ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪

লাল বোট আর আমাদের মাফিয়ারা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৮:৩৮, ৩ এপ্রিল ২০১৮ | আপডেট: ১০:২৮, ৪ এপ্রিল ২০১৮

গতবছরের ২ এপ্রিল চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ চ্যানেলে লালবোট ডুবে নিহত হন ১৮ জন। চট্টগ্রাম থেকে সন্দ্বীপ থেকে যাতায়াতের জন্য  সবচেয়ে সহজ ও আনুষ্ঠানিক রুট হচ্ছে কুমিরা-গুপ্তছড়া ফেরিঘাট। দুর্ঘটনার পর এই ঘাটের একজন ইজারাদারের সাক্ষাৎকার থেকে বুঝা যায় এ দুর্ঘটনার জন্য সন্দ্বীপের একজন প্রভাবশালী রাজনীতিক দায়ী। এতো বড় দুর্ঘটনার পর, ঘাটে যাত্রী পারাপারে কোন পরিবর্তন হয়নি এখনো। এ বিষয়ে প্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক সোহেল মাহমুদের ফেসবুক থেকে নেওয়া পোস্টটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

১. লালবোট দুর্ঘটনার কথা মনে আছে?

আরো পরিষ্কার করে বলি, সন্দ্বীপের বাইরের বাসিন্দা জন্য। সন্দ্বীপ চ্যানেলে ২০১৭ সালের ২ এপ্রিল লালবোট ডুবে ১৮ জন মারা গিয়েছিলো। আজ সেটার একবছর হলো। এ ঘটনা যে প্রতিদিন, মাস কিংবা বছরে ঘটে তা কিন্তু নয়। অথচ এমন ঘটনা ঘটে যাবার আশঙ্কা নিয়ে প্রতি মুহূর্তে সন্দ্বীপ চ্যানেল পাড়ি দিতে হয় সন্দ্বীপবাসীকে। কেনো?

২. সন্দ্বীপে সাবমেরিন ক্যাবল দিয়ে বিদ্যুৎ যাচ্ছে। ভাঙ্গনরোধে দুশ` কোটি টাকারও বেশি ব্যয় হচ্ছে। জেটি হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নতুন ভবন হচ্ছে অগণিত। রাস্তা পাকা হচ্ছে মাইলের পর মাইল। উন্নয়ন আর উন্নয়ন। এবং এটাই সত্যি। অথচ, এখনো সন্দ্বীপের মানুষকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, অপমান সয়ে, নিপীড়িত হয়ে সাগর পাড়ি দিতে হয়। তাদের অর্থ যায়, প্রাণও যায় যায় করে। সব উন্নয়ন হয়। জেটিও হয়। কিন্তু, সিস্টেমের উন্নতি হয় না। কেনো?

৩. সন্দ্বীপ-চট্টগ্রাম যাতায়াতে সবচেয়ে সহজ ও আনুষ্ঠানিক রুট কুমিরা-গুপ্তছড়া ফেরিঘাট। আরো ঘাট থাকলেও ভৌগোলিকসহ নানা কারণে কুমিরা-গুপ্তছড়ার কদর বেশি। সেখানে নিপীড়নও বেশি। সেই ঘাট নিয়ে নানা কাহিনী। বলা হয়, পারাপারের ঘাটগুলো আসলে মাফিয়াচক্রের দখলে। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে অন্যান্য রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি, সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী এই চক্রের জালে থাকেন। কখনো কখনো তারা কেউ আবার সে চক্রেরই একজন হয়ে যান। এ এক আজব খেল!

ঘাট নিয়ে কোটি টাকার কাজকারবার প্রতিমাসে। সে টাকার ভাগ যায় প্রভাবশালী জনে জনে। সাধারণ মানুষের কষ্টে তাদের কি?  ফেরি ঘাটের সমস্যা জীবিত থাকলে আয় বেশি। সমস্যা শেষ হয়ে গেলে আয় যে শেষ!

৪. লাল বোট দুর্ঘটনার পর পরই আমরা "সন্দ্বীপ" পত্রিকায় কুমিরা-গুপ্তছড়া ঘাটের সন্দ্বীপ-চট্টগ্রাম যাতায়াতে সবচেয়ে সহজ ও আনুষ্ঠানিক রুট কুমিরা-গুপ্তছড়া ফেরিঘাট। প্রকাশ করি। তাতে তিনি সন্দ্বীপের একজন রাজনীতিককে ঘাটের আয় থেকে ৬৫ লাখ টাকা চাঁদা দেওয়ার কথা প্রকাশ করেছিলেন। রেকর্ড করা সেই সাক্ষাৎকার আবার শুনলাম আজ। তাতে মনে হলো, ১৮টি তাজা প্রাণ ঝরে যাবার পেছনে এই রাজনীতিকেরও দায় আছে। তার চাঁদাবাজির কারণে অর্থভুভুক্ষু ইজারার নিয়ম বা আইনের তোয়াক্কা করেন নি। দ্বিতীয়ত, চাঁদার অর্থ পুরোটায় জোগাড় হয়েছে যাত্রীদের পকেট কেটে। এতো বড় দুর্ঘটনার পর, ঘাটে যাত্রী পারাপারে কোন পরিবর্তন এসেছে? তাহলে, দাঁড়ালো কি?

৫. সরকারের অবহেলায়, জেলা পরিষদের দায়িত্বহীন আচরণের কারণে ১৮ জন মানুষ মরলো, অথচ তারা সরকারের সামান্য অনুকম্পা পেলো না। সাহায্য না। সংসদ সদস্য প্রতিশ্রুতি দিয়েও সেটি রাখেন নি। তিনি যেভাবে সাহায্য করার ক্ষমতা রাখেন, তার ধারে কাছেও যাননি নিহতদের সাহায্য করার বেলায়। পৃথিবীজুড়ে সন্দ্বীপীদের নানা চ্যানেলে নিহতদের পরিবারগুলোকে সহায়তা দেওয়ার জন্য সাহায্য তোলার খবর পেয়েছিলাম সে সময়। কিন্তু, সে সাহায্য কতটুকু তারা পেয়েছেন?

সে সময়ের সন্দ্বীপ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দুর্ঘটনার পর পর ব্যাংক হিসাব খুলে জামায়াতের একজন নেতার সহায়তায় সাহায্য সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আমি এ নিয়ে প্রশ্ন তোলায় তখন নানাজনের বিরাগভাজন হয়েছিলাম সত্যি, কিন্তু সেই চেষ্টা সেখানেই বন্ধ হয়ে যায়। আর বন্ধ হওয়ার আগে পর্যন্ত সময়ে, ফেসবুকের মাধ্যমে জামায়াত নেতার আহ্বানে কত টাকা ব্যাংকে জমা পড়ে, তা নিয়ে কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ইউএনও এ নিয়ে মুখ খোলেন নি। এ বিষয়ে একবছর পরে হলেও মুখ খোলা জরুরি।

নিহতদের পরিবারগুলো কী সাহায্য পেয়েছে, সেটাও জানানো জরুরি। অন্তত প্রতারণা আর প্রবঞ্চনা ঠেকানোর স্বার্থে। কারণ প্রতিশ্রুতি ছিলো অনেক! উদ্যোগও। সেটার ফল কি?

৬. আবেগ আর বাস্তবতা ভিন্ন ভিন্ন বিষয়। আবেগ উন্মাদনা তৈরি করে। বাস্তবতা উন্মাদনায় সব সময় পানি ঢেলে দেয়। বাস্তবতাকে বোঝার, মেনে নেওয়ার অনুশীলন করতে হবে আমাদের। সেটা এ মুহূর্তে খুব জরুরি। আমরা বিদ্যুৎ পাচ্ছি। অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থায় স্বর্ণযুগ পার করছি। সন্দ্বীপের ভেতরে আপনি আমি রাজার হালে থাকছি। কিন্তু, বাইরে যেতে?

প্রশ্ন অনেক। কিন্তু, সেগুলোর উত্তর দায়িত্ববান একজনও দেবেন না। কারণও খুব সোজা। গোটা সমাজটা দুষ্ট লোকদের দখলে। রক্ত চোষাদের স্বর্গরাজ্য। সেটা একটা চক্র। সব সুবিধাবাদীর ভীড়ে সেই চক্র এখন আমাদের, সাধারণ মানুষের বড় প্রতিপক্ষ। নানা সমীকরণে আমরাই তাদের বড় করি। বড় হতে দেই। তারা বড় হয়ে যায়। হয়ে যায় সংঘবদ্ধ একটা চক্র। মাফিয়া।

লেখক: সিনিয়র প্রবাসী সাংবাদিক


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি