‘লাল মিয়া’ থেকে এস এম সুলতান
প্রকাশিত : ০৯:২৩, ১০ আগস্ট ২০২১
চিত্রকর্মের স্বকীয়তায় যিনি ‘লাল মিয়া’ থেকে হয়ে ওঠেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব, তিনি মাটি ও মানুষের শিল্পী এস এম সুলতান। তার পুরো নাম শেখ মোহাম্মদ সুলতান। খ্যাতিমান এই চিত্রশিল্পীর ৯৭তম জন্মদিন আজ। ১৯২৪ সালের ১০ আগস্ট নড়াইলের মাছিমদিয়ায় বাবা মেছের আলী ও মা মাজু বিবির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন এসএম সুলতান। তবে নড়াইলবাসীর কাছে ‘লাল মিয়া’ হিসেবে সমধিক পরিচিত তিনি।
দারিদ্র্যতার মাঝে বেড়ে ওঠা সুলতান ১৯২৮ সালে নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। স্কুলের অবসরে রাজমিস্ত্রি বাবাকে কাজে সহযোগিতা করতেন এবং মাঝে মাঝে ছবি আঁকতেন শিশু সুলতান। ১৯৩৩ সালে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রাবস্থায় জমিদার শ্যামাপ্রাসাদ মুখোপাধ্যায়ের ছবি এঁকে তাক লাগিয়ে দেন। মুগ্ধ হন শ্যামাপ্রাসাদসহ নড়াইলের তৎকালীন জমিদাররা। পড়ালেখা ছেড়ে ১৯৩৮ সালে চলে যান ভারতের কলকাতায়।
চিত্রসমালোচক শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে তার (সুলতান) পরিচয় হয়। একাডেমিক যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও সোহরাওয়ার্দীর সুপারিশে ১৯৪১ সালে ভর্তি হন কলকাতা আর্ট স্কুলে। ১৯৪৩ মতান্তরে ১৯৪৪ সালে কলকাতা আর্ট স্কুল ত্যাগ করে ঘুরে বেড়ান এখানে-সেখানে। কিছুদিন কাশ্মীরের পাহাড়ে উপজাতিদের সাথে বসবাস এবং তাদের জীবন-জীবিকা ভিত্তিক ছবি আঁকেন সুলতান। ১৯৪৫ মতান্তরে ১৯৪৬ সালে ভারতের সিমলায় প্রথম একক চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় তাঁর। এরপর ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের লাহোরে তাঁর চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। উদ্বোধন করেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বোন ফাতিমা জিন্নাহ।
১৯৫০ সালে চিত্রশিল্পীদের আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে পাকিস্তান সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে আমেরিকা যান সুলতান। এরপর ইউরোপে বেশ কয়েকটি একক ও যৌথপ্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন তিনি। এ সময় বিখ্যাত চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসো, সালভেদর দালি, পল ক্লীসহ খ্যাতিমান চিত্রশিল্পীদের ছবির পাশে এসএম সুলতানের ছবি স্থান পায়। ১৯৫৩ সালে নড়াইলে ফিরে আসেন সুলতান। শিশু-কিশোরদের সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি চারুকলা শিক্ষার ব্যবস্থা করেন।
১৯৬৯ সালের ১০ জুলাই ‘দি ইনস্টিটিউট অব ফাইন আর্ট’ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। উদ্বোধন করেন যশোরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক ইনাম আহম্মদ চৌধুরী। ১৯৮৭ সালে স্থাপিত হয় ‘শিশুস্বর্গ’। অবশ্য অনেক আগেই স্বপ্নের শিশুস্বর্গ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন এসএম সুলতান। সুলতান তার সঞ্চিত অর্থ দিয়ে ১৯৯২ সালে ১০ লাখ মতান্তরে ১২ লাখ টাকা ব্যয়ে ৬০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৫ ফুট প্রস্থ বিশিষ্ট দ্বিতলা নৌকা তথা ভ্রাম্যমাণ শিশুস্বর্গ নির্মাণ করিয়েছিলেন। সুলতান তার শিল্পকর্মে খেটে খাওয়া মানুষ এবং সংগ্রামী জীবনের কথাই বেশি চিত্রিত করেছেন। রয়েছে পরিবেশ বন্ধু বৃক্ষরোপণের ছবিও।
চিত্রাঙ্কনের পাশাপাশি বাঁশি এবং সুরযন্ত্র বাজাতেও পটু ছিলেন তিনি। সুলতান বিষধর সাপ, ভল্লুক, বানর, খরগোশ, মদনটাক, ময়না, গিনিপিক, মুনিয়া, ষাঁড়সহ বিভিন্ন পশু-পাখি পুষতেন। সুলতান হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি পছন্দ করতেন না বলে জানিয়েছেন সুলতানশিষ্য চিত্রশিল্পী বলদেব অধিকারীসহ তার ভক্তরা।
চিত্রশিল্পের মূল্যায়ন হিসেবে ১৯৮২ সালে ‘একুশে পদক’, ১৯৮৪ সালে ‘রেসিডেন্ট আর্টিস্ট’ ১৯৮৬ সালে ‘বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ সম্মাননা’ এবং ১৯৯৩ সালে ‘স্বাধীনতা পদক’ পেয়েছেন এস এম সুলতান। এছাড়াও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার’, নিউইয়র্কের বায়োগ্রাফিক্যাল সেন্টার থেকে ‘ম্যান অব অ্যাচিভমেন্ট’ এবং এশিয়া উইক পত্রিকা থেকে ‘ম্যান অব এশিয়া’ পুরস্কার লাভ করেন তিনি।
অসুস্থ অবস্থায় ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই চিত্রশিল্পী। প্রিয় জন্মভূমি নড়াইলে চিরনিদ্রায় শায়িত হন মাটি ও মানুষের শিল্পী এস এম সুলতান।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান জানান, ‘মাটি ও মানুষের শিল্পী’ এসএম সুলতানের ৯৭তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে করোনা সংকটের কারণে সংক্ষিপ্ত পরিসরে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানের মধ্যে আজ মঙ্গলবার সকালে শিল্পীর সমাধিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ করা হবে। এরপর সংগ্রহশালা চত্বরে কোরআনখানি ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।
এএইচ/
আরও পড়ুন