রুটির কারখানায় কাজ করতেন মাক্সিম গোর্কি
প্রকাশিত : ১৬:৪২, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ১৩:৫৮, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
বাবার নাম ছিল মাক্সিম পেশকভ। মা ভারিয়া। তাদের প্রথম সন্তান আলেক্সেই পেশকভের জন্ম হয় ১৮৬৮ সালের ২৮ শে মার্চ। পিতৃদত্ত এই নাম মুছে গিয়ে গোর্কি নামেই উত্তরকালে তিনি জগৎবিখ্যাত হন। বাবা মারা যাবার পর মায়ের সঙ্গে এসে আশ্রয় নিলেন মামার বাড়ি নিজনি নভগরোদ শহরে। কিছুদিন পর স্থানীয় স্কুলে ভর্তি হলেন। ইতোমধ্যে মা আরেকজনকে বিয়ে করেছেন।
হঠাৎ করে মা মারা গেলেন। দাদামশাই আর গোর্কির দায়িত্বভার নিতে চাইলেন না। মায়ের শেষকৃত্যের কয়েকদিন পরেই তাকে ডেকে বললেন তোমাকে এভাবে মেডেলের মত গলায় ঝুলিয়ে রাখব তা তো চলতে পারে না। এখানে আর তোমার জায়গা হবে না। এবার তোমার দুনিয়া ঘাটে বেরুবার সময় হয়েছে।
শুরু হলো গোর্কির নতুন জীবন। শহরের সদর রাস্তার উপর এক শৌখিন জুতোর দোকানের বয়। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম। একদিন দোকানের চাকড়ি ছেড়ে দিলেন। কিছুদিন পথে পথে ঘুরে বেড়ালেন। একটা কয়েদি জাহাজের চাকড়ি পেলেন। যাদের নির্বাসন দেওয়া হত তাদের সেই জাহাজে করে নিয়ে যাওয়া হত। জাহাজের কর্মচারীদের বাসন ধোয়ার কাজ ছিল গোর্কির। ভোর ছটা থেকে মাঝ রাত অবধি কাজ। তারই ফাকে ফাকে দু চোখ ভরে দেখতেন নদীর অপরুপ রুপ। দু পারের গ্রামের দৃশ্য।
হিসেবপত্র মিটিয়ে আট রুবল নিয়ে ফিরে এলেন নিজের শহর নিজনি নভগরোদে।
জীবনের নানান ঘাত-প্রতিঘাতে এক পেশা থেকে আরেক পেশায় ঘুরতে ঘুরতে বড় হয়ে উঠতে থাকেন গোর্কি। সব কিছুর মধ্যেও বই পড়ার নেশা বেড়ে চলেছে। বইয়ের কোন বাদবিচার ছিল না। সর্বভূকের মত যা পেতেন তাই পড়তেন। একদিন হাতে এল মহান রুশ কবি পুশকিনের একটি কবিতার বই। পড়তে পড়তে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলেন। তখন রাশিয়ার জারের রাজত্বকাল। দেশ জুড়ে চলছিল শাসনের নামে শোষন অত্যাচার। বিপ্লবী দলের সাথে যুক্ত হয়েই গোর্কি পরিচিত হলেন মাক্সের রাচনাবলীর সাথে। অর্থনীতি ইতিহাস সমাজনীতি , দর্শন, আরো নানান বিষয়ের বই পড়তে আরম্ভ করলেন। দারিদ্র ছিল তার নিত্যসঙ্গী। কিছুদিন পর একটি রুটি কারখানায় কাজ পেলেন। সন্ধ্যে থেকে পরদিন দুপুর অবধি একটানা কাজ করতে হত। তারই ফাকে যেটুকু সময় পেতেন বই পড়তেন। তার এই সময়কার জীবনে অভিজ্ঞতার কাহিনী অবলম্বনে পরবর্তীকালে লিখেছিলেন বিখ্যাত গল্প ‘ছাব্বিশজন লোক একটি মেয়ে’।
রুটির কারখানায় কাজ করবার সময় পুলিশের সন্দেহ পড়েছিল তার উপর। সুকৌশলে নিজেকে বাচিয়ে চলতেন গোর্কি। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে করতে সব শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। তার উপর যখন সন্দেহ অবিশ্বাস , নিজের উপরেই সব বিশ্বাসটুকু হারিয়ে ফেলতেন। মনে হত এইজীবন মূল্যহীন, বেচে থাকবার কোন অর্থ নেই। বাজার থেকে একটি পিস্তল কিনলেন। ১৮৮৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর নদীর তীরে গিয়ে নিজের বুকে গুলি করলেন। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। ডাক্তাররা জীবনের আশা ত্যাগ করলেও অদম্য প্রাণশক্তির জোরে বেঁচে গেলেন গোর্কি।
এক বৃদ্ধ বিপ্লবী মাঝে মধ্যে রুটির কারখানায় আসতেন। সুস্থ হয়ে উঠতেই গোর্কিকে নিয়ে গেলেন নিজের গ্রামের বাড়িতে। ঘুরতে ঘুরতে এলেন ক্যাসপিয়ান সাগরের তীরে এক ছোট শহড়ে। কোথাও বেশিদিন থাকতে মন চায় না। রেলে পাহাড়াদারির কাজ নিয়ে এলেন নিজের পুরনো শহর নিজনি নভগোরদে। এই সময়ে সে কিছু কবিতা রচনা করেছিলেন। নাম দেন ”পুরনো ওকের গান”। দুজন বিপ্লবীর সাথে পরিচয় ছিল। সেই জন্যে পুলিশ তাকে বন্দী করল। কিন্তু প্রমাণের অভাবে কিছুদিন পর ছেড়ে দিল। প্রায় দুবছর সেখানে রয়ে গেলেন।
কবিতা লিখলেও গল্প বা প্রবন্ধ নয় গল্প” মাকার চুদরা”। কালুঝানি তাকে নিয়ে গেলেন স্থানীয় পত্রিকা অফিসে নিজের নাম সই করবার সময় নিজের নাম আলেক্সই পেশকভের পরিবর্তে লেখলেন মাক্সিম গোর্কি। মাক্সিম বাবার নাম আর গোর্কি শব্দের রুশ অর্থ হল তিক্ত।
গল্পটি প্রকাশিত হল ১৮৯২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। এই গল্পে বাস্তবতার চেয়ে রোমান্টিকতার প্রভাবই বেশি। নিজনি শহরে থাকতেন তরুণ লেখক ভ্লাদিমির করোলেস্কা। একদিন গোর্কির সাথে পরিচয় হল। করোলেস্কার কথায় চেতনা ফিরে পেলেন গোর্কি। প্রথাগত রচনার ধারাকে বাদ দিয়ে শুরু হল তার নতুন পথে যাত্রা। সমাজের নিচুতলার মানুষেরা চোর,লম্পট,ভবঘুরে তামাল, গণিকা, চাষী,মজুর,জেলে সারিবদ্ধভাবে মিছিল কর প্রকাশ পেতে থাকে তার রচনায়। এই পর্বের বিখ্যাত গল্প হল মালভা, বুড়ো ইজেরগিল, চেলকাশ, একটি মানুষের জন্ম,। গল্পগুলির মধ্যে একদিকে যেমন ফুটে উঠেছে নিচুতলার মানুষের প্রতি তার গভীর মমতা অন্যদিকে অসাধারণ বর্ণনা, কল্পনা আর তার সৃজনশক্তি। এই সব লেখাগুলি বেশির ভাগ ছাপা হয়েছিল ভলগা তীরের মফস্বলী পত্রিকায় স্থানীয় মানুষ, কিছু লেখক সমালোচক তার রচনা পড়ে মুগ্ধ হলেন। তখনো যশ খ্যাতি পাননি গোর্কি। ১৮৯৮ সালে তার প্রবন্ধ ও গল্প নিয়ে একটি ছোট সংকলন প্রকাশিত হল। সংকলনের নাম দেওয়া হল “রেখাচিত্র ও কাহিনী। এই বই প্রকাশের সাথে সাথে গোর্কির চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। সেই সময় রাশিয়ার প্রধান সহিত্যিক ছিলেন চেখভ,তলস্তয়। তাদের সাথে গোর্কির নামও উচ্চারিত হতে থাকে।
এক বছর পর প্রকাশিত হল গোর্কির প্রথম সার্থক উপন্যাস”ফোমা গর্দেয়ভ (১৯৯০)। একই সময়ে প্রকাশিত হল তলস্তয়ের উপন্যাস “রেজারেকসন”। দুটি উপন্যাসই রাশিয়ার মানুষের কাছে অসম্ভব জনপ্রিয় হয়ে উঠল। গোর্কির রচনার বাস্তবতা ,তার জীবনধর্মিতা। নিপীড়িত অবহেলিত মানুষের প্রতি সমবেদনা, মমতা, স্বভাবতই রুশ শাসকদের বিচলিত করে তুলল। তার আগে সমাজ জীবনকে এমন নির্মম ভাবে কেও প্রকাশ করেনি। গোর্কিকে বন্দী করা হল। কর্তৃপক্ষ চেয়েছিল কোন মিথ্যা অজুহাতেতাকে শাস্তি দিতে। কিন্তু প্রমানের অভাবে তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হল।
দেশে জুড়ে বিপ্লবী আন্দোলন ক্রমশই ছড়িয়ে পড়ছিল। ১৯০১ সালগোর্কি তখন ছিলেন সেন্ট পিটসবার্গ শহরে। একদিন ছাত্ররা বিক্ষোভ প্রদর্শন করছিল। পুলিশ তাদের উপর গুলি চালাল। অনেক নিহত হল। অসংখ্যছাত্র আহত হল। এর প্রতিবাদে গোর্কি লিখলেন কবিতা” ঝোড়ো পাখির গান”।
ঝড়ের গান ছড়িয়ে পড়ল হাজার হাজার মানুষের মুখে। গোর্কির কবিতা যেন বিপ্লবের মন্ত্র। গোর্কিকে আটক করা হল। এখন আর তিনি নিজনি অভগোরদ শহরের এক সামান্য কারিগর নন, রাশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক। তাকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে দেশ জুড়ে ঝড় উঠল। তাদের মুখপত্র হলেন স্বয়ং তলস্তয়। জারের কর্মচারীরা তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হল। ক্রমশই গোর্কি পরিচিত হয়ে উঠছিলেন লেনিনের আদর্শ তার মতবাদে। তিনি হয়ে উঠলেন মানবিকতার সমস্যায় গভীর আলোড়িত এক শিল্পী। বহু বিপ্লবী নেতাই তার সাথে সাক্ষাতের জন্য আসত। গোর্কি নিয়মিত তাদের সাথে যোগাযোগ করতেন।তিনি ছিলেন জার কর্তৃপক্ষের চোখে এক বিপদজনক ব্যক্তি। তাকে নির্বাসিত করা হল আরজামাস নামে একটা ছোট শহড়ে। গোর্কি অসুস্থ হয়ে পড়ল। তলস্তয় দেশের বুদ্ধিজীবীরা সম্মিলিতভাবে আবেদন জানালেন। তাদের চেষ্টায় গোর্কিকে পাঠানো হল ক্রিমিনাল স্বাস্থ্যকেন্দ্রে।
চেখভের উৎসাহে নাটক লেখা শুরু করলেন। প্রথম কূপমন্ডক (১৯০১)। এর পর লিখলেন (লোয়ার ডেপথ) যা তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটক। এই নাটকের বাণী সেদিন শুধু রাশিয়া নয় ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র ইউরোপে। গোর্কি নাম ছড়িয়ে পড়ল দেশে দেশে।
১৯০৫ সালে দেশ জুড়ে দেখা দিয়েছিল দুর্ভিক্ষ খরা। হাজার হাজার ক্ষুধার্ত মানুষ জারের প্রাসাদ অভিমুখে যাত্রা করল। জারের দেহরক্ষীরা নির্মম ভাবে গুলি চালিয়ে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করল।
এর বিরুদ্ধে কলম ধরলেন গোর্কি। তিনি সারসরি দেশের মানুষের এই দুরবস্থার জন্য দায়ী করলেন জারকে। ক্ষুদ্ধ জারের আদেশে তাকে বন্দী করে রাখা হল কারা দূর্গে। এবার শুধু রাশিয়া নয় প্রতিবাদের ঝড় উঠল সমগ্র ইউরোপে, ইউরোপের শ্রেষ্ঠ মানুষেরা প্রতিবাদ জানালো। তাদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে গোর্কিকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হল জার সরকার।
শ্রমিক আন্দোলন বেড়ে চলছিল। দেশজুড়ে বিপ্লবের ব্যর্থ চেষ্টা হল।
আবার গোর্কিকে গ্রেফতার করার পরিকল্পনা করা হল। গোপন সূত্রে সংবাদ পেয়ে বিদেশে পাড়ি দিলেন। জার্মানী ফ্রান্স হয়ে আমেরিকায়। এখানেই শুরু হল তার বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাস “মা”। জারের অত্যাচারের ভয়ে এই বই প্রথমে প্রকাশিত হয় ইংরেজী অনুবাদ (১৯০৬)। এ যাবৎ কম বেশি প্রায় ৩০০ সংস্করন বার হয়েছে। এর থেকেই বোঝা যায় মা উপন্যাসখানি পৃথিবী জুড়ে কি বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। মা ছাড়াও গোর্কি আরো অনেকগুলি উপন্যাস লিখেছিলেন। দুঃখী পাভেল, গ্রীষ্ম ত্রয়ী। তার আত্নাজীবনীমূলক তিনটি উপন্যাস আমার ছেলেবেলা (১৯১৩) পৃথিবীর পথে (১৯১৫) পৃথিবীর পাঠশালায় (১৯২৩)। নিজের জীবনের শৈশব কৈশোর কালের প্রতিটি ঘটনাকে নিপুন শিল্পীর মত যেন রঙের তুলিতে একেছেন। বাস্তবাতর সাথে মানবতার এমন সংমিশ্রন বিশ্বসাহিত্যে বিরল। জীবনের শেষ পর্যায়ে লেখেন “ক্লিম সামগিনের জীবন”
জীবনের শেষ হয়ে আসছিল। কিন্তু জীবন থেকে মুহূর্তের জন্যেও তিনি দুরে সরে যাননি, ইউরোপের বুকে একদিকে কমিউনিজম বিরোধী আন্দোলন, অন্যদিকে জার্মানীতে ফ্যাসিবাদের উদ্ভব –নিজের গভীর দূর দৃষ্টি দিয়ে গোর্কি অনুভব করেছিলেন এর আসন্ন বিপদ, শয্যাশায়ী অবস্থাতেও তিনি দেশবাসীকে সতর্ক করেছিলেন। মৃত্যুর আগের মুর্হূতে (১৮জুন ১৯৩৬) তার কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছে ‘যুদ্ধ আসছে তোমরা তৈরি থেকো’।
কয়েক বছরের মধ্যেই তার কথা সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল।
** লেখাটি মাইকেল এইচ হার্টের অ্যা র্যাংকিং অব দ্য মোস্ট ইনফ্লুয়েনশিয়াল পারসনস ইন হিস্টরি বই থেকে নেওয়া।
/ এআর /