ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪

রাষ্ট্রের ধর্ম বনাম ধর্মের রাষ্ট্র

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ২০:৫৬, ৩ অক্টোবর ২০২০

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি, অর্থনীতি-কড়চা, Freedom for Choice প্রভৃতি।

‘ধর্ম’ শব্দটির দু’টো মাত্রিকতা আছে। একটি হচ্ছে- ‘প্রকৃতি’ এবং অন্যটি হচ্ছে- ‘বিশ্বাস’। ধর্ম শব্দটি যেমন প্রকৃতি বোঝায়, তেমনি বোঝায় বিশ্বাস।

এই যেমন- পাঠ্যপুস্তকে লেখা থাকে, ‘জলের ধর্ম হচ্ছে যে পাত্রে রাখা হয়, তার আকার ধারন করা’, কিংবা ‘আগুনের ধর্ম হচ্ছে জ্বালানো’। অথবা আমরাও কথা প্রসঙ্গেই বলি,’গাছের ধর্ম হচ্ছে ছায়া প্রদান’ কিংবা ‘বিড়ালের ধর্ম হচ্ছে চুরি করে খাওয়া’। 

এ সমস্ত কথাগুলোতেই ধর্ম শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে ‘প্রকৃতি’ অর্থে, এর সঙ্গে ‘বিশ্বাসের’ কোন সম্পর্ক নেই। তাই আমরা যখন বলি- ‘আগুনের ধর্ম হচ্ছে জ্বালানো’। এর মানে হচ্ছে- আগুনের প্রকৃতি হচ্ছে প্রজ্জ্বলিত করা। এ কাজটি আগুনের বিশ্বাস-উদ্ভূত নয়। জল, আগুন, গাছ কিংবা বিড়ালের কোন ‘বিশ্বাস’ থাকতে পারে না। আসলে মানুষ-বহির্ভূত প্রাণীর কিংবা বস্তুর ধর্ম বলতে শুধু তাদের প্রকৃতিই বোঝায়।

কেবলমাত্র মানুষের ক্ষেত্রেই ধর্ম শব্দটির দু’টো মাত্রিকতাই কাজ করে - ‘প্রকৃতি’ ও ‘বিশ্বাস’। তাই যখন বলি, ‘শিক্ষকের ধর্ম হচ্ছে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানদান’, কিংবা ‘চিকিৎসকের ধর্ম হচ্ছে মানুষকে সেবা দান’, তখন আমরা বোঝাতে চাই যে এগুলো হচ্ছে- তাঁদের পেশার প্রকৃতি। 

কিন্তু পেশার প্রকৃতির বাইরেও মানুষের বিধাতা, জীবনবোধ, পরলোক বিষয়ে একটি ব্যক্তিগত বিশ্বাস থাকে। সেটাও মানুষের ধর্ম - তবে ‘প্রকৃতি-উদ্ভূত’ নয়, সেটা ‘বিশ্বাস-উৎসারিত’। সেই ব্যক্তিগত বিশ্বাস-উৎসারিত ধর্মের নানান বিভাজনের ভিত্তিতে কেউ খৃষ্টান, কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান হিসেবে চিহ্নিত। বিশ্বাস-উৎসারিত ধর্ম শুধু মানুষেরই থাকতে পারে। 

এ সব কথার পরিপ্রেক্ষিতে এটা সুস্পষ্ট যে, সংজ্ঞাগত কাঠামোগত দিক থেকে রাষ্ট্র স্বত্ত্বাটির ‘প্রকৃতি-উদ্ভূত’ ধর্ম থাকে, কিন্তু কেমন করে তার ‘বিশ্বাস-উদ্ভূত’ ধর্ম থাকে? প্রত্যাশিত প্রকৃতি অনুযায়ী একটি রাষ্ট্রের ধর্ম হচ্ছে তার ‘ভৌগোলিক সার্বভৌমত্ব সুরক্ষা করা, তার ‘নাগরিকদের নিরাপত্তা ও সমানাধিকার সুনিশ্চিত করা’ ইত্যাদি। এগুলো রাষ্ট্রের সাংগঠনিক কাঠামো-উৎসারিত। 

মানুষের মতো রাষ্ট্রের কোন বিশ্বাস-উদ্ভূত অপ্রাসঙ্গিক, কারণ নানান জনগোষ্ঠী একটি রাষ্ট্রে বাস করলেও রাষ্ট্র কোন মানুষ নয়। রাষ্ট্র যদি মানুষের মতো ধর্ম বিশ্বাসী হয়, তখন রাষ্ট্রের মতো স্বত্ত্বাটির  পক্ষে ধর্মীয় অনুশাসনে আবদ্ধ হওয়া ভিন্ন আর কোন যৌক্তিক পথ খোলা থাকে না।

এনএস/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি