শক্তিরূপেন, মাতৃরূপেন
প্রকাশিত : ১৭:৫৫, ১৭ অক্টোবর ২০১৮
দুর্গতিনাশিনী যে দেবী, তিনিই দুর্গা। দুর্গা মূলত শক্তির দেবী। শাস্ত্রমতে সর্বোচ্চ আরাধ্য দেবী। তন্ত্র ও পুরাণে দেবী দুর্গার উল্লেখ পাওয়া যায়। বৈষ্ণবমতে তিনি ভগবান বিষ্ণুর অনন্ত মায়া। শৈবমতে দুর্গা শিবের অর্ধাঙ্গিনী পার্বতী হিসেবে পূজিত। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে কৃষ্ণকে দুর্গাপূজার প্রবর্তক বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, কৃষ্ণ বৈকুণ্ঠের আদি-বৃন্দাবনের মহারাসমণ্ডলে প্রথম দুর্গাপূজা করেন। এরপর মধু ও কৈটভ নামে দুই অসুরের ভয়ে ব্রহ্মা দ্বিতীয়বার দুর্গাপূজা করেছিলেন। ত্রিপুর নামে এক অসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে বিপদে পড়ে শিব তৃতীয়বার দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। দুর্বাসা মুনির অভিশাপে লক্ষ্মীকে হারিয়ে ইন্দ্র চতুর্থবার দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন, বলছে এই পুরাণ। এরপর থেকেই পৃথিবীতে মুনি-ঋষি, সিদ্ধপুরুষ, দেবতা ও মানুষ নানা দেশে নানা সময়ে দুর্গাপূজা করে আসছে।
মার্কণ্ডেয় পুরাণ-এর একটি নির্বাচিত অংশ শ্রীশ্রী চণ্ডী বা দেবীমাহাত্ম্যম। এতে তেরোটি অধ্যায়ে মোট সাতশোটি শ্লোকে দুর্গাকে নিয়ে প্রচলিত তিনটি গল্প- মধু-কৈটভের কাহিনী, মহিষাসুরের কাহিনী ও শুম্ভ-নিশুম্ভের কাহিনী রয়েছে। আর আছে মর্ত্যে বা পৃথিবীতে প্রথম দুর্গাপূজা প্রচলনের কাহিনী। এই কাহিনী রাজা সুরথ ও সমাধি নামের এক বণিকের। সুরথ ছিলেন পৃথিবীর রাজা। সুশাসক ও যোদ্ধা হিসেবে তার যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। কিন্তু একবার এক যুদ্ধে তার পরাজয় ঘটে। সেই সুযোগে তার মন্ত্রী ও সভাসদেরা তার ধনসম্পদ ও সেনাবাহিনীর দখল নেন। মনের দুঃখে বনে বনে ঘুরতে ঘুরতে রাজা মেধা নামে এক ঋষির আশ্রমে এসে উপস্থিত হন। মেধা মুনি রাজাকে নিজের আশ্রমে আশ্রয় দেন। একদিন বনের মধ্যে তিনি সমাধি নামে এক বণিকের দেখা পেলেন। সমাধির স্ত্রী ও ছেলেরা তার সব টাকা পয়সা ও বিষয়সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। মেধা ঋষির উপদেশে তারা দুজন দুর্গাপূজা করলেন। দেবীর বরে তাদের মনস্কামনা পূর্ণ হলো। পুরাণে বর্ণিত এই মেধা ঋষির আশ্রমটি অবস্থিত চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর করলডেঙ্গা পাহাড়ে, বর্তমানে এটি মেধষ মুনির আশ্রম নামে পরিচিত। ১৯০০ সালে স্বামী বেদানন্দ নামে এক সাধক দৈবাদেশ পান কড়লডেঙ্গার বেতসা নদীর তীরে যাওয়ার জন্য। আদেশানুসারে সেখানে এসে মেধষ মুনির আশ্রমকে অবলুপ্তির হাত থেকে বাঁচান স্বামী বেদানন্দ। ১৯৭১ সালের ১৬ জুন পাকিস্তানী সেনারা এই আশ্রমে লুণ্ঠন চালায় এবং গান পাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মন্দিরে পাথরের প্রতিমা প্রতিস্থাপন করে আবার পূজা শুরু হয়।
মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুযায়ী, দুর্গাপূজার প্রথম প্রচলন হয়েছিল বসন্ত ঋতুতে রাজা সুরথ এবং বৈশ্য সমাধির হাতে। দেবী ভাগবত ও কালিকাপুরাণে উল্লেখ আছে, শরৎকালে শ্রীরামচন্দ্র দুর্গাপূজা করেছিলেন রাবণ বধের নিমিত্তে; এজন্য একে, ‘অকালবোধন’ বলা হয়ে থাকে। তবে, মজার বিষয় হলো, বাল্মীকির রামায়ণে রামের দুর্গাপ‚জার কোনও বিবরণ নেই। এমনকি রামায়ণের অন্যান্য ভাষার অনুবাদসমূহ, যেমন, তুলসীদাস রচিত হিন্দি রামচরিতমানস, তামিলভাষায় কাম্ব রামায়ণ, কন্নড় ভাষার কুমুদেন্দু রামায়ণ, অসমিয়া ভাষার কথা রামায়ণ, ওড়িয়া ভাষায় জগমোহন রামায়ণ, মারাঠি ভাষার ভাবার্থ রামায়ণ, উর্দু ভাষার পুথি রামায়ণ প্রভৃতিতেও এর উল্লেখ পাওয়া যায় না। বাংলায় রামায়ণের পদ্যানুবাদের সময় কৃত্তিবাস ওঝা রামের দুর্গাপূজার কথা উল্লেখ করেন।
বলা হয়ে থাকে, অবিভক্ত বাংলায় প্রথম দুর্গাপূজার প্রচলন করেন রাজশাহী জেলার তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণ, সম্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৫) রাজত্বকালে, ষোড়শ শতকে। বর্তমানে যে পারিবারিক কাঠামো সমেত পূজিত হন দেবী, তার সূচনা হয় তখন থেকেই। মতান্তরে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় (১৭১০-১৭৮৩) বাংলায় দুর্গাপূজার সূচনা করেন। তবে দশম শতকের বিভিন্ন গ্রন্থে দুর্গাপূজার বিস্তারিত বিবরণ দেখে মনে হয় তখন থেকেই হয়তো বাংলায় দুর্গাপূজার প্রচলন ছিলো। হয়তো কংসনারায়ণ বা কৃষ্ণগচন্দ্রের সময় থেকে তা আরো জাঁকজমকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হতে থাকে। উনিশ শতকে কলকাতায় মহাসমারোহে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হতো। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিক পর্যন্ত ইউরোপীয়ানরাও দুর্গোৎসবে অংশগ্রহণ করত। ধনীদের গৃহে বাইজি নাচ, কোথাও কোথাও যাত্রাগান, পাঁচালি ও কবিগানের আসর বসত। এসময় ধনীরা পারিবারিক ভাবে পূজার আয়োজন করতো। ১৭৯০ সালের দিকে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়াতে বারো জন বন্ধু মিলে চাঁদা তুলে প্রথম সার্বজনীনভাবে আয়োজন করে বড় আকারে দুর্গাপূজা, যা বারোইয়ার বা বারবন্ধুর পূজা নামে ব্যাপক পরিচিতি পায়।
দেবী দুর্গা সাধারণত দশভূজা, তবে শাস্ত্রানুসারে তার বাহুর সংখ্যা হতে পারে চার, আট, দশ, ষোলো, আঠারো বা কুড়ি। প্রতিমার রং হতে পারে অতসীপুষ্পবর্ণ বা তপ্তকাঞ্চনবর্ণ, কখনও বা রক্তবর্ণ। প্রতিমা ছাড়াও পূজা হতে পারে দর্পণে, অনাবৃত ভূমিতে, পুস্তকে, চিত্রে, ত্রিশূলে, শরে, খড়গে বা জলে।
মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁওয়ে উপমহাদেশের একমাত্র রক্তবর্ণের প্রতিমায় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় ৩০০ বছরের পুরোনো এই পূজা। আয়োজকরা জানান, তাদের পূর্বপুরুষ সর্বানন্দ দাস আসামের শিবসাগরে মুন্সিপদে চাকরি করতেন। তিনি ছিলেন সাধক পুরুষ। একবার কামরূপ-কামাক্ষ্যায় পূজার জন্য পাঁচ বছরের একটি মেয়ে চাইলে স্থানীয়রা তাকে একটি মেয়ে দেন। মহাষ্টমীর দিনে কুমারী পূজা শেষে সর্বানন্দ দাস দেখেন, কুমারীর গায়ের রং পরিবর্তন হয়ে লালবর্ণ ধারণ করেছে। এই দৃশ্য দেখে তিনি কুমারীরূপী দেবীকে জিজ্ঞাসা করেন, মা আমার পূজা সুসম্পন্ন হয়েছে কি? উত্তরে ভগবতী বলেন, হ্যাঁ, তোর পূজা সিদ্ধ হয়েছে। এখন থেকে ভগবতীকে লাল বর্ণে পূজা করবি। পরবর্তী বছর সর্বানন্দ দাস তার নিজ বাড়ি পাঁচগাঁওয়ে রক্তবর্ণের প্রতিমায় শারদীয় দুর্গাপূজার আয়োজন করেন।
মহিষাসুর বধের কাহিনীর মাধ্যমে দেবী দুর্গার মহিমা বর্ণনা বাংলায় বেশি জনপ্রিয়। অসুরদের রাজা মহিষাসুর ছিলেন রম্ভাসুরের পুত্র। পুরাণ অনুসারে, ব্রহ্মা মহিষাসুরের তপস্যায় মুগ্ধ হয়ে বর দিতে চান। বর হিসেবে অমরত্ব চেয়ে বসেন মহিষাসুর। কিন্তু ব্রহ্মা জানান, অমরত্ব পাওয়ার অধিকার শুধু দেবতাদের। তখন মহিষাসুর যুদ্ধে অজেয় হওয়ার বর চান। নিজের দেওয়া বরে একটু ছলনা রেখে দিলেন ব্রহ্মা, বললেন, যুদ্ধে মহিষাসুর পুরুষের অবধ্য। আর সেই ছলনার ছিদ্রপথে নারীশক্তি দেবী দুর্গা যুদ্ধে বধ করলেন মহিষাসুরকে, লেখা হলো বিজয়ীর ইতিহাস। তবে সে গল্প আজ নয়।
লেখক: সাংবাদিক
একে//
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।