ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪

রেনেসাঁ’র দেশে (ষষ্ঠপর্ব)

শামীম আরা খানম

প্রকাশিত : ২২:১০, ২৮ আগস্ট ২০২০

দেবর রহিম ভেনিস থেকেই আরেজ্জো চলে গেছে নিজের বাসায় বাচ্চার স্কুল খোলা তাই। কাজিন মুঈন আমাদের সাথে মিলান যাচ্ছে শুধু আমাদেরকে সংগ দিতে। ভেনিসের মেস্ত্রে থেকে ট্রেনে করে আমরা মিলান-এর উদ্দেশ্যে সকাল সাড়ে ৮টায় রওনা হয়ে বেলা ১১টায় মিলানে পৌঁছেছি। মেস্ত্রে রেল স্টেশনে মামা ও অন্য কাজিনরা সবাই বিদায় জানতে এসেছিলো। অন্যরকম একটি আবেগঘন পরিবেশের মধ্যে আমরা ট্রেনে উঠেছিলাম।

আরেক দেবর মাহতাব এসে আমাদেরকে মিলান স্টেশন থেকে ওর বাসায় নিয়ে গেলো। ওর বউ জোহরা আর দুই মেয়ে নিয়ে ওখানে আছে প্রায় ২০ বছর। জোহরা খুব ভালো একজন রাঁধুনি। ওখানে খাওয়া দাওয়া করে ওর বাসার ১০০ গজ দূরেই একটা হোটেলে উঠেছি। বিকেলে হোটেলের কাছাকাছি এলাকায় ঘুরে বেড়িয়েছি। 

মিলান ইউরোপ তথা সমগ্র বিশ্বের অন্যতম একটি ফ্যাশনের শহর। এটি ইতালির উত্তরে অবস্থিত লোম্বার্ডির রাজধানী। রোমের পর এটিই ইতালির সবচেয়ে বড় শহর। মিলান ইতালির শিল্প বাণিজ্য ডিজাইন ও ফ্যাশন-এর শহর। বিশ্বের নামীদামি সব ব্র‍্যান্ড-এর পোশাক বেশিরভাগই এই শহরে তৈরী হয়। এই শহরকে ইতালির বাণিজ্যিক রাজধানীও বলা হয়। গাড়ি থেকে শুরু করে সব ধরনের ফেব্রিকস, কসমেটিকস-এর কারখানা এই শহরে অবস্থিত। 

ইতালির বিখ্যাত অপেরা লা স্কালা এই শহরেই অবস্থিত। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির বিখ্যাত ছবি "দ্যা লাস্ট সাপার" এই শহরের সান্তা মারিয়া দেলে গ্রাজি-এর ডাইনিং হলের পিছনের দেয়ালে লাগানো আছে। বর্তমান বিশ্বে মিলানকে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী শহর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। পুরো মিলান শহর জুড়ে অসংখ্য দর্শনীয় স্থান আছে কিন্তু সময় স্বল্পতার দরুন আমাদের এই ভ্রমণে অনেক কিছুই বাদ দিতে হয়েছে। বিখ্যাত দুই একটা জায়গায় গিয়েছিলাম। তার মধ্যে অন্যতম ছিলো- পিয়েজা ডেল ডুমো এবং ভিটোরিও ইমানুয়েল গ্যালারী। 

যেবার আমরা মিলান গেলাম সে বছর মিলান শহরের "রো ফেরো" নামের এক স্থানে ওয়ার্ল্ড এক্সপো ফেয়ার হচ্ছিলো। যেখানে সারা বিশ্বের সব দেশ থেকেই এক বা একাধিক প্রতিনিধি একটি করে স্টল স্থাপন করে নিজেদের দেশীয় পণ্যের বিপনন কাজ করছিলো। এই "বিশ্ব রপ্তানি বাণিজ্য মেলা" ছ'মাস স্থায়ী হয়। সেই বছর মিলান ছিলো দ্বিতীয়বারের মতো এই মেলার আয়োজক।

প্রথমদিন সকালে উঠে হোটেলে হালকা নাস্তা করে দেবরের বাসায় ভারী নাস্তা (পরোটা, গরুর মাংস, সব্জি, হালুয়া) খেয়ে কিছুটা সময় ঘুমিয়ে কাটালাম। কারণ ভ্রমণের ক্লান্তিতে সবাই ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলাম। আর ঠিকমতো খাওয়া আর ঘুম না হলে হরিষে বিষাদ নেমে আসতে সময় নিবে না। দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ করে বের হলাম মিলান এক্সপো দেখতে। বিশেষ ট্রেনে করে ওখানে যেতে হয়েছিল। এই ট্রেন শুধুমাত্র এই এক্সপোর জন্যই নির্ধারিত। আর এই রেললাইনও আগে ছিলো না, নতুন করে এরা এটা বানিয়েছে শুধু এই বিশাল এক্সপোর জন্য। কি না পারে ইতালীয়রা! আমার কন্যাত্রয় খুব খুশি এই এক্সপো দেখার ব্যাপারে। 

আমার আরও এক মামা মিলানে থাকেন। তার সাথে আমার ২৬ বছর পর দেখা। সবাই ট্রেনে উঠেছি খুব নিশ্চিন্ত মনে নির্দিষ্ট গন্তব্যে "রোফেরো" এর টিকেট নিয়েই। গন্তব্যে নামতেই হঠাৎ টিকেট চেকার এসে আমাদের পথ আগলে টিকিট দেখতে চাইলেন। আমরা সবাই টিকেট দেখাতেই ইতালির ভাষায় যা বললেন তার সারমর্ম এই যে- আমরা "রোফেরো" স্টেশন (যেখানে মেলা হচ্ছিলো)-এর টিকেট না কেটে তার আগের স্টেশনের টিকিট কেটেছিলাম। অতএব আমাদের সাতজনকে মাইলেজ হিসেবে জরিমানা দিতে হবে।

বিদেশ ভ্রমণে এসে জরিমানা একটা লজ্জার ব্যাপার। পরে অবশ্য আরফান বাড়তি অর্থটুকু দিয়ে সে যাত্রায় সব সমাধান করেছিলো। কিন্তু ওইটুকু সময়ে আমাদের যে হৃদকম্পন হয়েছিলো সেটা শুধু আমরাই বলতে পারবো। কারণ ওইসব দেশে আইন অমান্যকারীর সাজা তাৎক্ষণিক জেল। বাচ্চাদের মানসিক অবস্থাও যে কি ছিলো, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। আসলে আমার কাজিন বা দেবর কেউই বুঝতেই পারেনি যে, টিকিট ছিল আগের স্টেশনের।

মেলায় প্রবেশের টিকিট মূল্য ছিলো বিদেশিদের জন্য ৫০ ইউরো আর স্থানীয়দের কার্ড দিয়েই সব হয়ে যায়। টিকেট কাউন্টারে ভীড়-এর অবস্থা দেখে ভেবেছিলাম বুঝি আজকে মেলা দেখা হবে না! কিন্তু ওদের সুচারু ব্যবস্থাপনায় মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যেই সোনার হরিণ টিকিট আমাদের হাতে এসেছিলো। কারণ আমরা ছিলাম সংখ্যালঘু এশিয়ার দর্শনার্থী, যাদের টিকেট কাউন্টার খাঁ খাঁ করছিলো। মেলায় প্রবেশের পথ অত্যন্ত কঠোর নিরাপত্তা বলয়ে আবৃত ছিলো। ছবি তুলতে চাইলাম কিন্তু সেটাও নিষিদ্ধ ছিলো। কয়েক স্তরের চেকিং পর্ব শেষ করে তবেই প্রবেশের অনুমতি মিলেছিল। 

মেলার আয়তন ছিলো প্রায় দশ কিলোমিটার। আমরা সবাই মিলে পুরো মেলার ৮০% স্টল দেখেছি। পুরো পৃথিবীর কয়েক'শ স্টল ছিলো। এক একটার চেয়ে একেকটা সুন্দর ডেকোরেশন করা। দেখেই মন জুড়িয়ে যায়। লন্ডন, আমেরিকা থেকে শুরু করে সুদান, ইথিওপিয়া- সব দেশেরই স্টল ছিলো। 

তাইওয়ানের একটি স্টল থেকে কিছু হ্যান্ডিক্রাফট-এর জিনিস কিনেছিলাম। মেলায় বাংলাদেশের একটি স্টলও ছিলো। সেখানে অনেক রপ্তানিযোগ্য পণ্যের সাথে প্রাণ-এর পণ্য দেখে খুব উৎফুল্ল হয়েছিলাম। দেশের এক টুকরো মাটিও যেনো বিদেশে দেখতে আনন্দ লাগে। মনে হয় কেমন যেনো একটা মায়া জড়িয়ে আছে। এই মায়ার টানেই ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বলেছিলেন-
"কতরূপ স্নেহ করি, দেশের কুকুর ধরি, বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া"!

চলবে... (পরের পর্বে সমাপ্য)।

লেখক: বেসরকারি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা

এনএস/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি