রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান কি চীন দিতে পারবে?
প্রকাশিত : ১৯:৪৩, ২৫ আগস্ট ২০২৩
২০১৭ সালে রাখাইনে মিয়ানমারের সামরিক অভিযানের পর বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় আট লাখের বেশি রোহিঙ্গা। তবে রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পর ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে কোন সফল পদক্ষেপ আসেনি। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে এ পর্যন্ত যতগুলো বড় পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তার প্রতিটিতেই সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে চীন।
এখন চীন এই সমস্যার সমাধান করতে ভূমিকা রাখতে পারবে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এজন্য যেসব কঠোর পদক্ষেপ ও প্রভাব মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বেইজিংকে নিতে হবে তা চীন চাইবে কিনা সেটিই একটি বড় প্রশ্ন।
তাদের মতে, ছোট ছোট পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে অল্প কিছু রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর মতো পদক্ষেপ নেয়ার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। এ ধরণের পদক্ষেপের মাধ্যমে চীন আসলে মিয়ানমারের একটা ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে মাত্র।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেন, চীনের ভূমিকাকে ছোট বা বড় করে দেখার কোন সুযোগ নেই। এটাকে স্বাভাবিকভাবেই দেখতে হবে। কারণ সংকট সমাধানে বাংলাদেশ সব সুযোগই কাজে লাগাতে চায়।
“সব দেশের সাথেই বাংলাদেশ যেতে চায়, সব এভিনিউ এক্সপ্লোর করতে চায়, ওইটাও একটা পসিবিলিটিস, ওইটাও দেখছে,” বলেন তিনি।
চীনের মধ্যস্থতায় এ পর্যন্ত কমপক্ষে তিনটি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে, যেগুলোর কোনটিই সফল হয়নি। আর আরেকটি উদ্যোগ নিয়ে এখনো আলোচনা চলছে।
যেসব উদ্যোগ এসেছে
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে মিয়ানমারে ক্ষমতাসীন অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন বেসামরিক সরকার বাংলাদেশের সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছিল। মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠ মিত্র চীনের মধ্যস্থতাতেই সেই চুক্তি হয়েছিল। তখন চীনের তরফ থেকে বারবার বলা হয়েছে, মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরিবর্তে দুই দেশের আলোচনার ভিত্তিতে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করা উচিত।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক অবশ্য বিবিসি বাংলাকে বলেছেন যে, চীনের মধ্যস্থতায় এখনো পর্যন্ত কোন চুক্তি হয়নি।
তিনি বলেন, ২০১৭-১৮ সালে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে যে চুক্তিটি হয়েছিল সেটি পুরোপুরি দ্বিপক্ষীয় একটি বিষয় ছিল। মিয়ানমারের সাথে আলোচনা করেই বাংলাদেশ সেই চুক্তিটি করেছিল। সেখানে কারো কোন চাপ বা মধ্যস্থতা ছিল না।
“ওইটা একেবারেই দ্বিপাক্ষিক উদ্যোগ ছিল, কারো কোন হস্তক্ষেপ বা চাপ ছিল না, চীনের তো না-ই।”
তিনি জানান, ২০১৮ সালে চীন মধ্যস্থতা করার একটি প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল যেটি নিয়ে এখনো আলোচনা চলছে।
“চীনের মধ্যস্থতায় যেটার(চুক্তি) কথা বলা হচ্ছে সেটা কিন্তু বাইল্যাটারাল অ্যাগ্রিমেন্টের উপরেই দাঁড়িয়ে আছে।”
২০১৮ সালের ১৫ই নভেম্বরের মধ্যে রোহিঙ্গাদের প্রথম দলটিকে মিয়ানমারে নিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও সেটি আর বাস্তবে আলোর মুখ দেখেনি।
এরপর ২০১৯ সালে অগাস্টে চীনের তরফ থেকে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর আরেকটি উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু নাগরিকত্বের বিষয়টি সুরাহা না হওয়ায় রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় যেতে চায়নি।
আর সবশেষ চলতি বছরের জানুয়ারিতে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে একটি পাইলট প্রকল্পের বিষয়ে বাংলাদেশের সাথে আলোচনা শুরু করে চীন। এপ্রিলে এ নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন এবং পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সাথে আলোচনা করতে ঢাকা সফর করেন চীনের বিশেষ দূত দেং সি জুন।
সে ধারাবাহিকতায় এপ্রিলেই কুনমিংয়ে একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে অংশ নেন বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
এর আওতায় একটি পাইলট প্রকল্পের অধীনে ১১৭৬ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয়ার প্রস্তাব তোলা হয়। একটি রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদল মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গিয়ে সেখানকার বসবাসের ব্যবস্থাপনা ঘুরে দেখে আসার পর সন্তুষ্টি প্রকাশ করেনি।
পরের মাসে অর্থাৎ মে-তে মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধিদল কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের সাথে দেখা করে। তবে সেই পাইলট প্রকল্প কবে থেকে চালু হবে সে বিষয়ে এখনো কোন তথ্য জানা যায়নি।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেন, ২০১৭ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী বছরগুলোতে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে ভূমিকা রাখার জন্য বিশ্বের প্রায় সব দেশকেই আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আমেরিকা, ভারত, চীন।
তবে সেসময় বাংলাদেশের এই আহ্বানে চীন ছাড়া অন্য কোন দেশ সাড়া দেয়নি।
“চীন এগিয়ে এসছে, অন্যরা ঠিক ওইভাবে কোন কংক্রিট টাইপ অব রোল নিয়ে এগিয়ে আসেনি। এই প্রস্তাবটা বাংলাদেশ সবাইকেই করে। ইনফ্যাক্ট এখনো করে।”
চীন কতটা সমাধান দিতে পারবে?
চীনের উদ্যোগের বিষয়ে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বিবিসি বাংলাকে বলেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীন যেভাবে তৎপরতা দেখাচ্ছে তাকে স্বাগত জানানোই যায়। এটা নিঃসন্দেহে ভাল উদ্যোগ। কারণ তারা রোহিঙ্গা সংকট সমাধান করতে পারবে না সেটি বলা যাবে না।
তবে চীন যেভাবে এখন মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন সরকারের ইচ্ছানুযায়ী পাইলট প্রকল্প করে তাদের ভাবমূর্তির উন্নয়নে যেভাবে সমাধান চাইছে, তাতে এই সংকটের টেকসই সমাধান আসবে না।
বরং টেকসই সমাধান আনতে হলে এই সংকটের সাথে আরো যেসব অংশীদার রয়েছে তাদের অংশগ্রহণও নিশ্চিত করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
তার মতে, মিয়ানমারের ভেতরে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সম্মানজনক উপায়ে তাদের ফেরত যাবার মতো পরিবেশ নিশ্চিত করা না গেলে পাইলট প্রকল্পের সুফল পাওয়া যাবে না। এর উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, কিছুদিন আগে মিয়ানমারে যে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলটি সেখানে স্থাপিত শিবির পরিদর্শনে গিয়েছিল তারা ফিরে এসে আস্থা প্রকাশ করেনি।
“রোহিঙ্গাদের যারা এই সমস্যার মূল কেন্দ্রবিন্দু যাদের যাওয়াটাই আমরা সকলে মিলে চেষ্টা করছি, তারা যদি স্বস্তি না পায়, তারা যদি ওখানে গিয়ে টেকসইভাবে আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচবার নিশ্চয়তা না পায়, তাহলে আমরা দুইপক্ষ-তিনপক্ষ মিলে যত আয়োজনই করি, সেটার সফলতা কতটা পাবে সে প্রশ্ন তো থেকেই যায়,” বলেন হুমায়ুন কবির।
চীনের উদ্যোগের সীমিত উপযোগিতা আছে বলে মনে করেন তিনি। তবে এটি নিয়ে প্রশ্ন থাকার কারণে পশ্চিমের দেশগুলো বলছে যে, চীন এখন যেভাবে চেষ্টা করছে এতে করে এই সমস্যার সমাধান হবে না।
মিয়ানমার নিয়ে এপর্যন্ত জাতিসংঘে বিশেষ করে এর নিরাপত্তা পরিষদে যত প্রস্তাব উঠেছে তার প্রায় সবগুলোই ঠেকিয়ে দিয়েছে মিয়ানমারের দুই বন্ধু দেশ রাশিয়া ও চীন।
হুমায়ুন কবির বলেন, মিয়ানমারের উপর যদি এখন কোন দেশের প্রভাব থেকে থাকে তাহলে সেটা চীনের আছে। কিছুটা প্রভাব রাশিয়ারও আছে। তবে সেটা চীনের তুলনায় কম। ভারতেরও কিছুটা প্রভাব মিয়ানমারে আছে বলে মনে করা হয়।
তাঁর মতে, মিয়ানমারের নীতিগত অবস্থার পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এখনো চীনের একটা শক্ত ভূমিকা আছে এবং তারা ইচ্ছা করলে সেটা করতে পারে। তবে চীন মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠীর উপর চাপ প্রয়োগ করে তাদের বিরাগভাজন হতে চাইবে কিনা সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
“তবে এখন কথা হচ্ছে যে, সেই জায়গায় যে পরিমাণ চাপের দরকার হবে বা প্রভাবের দরকার হবে সে জায়গায় চীন যেতে আগ্রহী কিনা কারণ তার কিছু মৌলিক কৌশলগত বিষয় মিয়ানমারের সাথে জড়িত আছে,” বলেন মি. কবির।
রোহিঙ্গা সংকট সমাধান বেশ কঠিন উল্লেখ করে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেন, যেসব রোহিঙ্গা ফিরে যাবেন তাদের সংখ্যাটা কত সেটার উপরেই নির্ভর করবে যে, এই সংকটের সমাধান হবে কিনা।
“১৩০ জনকে নিয়ে তোর পুরো সমস্যার সমাধান হবে না।”
এই সমস্যার সমাধান আনতে হলে এর সাথে জড়িত অংশীদারদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে একটি চুক্তির মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। কোন একটি পক্ষ নিয়ে এগিয়ে গেলে সেটা দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই সমাধান আনবে না বলে মনে করেন তিনি।
এছাড়া মিয়ানমারে ক্ষমতার পালাবদল হয়ে জান্তা সরকারের পরিবর্তে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসলে পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
একই সাথে আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যা নিয়ে যে মামলা চলছে সেটার রায় আসলে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে একটি সম্ভাবনার দ্বার খুলতে পারে।
তবে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে মিয়ানমারের জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করে নিয়ে যাবে এমন আসা খুবই কম বলে মনে করেন শহীদুল হক।
উল্লেখ্য ২০২২ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রথমবারের মতো মিয়ানমার নিয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই প্রস্তাবে দেশটির রাজনৈতিক নেত্রী অং সান সুচিসহ সব রাজবন্দীর মুক্তির আহ্বানের পাশাপাশি রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের বিষয়টিতে গুরুত্ব দেয়া হয়।
ওই প্রস্তাবটিতে ১২টি দেশ ভোট দেয় এবং বিপক্ষে কোন দেশ ভোট দেয়নি। এই ভোটাভুটিতে মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠ দুই মিত্র রাশিয়া ও চীন ভোট দেয়া থেকে বিরত থেকেছে। ভোট দেয়নি ভারতও।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক মনে করেন, এখানে রোহিঙ্গা সংকটের ভবিষ্যতে নিয়ে একটা আলো দেখা যাচ্ছে। একই সাথে রোহিঙ্গা ইস্যুতে পশ্চিমা বিশ্ব সব সময়ই বাংলাদেশের পক্ষে ছিল এবং এখনো আছে বলেও মনে করেন তিনি।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
এসবি/