাল হয়ে হিমালয় ডিঙ্গিয়ে তিব্বতে চলে গেলেন তিনি। কী কঠিন দুর্গম পথ!
তিব্বতে গেলেন বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করবেন সে জন্য। কিন্তু কিছু কিছু মানুষের রাশি খারাপ থাকে। তারও রাশি খারাপ। ওখানে পড়লেন আরেক বিপদে। তিব্বতে তখন যেটা হচ্ছে যে লামা তাদের যে পুরোহিত, হেড, সবচেয়ে বড় ধর্ম ই দালাই লামা। লামাকে তিব্বতীরা বলতেন যে লামা হচ্ছেন জগতের সৃষ্টি ও স্থিতির কর্তা। যে জগতের সৃষ্টি এবং স্থিতি এটা হচ্ছে দালাই লামা। রামমোহন রায়ের কাছে স্বাভাবিকভাবে এটা অতিরঞ্জন মনে হলো। তিনি তীব্র প্রতিবাদ করলেন যে না, মানুষ কীভাবে হয়?
তিব্বতীরা তো গেল ক্ষেপে। তাকে মারার জন্যে জোটবদ্ধ হয়ে গেল।
তবে রাম মোহনের যেটা ছিল যে হি ওয়াজ এ ভেরি স্ট্রং ম্যান। ছয় ফুট লম্বা, সেরকম তাগড়া সেরকম স্বাস্থ্যবান। প্রতিদিন ১২ সের দুধ খেতেন এবং একটা আস্ত পাঁঠা উনি ইচ্ছা করলে এক বৈঠকে খেয়ে ফেলতে পারতেন। তিব্বতের মহিলারা তাকে খুব সহযোগিতা করে এবং তাকে ওখান থেকে পালানোর পথ করে দেন। এজন্যে রামমোহন সবসময় নারীদের প্রতি খুব কৃতজ্ঞ ছিলেন। কারণ তারা যদি ওভাবে সহযোগিতা না করত তাহলে একা যতই তাগড়া হোক, ৫০ জন ১০০ জন আসলে একা কী করবে? পালিয়ে গেলেন।
আবার চলে এলেন কলকাতায়। কিন্তু খুব মেধাবী ছিলেন। আর স্বাভাবিকভাবে ব্যক্তিত্ব আকর্ষণীয় ছিল।
কলকাতায় চিন্তাশীল এবং সংস্কার প্রয়াসী উদারমনা মানুষের একটা শ্রেণী থাকে। এরা কখনো সঙ্ঘবদ্ধ থাকে কখনো বিক্ষিপ্ত থাকে। কিন্তু এরা আবার অত একটিভ না। আলাপ আলোচনা করেই এদের আলোচ্য শেষ। কলকাতায় তাকে কেন্দ্র করে চিন্তাশীল এবং সংস্কার প্রয়াসী হিন্দুদের একটা সমাবেশ গড়ে ওঠে। এটার নাম দেয়া হয় আত্মীয় সভা। মানে আত্মার আত্মীয় সভা। সেখানে বেদান্ত শাস্ত্র, একেশ্বরবাদ সম্পর্কে আলোচনা হতো।
১৮১৫ সালে তিনি বেদান্ত সূত্র বাংলা ভাষায় অনুবাদ করলেন। দুঃসাহসিক কাজ! কারণ যে সমাজে নিম্নবর্ণের কেউ বেদ উচ্চারণ করলে তার জিহ্বা কেটে দেয়া হতো, সেই সমাজে বেদান্ত সূত্র বাংলা ভাষায় অনুবাদ করা একটা দুঃসাহসিক কাজ এবং নিঃসন্দেহে অত্যন্ত সাহসী এবং বৈপ্লবিক কাজ। মূলত হিন্দু শাস্ত্রগুলো অনুবাদ করে তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন যে ‘দেশাচার’ বলে যেগুলো চালানো হয় শাস্ত্রে কোথাও এগুলো লেখা নাই। যেমন সতীদাহ। এটা কিন্তু ধর্মীয় বিধান নয়। বেদে কোথাও নাই।
বরং বেদে খুব পরিষ্কারভাবে রয়েছে যে অথর্ববেদ এবং ঋগ্বেদ এটার অনুবাদ করেছেন ডক্টর তুলসীরাম ইংরেজিতে। Rise oh women, toward the world of the living. Leave the dead where he lie. Come and join the state of conjugality with this man who offers to hold your hand, who offers to hold your hand as your second husband and life partner.
অর্থাৎ, হে নারী! মৃত পতির শোকে অচল হয়ে লাভ কী? অচল হয়ে থেকো না। বাস্তব জীবনে ফিরে আসো। পুনরায় তোমার পাণি গ্রহণ করা পতির সাথে মিলিত হও এবং আবার পত্নীত্ব তৈরি হবে, উইল বি ওয়াইফ।
এটা কিন্তু অথর্ববেদের সূত্র। কিন্তু যেহেতু সাধারণ মানুষের জন্যে বেদের সূত্র জানা সম্ভব ছিল না। কারণ সাধারণ মানুষের জন্যে বেদবাণী উচ্চারণ করা এটা রৌরব নরকে যাওয়ার শাস্তি যোগ্যতুল্য।
রৌরব হচ্ছে নরকের সবচেয়ে যেমন হাবিয়া দোজখকে বলা হয় যে দোজখের সবচেয়ে খারাপ জায়গা। রৌরব নরক হচ্ছে সবচেয়ে খারাপ জায়গা।
যখন তিনি বললেন যে, যে সমস্ত দেশাচার বলে যা চলছে শাস্ত্রে কোথাও এটার উল্লেখ নাই। তুমুল উত্তেজনা চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলো।
রামমোহন রায় গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, “আমি ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করে বিবেক ও সরলতার আদেশে যে পথ অবলম্বন করেছি তাতে আমার প্রবল কুসংস্কারাচ্ছন্ন আত্মীয়দের তীরস্কার ও নিন্দার পাত্র হতে হলো। কিন্তু ইহা যতই হোক না কেন আমি এই বিশ্বাসে দৃঢ়ভাবে সমস্ত সহ্য করতে পারি যে একদিন আসবে যখন আমার এই সামান্য চেষ্টা লোকে ন্যায়ের দৃষ্টিতে দেখবে। হয়তো কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবে। অতএব আমি আমার মত থেকে নড়ব না।”
রামমোহনের এই আশা ব্যর্থ হয় নি। জীবদ্দশায় তিনি যে কাজের জন্যে নিন্দিত হয়েছিলেন, তার জন্যেই মানুষ আজো শ্রদ্ধাভরে তাকে স্মরণ করে।
“রামমোহন তাহার দেশবাসীর নিকট যে নিন্দালাভ করেছিলেন সেই নিন্দাই তার গৌরবের মুকুট”
রামমোহন যে ‘ব্রাহ্মসমাজ’ পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন একেশ্বরবাদ প্রচারের জন্যে, তো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ কিন্তু সেই ব্রাহ্মসমাজে ১০ বছর জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন মহাসচিব ছিলেন।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “রামমোহন তাহার দেশবাসীর নিকট যে নিন্দালাভ করেছিলেন সেই নিন্দাই তার গৌরবের মুকুট।”
অর্থাৎ সত্য বলতে গিয়ে যদি আপনি নিন্দিত হন আপনার মৃত্যুর পরে হলেও আপনি নন্দিত হবেন এই সত্য বলার জন্যে।
এই আত্মীয় সভায় জাতিভেদ বহুবিবাহ বিধবা বিবাহ প্রভৃতি বিষয়ে আলাপ আলোচনা হতো সদস্যদের মধ্যে।
যখনই সতীদাহ প্রথা বিলোপ করা নিয়ে আলোচনা শুরু হলো সভার বেশ কিছু সদস্য রামমোহনের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেললেন। তখন রামমোহন সমমনা একেশ্বরবাদীদের নিয়ে গঠন করলেন, ব্রাহ্মসমাজ ১৮২৮ সালে এবং অন্যদিকে সতীদাহের বিরুদ্ধে সামাজিক এবং আইনি লড়াই শুরু করলেন। তখন অনেক কুসংস্কার ছিল বাঙালি হিন্দু সমাজের জীবনে।
সতীদাহ, তারপরে মানত করে সন্তানকে গঙ্গায় বিসর্জন দেয়া, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, অস্পৃশ্যতা। কিন্তু রাজা রামমোহন রায় বুঝতে পেরেছেন সবগুলো তিনি করতে পারবেন না। তিনি একটা পয়েন্ট বেছে নিলেন। কোনটা? তরুণ মনে যে নৃশংসতা সেই চিত্র। তার বৌদির সেই আর্তনাদ।
একটা মানুষ তাকে যদি জীবন্ত পোড়ানো হয় সেসময় আর্তনাদটা কোন জায়গা থেকে আসে। সেই আর্তনাদ তিনি ভুলতে পারেন নি। তিনি সতীদাহকে নিলেন।
আসলে একজন মানুষ সমাজে সবকিছু করতে পারে না। তাকে করতে হয় প্রজ্ঞার সাথে। এবং রামমোহন প্রজ্ঞাবান একজন মহাপুরুষ ছিলেন যিনি শনাক্ত করতে পেরেছিলেন যে একটা দিয়ে শুরু করতে হবে। সেই একটা কী? সেই একটা হচ্ছে সতীদাহ।
যে সবসময় নিজের সামর্থ্যকে বুঝতে পারাটা খুব ইম্পরট্যান্ট। কারণ স্টেপটা তো আপনাকে দিতে হবে প্রথম স্টেপ। আল্লাহর সাহায্য তো পরে আসবে।
আসলে রামমোহন যুক্তির সাহায্যে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেন যে সতীপ্রথা শাস্ত্রসম্মত নয়। বেদবেদান্তে কোথাও সতীপ্রথার উল্লেখ নাই। কারণ যেহেতু ঐ যে সংস্কৃত পড়েছেন তিনি। অতএব তাকে তো মানে ফাঁকি দেয়া যাবে না! তখন ইংরেজ বড়লাট ছিল হেস্টিংস। তিনি যখন দেখলেন যে শাস্ত্র নিয়ে হিন্দুদের মধ্যেই এখন মতবেদ আছে দুই মত। এক মত সতীদাহের পক্ষে, আরেক মত সতীদাহের বিপক্ষে। তখন ইংরেজরা উদ্যোগী হলো।
রামমোহন রায় শাস্ত্র ঘেঁটে তিনি একটি পুস্তিকা লিখলেন প্রবর্তক ও নিবর্তক সম্বাদ।
রক্ষণশীল যারা তারাও বসে রইল না। তারা বলল যে, রামমোহন মূর্তিপূজায় বিশ্বাস করে না। ইংরেজদের সাথে বসে খায়। সে বিধর্মী হয়ে গেছে। যেটা থাকে সবসময়ই। তারা মানে বাড়ির কাছে এসে সকালবেলা মোরগডাক ডাকত। ঘরের ভেতরে গরুর হাড়গোঁড় এগুলো ফেলত। বখাটে ছেলের দল লাগিয়ে দিয়েছিল যে তাকে ক্ষেপানোর জন্যে গালিগালাজ করার জন্যে রামমোহন যখন গাড়িতে করে ব্রাহ্মসমাজে যেতেন উপাসনার জন্যে এরা সব ঢিল ছুঁড়ত।
রামমোহন কোনোদিনই গাড়ির জানালা বন্ধ না করে রাস্তা পার হতে পারেন নাই। তখনকার হিন্দু পণ্ডিত সমাজ তাকে যে ভাষা ব্যবহার করেছে পাষণ্ড, ম্লেচ্ছ। অর্থাৎ রামমোহন মুসলমান হয়ে গেছে। বকধূর্ত কপট নামে সম্বোধন করত।
আসলে যুগে যুগে যারাই সত্যকে সত্যের শিক্ষাকে মানুষের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছেন তাদের এই নিন্দা-গঞ্জনা সহ্য করতেই হয়েছে। এই নিন্দা হচ্ছে ভূষণ।
কবিগুরু রামমোহনের খুব ভক্ত ছিলেন! কবিগুরু পরবর্তীতে লিখেছেন, ‘মহাপুরুষ যখন আসেন তখন বিরোধ নিয়েই আসেন। নইলে তার আসার কোনো সার্থকতা নেই। ভেসে চলার দল মানুষের ভাসার স্রোতকেই মানে। যিনি উজিয়ে নিয়ে তরীকে ঘাটে পৌঁছে দেবেন তার দুঃখের অন্ত নাই। স্রোতের সঙ্গে প্রতিকূলতা তার প্রত্যেক পদেই।’
যদি আপনি বিরোধিতার সম্মুখীন না হন তাহলে বুঝতে হবে যে আপনি নতুন কিছু নিয়ে আসেন নাই আপনি মহাপুরুষ নন। কিন্তু প্রতিকূল স্রোতে যিনি সবর করতে পারেন আল্লাহ সবসময় তার সাথে থাকেন।
রামমোহনকে তার বাবা ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন কিন্তু মৃত্যুর সময় তার পিতা তাকে সম্পদের ভাগ দিয়ে যান। হয়তো তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, না তার পুত্রই সত্য। তো তাকে ত্যাজ্য করার মতন কোনোকিছু ছিল না।
সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করার পর দেখেন মা, এও মা। মা তারিণী দেবী কোর্টে পুত্রের বিরুদ্ধে মামলা করেন। বিধর্মী পুত্র কোনোভাবেই যেন পৈতৃক সম্পত্তির উত্তরাধিকারী না হয় এইজন্যে। শুনানির সময় আসলে যখন কেউ ধর্মান্ধ হয়ে যায় তার কীরকম মতিভ্রম হয় তার মা হচ্ছে তার প্রমাণ।
শুনানির সময় তারিণী দেবী বলেন, ‘ধর্মত্যাগী পুত্রের মস্তক (মস্তক মানে মাথা) যদি এখানে ছিন্ন করা হয় তাহলে আমি পুণ্য কাজ বলে মনে করব। বুঝতে পারছেন?’
রামমোহন তো একজন মহাপুরুষ। তিনি মায়ের বিরুদ্ধে কিন্তু মামলা লড়তে চান নি। কিন্তু পরে তিনি পরে ভাবলেন যদি আমি মামলা না লড়ি তাহলে তার যে আন্দোলন তার আন্দোলন সম্পর্কে মানুষের মনে ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হবে। তিনি মামলা লড়লেন এবং জয়ী হলেন। মামলায় জয়ী হওয়ার পরে তিনি মাকে সম্পত্তি ফেরত দিয়ে দিলেন। এটা হচ্ছে পুত্র।
কারণ তার যুদ্ধ মায়ের বিরুদ্ধে ছিল না। তার যুদ্ধ ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে।
১৮২৯ সালে আইন করে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ হলো! এ প্রথা রদের জন্যে যারাই সমর্থন করল রামমোহনকে তাদের বিরুদ্ধেও ফতোয়া জারি করা হলো যে, তাদের সঙ্গে কেউ বিয়ে বা আহার করলে সে জাত হারাবে।
এই যখন অবস্থা এই সময়ে হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কিছু গোঁড়া এবং ধর্মান্দ্র ব্যক্তি, অসহিষ্ণু কিছু মানুষ তার প্রাননাশেরও চেষ্টা করে। ১৮২৯ সালে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ তারাতো রামমোহনের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মসমাজের বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ হলো এবং তখনকার রাজা রাধাকান্ত দেব ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় এরা ধর্মসভা প্রতিষ্ঠা করলেন তখন। এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮২৯ সালে আইন করে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করল।
ধর্মসভার যারা সদস্য তারা ১৯টা সভা করে ১,১০০ লোকের স্বাক্ষর নিয়ে একটা আবেদনপত্র তৈরি করল ঠিক হলো যে ইংল্যান্ডে প্রিভি কাউন্সিলে লন্ডনে প্রিভি কাউন্সিলে এই আইনের বিরুদ্ধে তারা আপিল করবে।
সমর্থকদের আপিল ঠেকাতে ইংল্যান্ডে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন রামমোহন! কিন্তু লন্ডনে যাবে কে? কারণ তখনকার দিনে হিন্দু সমাজে রীতি ছিল যে কালাপানি। মানে সমুদ্র অতিক্রম করলে তার জাত যাবে। তার আর জাত থাকবে না। অতএব কেউ রাজি হলো না। যে না প্রিভি কাউন্সিলে কেউ যাবে না।
তখনকার দিনে ৫০ হাজার টাকা খরচ করে ইংরেজ এটর্নি ফ্রান্সিস বেথিকে নিয়োগ করল তারা। যে প্রিভি কাউন্সিলে সতীদাহ প্রথা পুনরায় চালু করার জন্যে মামলা করার জন্যে। রামমোহন চেষ্টা করলেন সতীদাহ যাতে আর ফিরে না আসে।
এই সময়ে দিল্লিশ্বরও একসময়ে ছিল কী? দিল্লিশ্বর জগদীশ্বর। সম্রাট আকবরকে তো বলা হতো যে মানে ওখানে দিল্লিশ্বর জগদীশ্বর। তখনকার দিল্লিশ্বর জগদীশ্বর ছিল আকবর দ্বিতীয়। আকবর তার ভাতা বাড়ানোর দরকার। তাকে যে ভাতা ইংরেজরা দিত সেই ভাতায় তার চলছে না।
এই ভাতা বাড়ানোর আপিল করার জন্যে যাতে এই ভাতা বাড়ানোর আবেদনও করা হয় এইজন্যে দ্বিতীয় আকবর রামমোহনকে ‘রাজা’ উপাধি দিলেন। কারণ রাজা ছাড়া তো কেউ সম্রাটের পক্ষে আপিল করতে পারে না। সাধারণ মানুষ আপিল করতে পারে না। এইজন্যে তাকে রাজা উপাধি দিলেন এবং তখন থেকে রামমোহন হয়ে গেলেন রাজা রামমোহন রায়।
রামমোহন হচ্ছেন প্রথম হিন্দু যিনি সমুদ্র পাড়ি দিলেন, ইংল্যান্ডে গেলেন। রামমোহনের আত্মীয়স্বজনরা সবাই তাকে বোঝানোর চেষ্টা করল যে বিলেতে গেলে শাস্ত্র অনুযায়ী তোমার জাত হারাবে।
তিনি বলেন, ‘এইসব জাতপাত আমি মানি না। কারণ যে মানুষ সারাজীবন সত্যের জন্যে লড়াই করেছেন সেই মানুষ তো আর জাতপাত মানতে পারে না!’
১৮৩১ সাল থেকে ১৮৩৩ সাল, এই তিন বছর তিনি ওই মামলার আর সম্রাটের জন্যে মাসোহারা বাড়ানোর তদবির করতে করতে অবশ্য সফল হয়েছিলেন। সম্রাটের মাসোহারা কিছু বেড়েছিল ৬২ বছর বয়সে সেখানেই তিনি মারা যান।
রামমোহন শুধু যে ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন তা নয়, তিনি ৩০টি বাংলা গ্রন্থ রচনা করেছেন। ১৮২১ সালে তার সম্পাদিত পত্রিকা ‘সম্বাদ কৌমুদী’, এটাই ছিল বাংলার বাঙালি সম্পাদিত প্রথম সংবাদপত্র। পরের বছর তিনি ফার্সি ভাষায় ‘মিরাত-উল-আকবর’ নামে পত্রিকা বের করেন। একটা ফারসি ভাষায়, আরেকটা বাংলা ভাষায়। পত্রিকা বের করার দুটো উদ্দেশ্য ছিল। এক হচ্ছে, তৎকালীন সমাজের নানা কুসংস্কার এটা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা।
বহির্বিশ্বে যা ঘটছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ কীভাবে মুক্তির সন্ধানে বিপ্লব করছে যেমন ফরাসি বিপ্লবের কথা কিন্তু রাজা রামমোহন প্রথম বাংলা ভাষায় উল্লেখ করেন।
এসএ/