ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

লক্ষ্য কি শুধুই বিসিএস?

আবদুল্লাহ আল ইমরান

প্রকাশিত : ১৫:৫৮, ৭ এপ্রিল ২০১৮ | আপডেট: ২০:২০, ৮ এপ্রিল ২০১৮

ক্যাম্পাসের এক জুনিয়রের সঙ্গে দেখা।

জানতে চাইলাম, পড়াশোনার বাইরে আর কী করো? বললো, একদম সময় পাই না ভাইয়া।

- সময় পাওনা কেন?

- ডিপার্টমেন্টে পড়ার চাপ। লাইব্রেরিতে বিসিএসের পড়াশোনা। সপ্তাহে তিনদিন আইএমএলে ফ্রেঞ্চ ভাষা শেখার ক্লাস। দুটো টিউশনি। সামনের সপ্তাহ থেকে এক ভাইয়ের কাছে জব ম্যাথ শুরু করবো ভাবছি।

আমি অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মাত্রই থার্ড সেমিস্টারে পড়ে। চোখেমুখে লেগে আছে মফস্বলের ছোঁয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশালতা অনুভবের এই তো শ্রেষ্ঠ সময়। অথচ কে বা কারা এই বয়সেই ছেলেটার মধ্যে জাগতিক হিসাব-নিকাশ ঢুকিয়ে দিয়েছে!

চারপাশে এমন ছেলে-মেয়ের সংখ্যাই দিন দিন বাড়ছে। এদের জন্যে মায়া হয় আমার। পাশ করে কী করবে, কোনদিকে আগাবে- বৈষয়িক এমন তাড়নায় এরা না পারে ক্যাম্পাস উপভোগ করতে, না পারে জীবনের ফোকাস ঠিক করতে। মাঝখান দিয়ে চলে যায় বসন্তের দিন, বুকের গহীণে জমা হতে থাকে হতাশা।

বড় জানতে ইচ্ছে করে, বিশ্ববিদ্যালয় জীবন মানে কী ক্লাসের পড়াশোনা বাদ দিয়ে কেবল বিসিএস বা চাকরির প্রস্তুতি নেয়া? দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ইতিহাস কী তাই বলে?

আমি জানি অপরাজেয় বাংলার সামনে দাঁড়িয়ে এদের অনেকেই কোনদিন অনুভব করতে পারেনি মুক্তিযুদ্ধের সুবিশাল মহত্ত্ব। কার্জন হল কিংবা মধুর ক্যান্টিনের সামনে দিয়ে হেঁটে যাবার সময় ঐতিহাসিক অনুভূতিতে কখনোই শিউরে ওঠেনি শরীর!

অথচ ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচার পতনসহ জাতির সকল ক্রান্তিকালেই কী গৌরাবান্নিত অবদানই না রেখে গেছে এদের পূর্বসূরিরা!

পড়াশোনার ফাঁকে ফুলার রোডের আড্ডা, চারুকলায় জলের গান, টিএসসিতে সংগঠন করাকে অনেকের কাছেই সময় নষ্ট মনে হয়। এদের কাছে জীবনের মানে দিন শেষে নিজেকে ভালো চাকুরে হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। সুশান্ত পালরা সুনিপুন ভাবে বিসিএসের মাপকাঠিতে সাফল্য মাপতে শিখিয়ে দিয়েছে এদের। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার মানে এখন বিসিএস প্রিপারেশন, আইইএলটিএস, সাইফুরস ম্যাথ শেষের তাড়াহুড়ো। হলের লাইব্রেরিগুলোতে ক্লাসের পড়ার বদলে চাকরির পড়াশোনার মচ্ছব।

অথচ ক্লাস শেষে টিএসসিতে বন্ধুর মায়ের জন্য সাহায্যের টাকা তুলে, সন্ধ্যায় মল চত্ত্বরে ফুটবল খেলে, মধ্যরাতে পলাশীতে সমবেত কন্ঠে গান গেয়ে, ভোর হয় হয় রাতে যে ছেলেটাকে হলে ফিরতে দেখি ওর মধ্যেও আমি জীবনের ভিন্ন মানে খুঁজে পাই। যে ছেলেটা নিজের রক্ত দিয়ে অন্যের জীবন বাঁচায়, যুক্তির ঝড় তোলে বিতর্কের মঞ্চে, তার ভেতরে বেঁচে থাকতে দেখি সমাজ বদলের আশাগুলোকে।

সবাই কী ক্লাসে ফার্স্ট হতে কিংবা ফার্স্ট ইয়ার থেকেই চাকরির প্রস্তুতি নিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে? সবার সাফল্যের আইকন কি বিসিএস ফার্স্ট?

কেউ কেউ তো জীবনের বহুরঙা ভিন্ন মানেও খুঁজে নেয়। ভরা পূর্ণিমায় বেরিয়ে পড়ে জোছনা স্নানে। হেমন্তের সন্ধ্যায় খোঁজে শিউলি ফুলের ঘ্রাণ। শুধু বিসিএস কোচিং নয়, কারো কারো বুকের ভেতর তো নির্ঘুম জাগে অন্নহীন পথশিশুদের ভাগ্যবদলের স্বপ্নও। বিশ্বাস করো, দিনশেষে ওই ছেলেগুলোকেও আমি ব্যর্থ হতে দেখিনি।

জীবন এক বৈচিত্র্যময় অনুভূতির অ্যালবাম।

টুকরো টুকরো গল্প, রঙ-বেরঙের স্মৃতি তাতে পূর্ণতা দেয়। সায়াহ্নে এসে সাবারই একবার উঁকি দিতে ইচ্ছে হয় অ্যালবামটাতে। ফেলে আসা পুরনো দিন দেখে কেউ তৃপ্তির নি:শ্বাস ফেলে, কারো আবার ঝরে আফসোসমাখা দীর্ঘশ্বাস...!

প্রিয় অনুজ,

জীবনের স্মৃতির অ্যালবামটা কতটা বর্ণিল গল্পে সাজাবে, এ সিদ্ধান্ত তোমার। মনে রেখো, চলে যায় বসন্তের দিন, চলে যায় স্মৃতি তৈরীর শ্রেষ্ঠ সময়...!

লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক

এসএ/

 


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি