রিকশার সাথে ৩৫ বছরের সংসার নাজমার
প্রকাশিত : ১৭:৫০, ৩ মে ২০১৮ | আপডেট: ১০:১৮, ২৫ জুলাই ২০১৮
পরিবেশবান্ধব যানবাহন হিসেবে রিকশার গ্রহণযোগ্যতা অনেক। রাজধানী ঢাকাকেও বলা হয় রিকশার নগরী। এ রিকশা নিয়ে মাতামাতিও কম হয়নি। কেউ কেউ রিকশাকে যানঝটের অন্যতম কারণ হিসেবে দায়ী করলেও পরিবেশ বিজ্ঞানীরা রিকশার পক্ষেই মত দিয়েছেন সব সময়। শুধু এই ঢাকা শহরেই পাঁচ লাখ রিকশা নিয়মিত চলাচল করে বলে জানা যায় বিভিন্ন জরিপে।
তবে আজ কোনো রিকশা নয়, বরং রিকশার পেছনে লুকিয়ে থাকা একজন সংগ্রামী নারীরর কারিগরের কথা জানবো। যিনি টানা পঁয়ত্রিশ বছর রিকশার পেছনে শ্রম দিচ্ছেন। নিজে যেমন একজন দক্ষ রিকশা মিস্ত্রি তেমনি তার কাছে কাজ শিখে ঢাকা শহরেই মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করছেন আরো পনের বিশজন।
ধানমন্ডির আবাহনী মাঠের পশ্চিশ পাশে ফুটপাতে রিকশা মেরামতের কাজ করেন নাজমা আক্তার। রিকশার কাজ মানে নানাবিধ কাজ। রিকশা চলতে চলতে নানা যন্ত্রপাতি বিগড়ে যায়। দিতে হয় তেল। চাকায় হাওয়া দিতে হয়। টাল ভেঙ্গে গেলে জোড়া লাগাতে হয়। সাইকেলের গিয়ারের কাজ করতে হয়। আর এসব কাজ দক্ষ হাতে নিমিষেই করে থাকেন নাজমা। গুরুত্ব দিয়ে কাজ করেন বলেন সারাদিন কাজের ভীড় লেগেই থাকে।
সূর্য যখন মাথার উপরে তখন নাজমার সাথে ফুটপাতের দোকানে বসে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। স্মৃতিচারণ করে বলে চলেন অতীতের কথা। ছোট বেলায় বাবা মায়ের সাথে ধানমন্ডির শঙ্কর এলাকায় থাকতেন। বাবা ছিলেন দিনমজুর। সেখানে নাজমার মামা সম্পর্কের একজনের রিকশা মেরামতের দোকান ছিল। সেই দোকানে ফ্রক পরা গায়ে খালি পায়ে বসতেন তিনি। এটা ওটা নেড়ে চেড়ে দেখতেন। আস্তে আস্তে সেখান থেকেই কাজ রপ্ত করেন নাজমা। দিনের পর দিন যায়, মাস যায়। বছর যায়। একদিন বুঝতে পারেন তিনি রিকশার সব কাজ পারেন। তখন নিজেই ফুটপাতের ভিন্ন একটি জায়গায় রিকশা মেরামতের কাজ শুরু করেন। সেটাও প্রায় ত্রিশ বছর আগের কথা।
ভাঙ্গা রিকশা মেরামত করে সচল করে তুলেন নাজমা আকক্তার। আর সেই টাকায় চলে সংসার। কালি মাখা হাত তার উপার্যনের হাতিয়ার।
নাজমা আক্তার এখন যেখানে রিকশা মেরামতের কাজ করেন সেখানে আছেন গত তের বছর ধরে। স্বামী, তিন মেয়ে ও নাতি নাতনী নিয়ে তার সংসার। রিকশা মেরামতের টাকা দিয়ে বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। মেয়ের জামাই রিকশা চালায়। মেজ মেয়ে তার স্বামীকে নিয়ে মায়ের সাথেই থাকে। মেজো মেয়ের স্বামী শ্বাশুড়ীর কাজের শিষ্য। ছোট মেয়েরও বিয়ে হয়েছে কিছুদিন আগে। তার বরও রিকশা চালাক। নাজমা আক্তারের বড় সহযোগী তার স্বামী হৃদয়। হৃদয়ের সাথে কথা বলে জানা যায়, তিনি প্রথম জীবনে চায়ের দোকানে চাকরি করতেন। নাজমা আক্তারের সাথে বিয়ের পর স্ত্রীর আগ্রহে রিকশা মেরামতের কাজ শিখেন। নাজমার ভাষায়, ওনি (হৃদয়) মানুষের দোকানে কাজ না করে নিজে স্বাধীনভাবে কিছু করুক সেটাই চেয়েছিলাম।
হৃদয় কাজ শিখেন স্ত্রীর কাছেই। এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে বলেন, আমি বেশির ভাগ সাইকেলের কাজ করি। সাইকেলের গিয়ারের কাজ, টাল ভাঙ্গা ও ব্রেক সংক্রান্ত কাজগুলো করি।
নাজমা আক্তারের সংরক্ষণে আছে কুড়ি-বাইশ হাজার টাকার যন্ত্র। যা রিকশা মেরামতের নানা কাজে লাগে। নাজমা আক্তার বলেন, একটা সংসারে যেমন ছোটো বড় অনেক জিনিসের দরকার হয়, তেমনি রিকশা মেরামতের কাজেও লাগে নানা জিনিস। রিকশা নিয়েই তো আমার সংসার। তাই চেষ্টা করি যত্ন করে কাজ করতে।
এই ঢাকা শহরেই ছড়িয়ে আছে তার পনের বিশ জন শিষ্য। তাদের একজন মাহবুব। মাহবুব বলেন, নাজমা আক্তার আমার ওস্তাদ। ঢাকা শহরে এ লাইনে তিনি সেরা। তার কাছে কাজ শিখলে সারা জীবন নিশ্চিন্তে কাজ করা যায়।
রিকশার চাকার মতো জীবন ঘুরে। নাজমা আক্তারদের শরীরের পড়ে বয়সের ছাপ। কিন্তু ভাগ্য পাল্টায় না। রিকশায় চড়ে বাতাস খেতে খেতে আমরা যখন সুখানুভূতি লাভ করি তখন রিকশার পেছনে থেকে যায় নাজমা আক্তারদের অদেখা জীবনগাঁথা।
আআ/টিকে