শবে মেরাজে করণীয় ও বর্জনীয় (ভিডিও)
প্রকাশিত : ১৪:২৬, ১৪ এপ্রিল ২০১৮ | আপডেট: ১৮:১৩, ১৫ এপ্রিল ২০১৮
নবী করীম (সা.) এর জীবনে বড় বড় অলৌকিক যেসব ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে শীর্ষস্থানীয় হলো মেরাজুন্নবী (সা.)। এটা হলো নবী করীম (সা.) এর সঙ্গে আল্লাহর রাব্বুল আলামীনের অফিসিয়ালি সরাসরি সাক্ষাৎ।
রাসুল (সা.) আল্লাহর পক্ষ থেকে রিসালাতের যে সু-মহান দায়িত্ব পেলেন, খেদমত আনজাম দেবেন এবং তিনি হয়ে গেলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন চাইলেন তার সঙ্গে প্রিয়তম রাসুলের সরাসরি সাক্ষাৎ হোক। এই যে আল্লাহর দর্শন বা দিদারে এলাহী এটা হয়েছিল মেরাজের ওই রাতে।
এটা ছিল দুই ভাবে। একটা হলো ‘আসরা’ যেটা মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত। মসজিদে আকসায় ১ লাখ ২৪ হাজার পয়গম্বর উদগ্রীব ছিলেন রাসুলকে স্বাগত জানানোর জন্য। তারা বলেছেন, আহলান-সাহলান ইয়া রাসুলুল্লাহ, ইয়া হাবিবাল্লাহ। নবী (স.) মসজিদে আকসায় গমন করলেন এবং প্রায় লক্ষাধিক পয়গম্বর নবীজিকে স্বাগত জানালেন। সেখানে নবীজি দুই রাকাত নামাজ পড়লেন। ইমাম হলেন নবী (স.) এবং মুক্তাদি হলেন পয়গম্বররা। এটা হলো আনুষ্ঠানিকভাবে পয়গম্বরদের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ এবং মোলাকাত।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি যখন বিদেশ সফরে যান বা অন্য বড় অনুষ্ঠানে যান তখন যাওয়ার আগ মুহুর্তে সেখানে লাল গালিচার সংর্বধনা দেওয়া হয়। সেখানে লালগালিচার দুই সারিতে মন্ত্রী, সচিব, তিন বাহিনীরসহ অন্যদের প্রটৌকল থাকে। তারা বিদায় দিচ্ছেন এবং ওয়েলকাম জানাচ্ছেন কারণ তিনি একটা বড় ধরনের প্রোগ্রামে যাচ্ছেন।
অনুরূপ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার প্রিয়তম রাসুলের সঙ্গে সাক্ষাতের আগে ১ লাখ পয়গম্বরদের দাঁড় করিয়ে দিলেন প্রটৌকলের জন্য। এজন্য দাঁড় করিয়েছেন যে, আল্লাহ বলছেন আমার প্রিয়তম এক্ষুনি আসবেন মসজিদে আকসায়, তোমরা দাঁড়িয়ে থাক, তাকে স্বাগতম জানাও। তারা রাসুলকে স্বাগত জানালেন রসুল তাদের নিয়ে নামাজ পড়লেন। ইমামুল মুরসালিন, সাইয়্যেদুল মুরসালিন আনুষ্ঠানিকভাবে উপাধি পেলেন এখান থেকে। এরপর তিনি আহরণ করলেন, পয়গম্বররা তাকে বিদায় জানালেন।
রাসুল (স.) আল্লাহর সান্নিধ্যে গেলেন। দিদারে ইলাহী হলো মিরাজ বা উরজ যা ধাপে ধাপে গেলেন। সিদরাতুল মুন্তাহাব-এ গেলেন বোরাক নামে এক বাহনে। সিদরাতুল মুন্তাহাব-এ বোরাক অকেজো হলো। সেখানে আল্লাহর নূরের আলো অনেক বেশি, জিবরাইল আমিন বোরাক নিয়ে সেখানে যেতে পারবেন না। তার যাওয়া হবে না।
সেখানে আল্লাহর পক্ষ থেকে আরও উন্নত মানের বাহন রফরফ আসল। রাসুল (সা.) রফলফ যানবাহনে চরে আরশে আজিমে গেলেন। তিনি আল্লাহর সান্নিধ্যে গেলেন, সাক্ষাৎ হলো। মহান রাব্বুল আলামীনের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ হলো; যাকে দিদারে ইলাহী বলা হয়ে থাকে। সেখানে রাসুলকে আল্লাহ প্যাকট্রিক্যালি এমন কিছু শেখালেন যেটা তিনি এসে পৃথিবীর মানুষকে শিখিয়েছেন।
আমরা যখন নতুন কোনো বন্ধুর বাড়িতে যাই, তখন সে দেখায় এটা ড্রইং রুম, এটা বিশ্রামাগার। ঠিক আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের পরই রাসুলকে দেখানো হয়েছে জান্নাত, জাহান্নাম, সেখানে কিভাবে তাকে শাস্তি দেওয়া হবে, কাকে শান্তি দেওয়া হবে।
আমরা যখন কোনো বিজনেস প্লাটফর্মে যায়, তখন সে তার প্রজেক্ট দেখায়, তেমনি আল্লাহ রাব্বুল আলামিন জান্নাত, জাহান্নাম, কার কি শাস্তি, কাকে কোথায় রাখা হবে সেগুলো রাসুলকে (সা.) দেখিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ সব কিছু দেখিয়েছেন যে এটা আমার এই প্রজেক্ট, এটা ওই প্রজেক্ট।
আল্লাহ রাসুলকে সব দেখিয়েছেন এটা রাসুলের শ্রেষ্ঠত্ব বোঝায়। এটা অন্য কোনো নবীর ক্ষেত্রে এটা ছিল না। মুসা (আ.) আল্লাহকে শুধু দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আল্লাহ বললেন তুমি দেখতে পারবে না। মুসা নবীর অনেক অনুরোধে আল্লাহ অনেক দুর থেকে তার নূরের একটু তাজাল্লি দেখালেন এতে মুসা (আ) জ্ঞান হারালেন। আর তুর পাহাড় পুড়ে ছাই হয়ে গেলো।
অর্থাৎ অন্য কোনো মানুষ, অন্য কোনো নবীর জন্য এই দিদারে এলাহী ছিল না। এটা শুধু মুহাম্মদ (সা) এর জন্য। এটাই তার শ্রেষ্ঠত্বের বড় প্রমাণ, মৌলিক প্রমাণ। তিনি অজু করে যখন মেরাজে গেলেন, সেটা ছিল রাতের ছোট একটা সময়। এই সময়ের মধ্যে তার আরশে আজীমে যাওয়া, আল্লাহর সঙ্গে দিদারে এলাহী হলো আবার তিনি ফিরে এলেন। এসে দেখলেন এখনও তার অজুর পানি গড়িয়ে পড়ছে।
মেরাজের রাতে করণীয়
এখানে দু’টি দিক আছে। একটা ঈমান আকিদা অপরটি হলো আমল। এটি আমলের সঙ্গে যতটা জড়িত তার চেয়ে বেশি জড়িত বিশ্বাসের সঙ্গে। কারণ আগে বিশ্বাস।ঈমান, আকিদা যদি না থাকে তাহলে আমলে কাজ হবে না। সুতরাং ঈমান, আকিদা এরপর আমল। মূল বিষয় হলো মেরাজুন্নবীকে (সা) কেন্দ্র করে আমাদের ঈমানকে আগে মজবুত করতে হবে। নবীজির মেরাজ আগমন উপলক্ষে আমরা সবচেয়ে বেশি আনন্দিত। এই অর্থে এটা ঈদ বা ঈদে মেরাজুন্নবী (সা.)। তবে দুই ঈদের সঙ্গে এই ঈদের মেলানো যাবে না। আকিদাগত যে বিশ্বাস এ থেকে আর বড় আনন্দ আর কি হতে পারে।
আল্লাহ দিদারের মাধ্যমে নবীকে (সা) তিনি যে দিকনির্দেশনা দিলেন, ইসলামের মুল বিষয়গুলোকে তিনি জানিয়ে দিলেন পরে নবীজি (সা.) আমাদের মাঝে এটা নিয়ে আসলেন। আল্লাহ ওহি হিসেবে নবীজিকে ততটুকুই দিলেন যা তিনি যতটুকু চাইলেন। এখানে কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। কোরআনের ৬৬৬৬ আয়াত এটা নবীজির দীর্ঘ ২৩ বছরে এসেছে। এগুলো এলম। রাসুল যেমন শ্রেষ্ঠ এই এলম-এর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা সেই শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরেছেন।
মানুষের আকিদা হলো শ্রেষ্ঠ সম্পদ। আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাত বলতে যে সহি আকিদার কথা বলা হয়েছে। রাসুল (সা) বলেছেন, আমার উম্মতের মধ্যে ৭৩টি দলে বিভক্ত হবে এর মধ্যে একটি দল জান্নাতে প্রবেশ করবে। বাকিরা জাহান্নামি। সেই দলটি হক্ক, তারা সহি আকিদায় বিশ্বাসী। সেই হক্কটা বুঝতে হলে দরকার হবে মেরাজুন্নবী (সা)।
আল্লাহর সঙ্গে রাসুলের যে সম্পর্ক, নবীজির যে ইলম, যে ধারণ ক্ষমতা তা অন্য কারোর পক্ষে মোটেও সম্ভব না। এটা আল্লাহ বুঝিয়ে দিলেন আর এই আকিদা যখন আমরা বুঝব সঠিক পথে যখন চলে আসব, তখন আমাদের আমলগুলো আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য পাবে।
সেক্ষেত্রে আমাদের করণীয় হলো- পুরোটা রাত আমরা আনন্দের বহি:প্রকাশ হিসেবে কয়েক ভাগে ভাগ করে নিতে পারি। এর মধ্যে আমরা নামাজ আদায় করতি পারি। মনে রাখতে হবে, নফল এবাদতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ এবাদত হলো নামাজ। আমরা দুই রাকাত করে নফল সালাত আদায় করব, আমাদের মন যতক্ষণ চায়। কোরআনুল কারীম আমরা পড়ব, তাফসির পড়ব, ব্যাখ্যা পড়ব। কুরআনের নির্দেশনা চারটি- সহীহভাবে তেলাওয়াত করা, অর্থ বোঝা, নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করা এবং অন্যের নিকট এটা পৌঁছে দেওয়া। এ রাতে এটা করতে পারি, পুরো পরিবার নিয়েও করতে পারেন। এর পাশাপাশি রোজা রাখতে পারি আমরা।
মেরাজে বর্জনীয়
পহেলা বৈশাখ ও শবে মেরাজ একই দিনে। বৈশাখ পালনের সময় ইসলামের কিছু কিছু বিষয়ের ব্যতয় ঘটে। যারা মুসলিম তাদের আহবান জানাব, ওই ব্যতয়গুলো যেন আপনার না ঘটে, দুটোকে যেন আমরা তালগোল না পাকিয়ে ফেলি। পহেলা বৈশাখের যে লোকজ উৎসব সেটাকে যেন আমরা শালিনভাবে পালন করি। একই সঙ্গে রাসুলের মেরাজটাকে যেন আমরা উপলব্ধি করতে পারি এবং সেটা যেন ধারণ করতে পারি। এ প্রত্যয় আমাদের ভেতরে জাগ্রত হোক এটা আমার আহবান।
আলোচক: ড. মো. আতাউর রহমান মিয়াজী
অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
উপস্থাপনায়: মাওলানা ফখরুল আশেকী
একুশে টেলিভিশন-এর ইসলামী জিজ্ঞাসা (পবিত্র শবে মেরাজ) পর্ব থেকে অনুলিখন।
ভিডিও
/ আর /