শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অম্লান পথরেখা ফিরে দেখা
প্রকাশিত : ১১:৩৩, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৮
ডিসেম্বর শুধু বিজয়ের নয়, বেদনারও মাস। এ বিজয়ের পেছনে রয়েছে এ দেশের সেরা বুদ্ধিজীবীসহ ৩০ লাখ শহীদের রক্ত, কয়েক লাখ মা-বোনের সল্ফ্ভ্রম হারানো, অগ্নিসংযোগে লাখ লাখ বাড়িঘর ভস্মীভূত হওয়া ও এক কোটি জীবন বিপন্ন মানুষের ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণের মতো নজিরবিহীন বিয়োগান্ত ঘটনা।
পাকিস্তানি হানাদাররাই শুধু এ অপরাধ সংঘটিত করেনি, পাকিস্তানপন্থি ও স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম ও পিডিপির নেতাকর্মীরা তাদের দোসর হিসেবে মানুষ হত্যাসহ এসব জঘন্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশ নেয়। এদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামী ও এর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে নিষ্ঠুর ও পৈশাচিক। গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণের পাশাপাশি তারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মিলে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ঠাণ্ডা মাথায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ডাক্তার, সাংবাদিক ও অন্যান্য পেশার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের তালিকা ধরে হত্যা করে।
এ জন্য ইসলামী ছাত্রসংঘের উদ্যোগে সৃষ্টি হয় আলবদর, আলশামস নামে বিশেষ ঘাতক বাহিনী। এ কুখ্যাত বাহিনীর হাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথিতযশা অধ্যাপক ও দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবী ড. মুনীর চৌধুরী, ড. আবুল খায়ের, ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ড. আনোয়ার পাশা, ড. গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, ড. রাশিদুল হাসান, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার, নিজামুদ্দীন আহমেদ, এমএ মান্নান ওরফে লাডু ভাই, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ নাজমুল হক, মুহাম্মদ আখতার, সেলিনা পারভীন, ডা. আলীম চৌধুরী, ডা. মুর্তজা, ডা. ফজলে রাব্বী প্রমুখ পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।
এসব বুদ্ধিজীবীকে নিজ বাসা থেকে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে চোখ বেঁধে অনেককে প্রথমে মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের (বর্তমান মোহাম্মদপুর সরকারি শারীরিক শিক্ষা কলেজ) টর্চার কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তাদের ওপর নির্যাতন শেষে ১৪ ডিসেম্বর মিরপুর ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায় একেক করে প্রথমে গুলি ও এরপর বেয়নেট চার্জ করে অত্যন্ত নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর `অপারেশন সার্চলাইট` নামে গণহত্যা শুরুর রাতে এবং পরবর্তী সময়ে সারাদেশে অনেক বুদ্ধিজীবী অনুরূপ হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। সব শহীদ বুদ্ধিজীবীর আত্মদানের প্রতি জাতির সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা নিবেদন ও স্বাধীনতা অর্জনে তাদের অমূল্য অবদান চিরস্মরণীয় করে রাখতে স্বাধীনতা-উত্তর বঙ্গবন্ধু সরকার ১৪ ডিসেম্বরকে `শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস` হিসেবে ঘোষণা করে। তখন থেকে শুরু করে যথাযোগ্য মর্যাদায় সমগ্র জাতি দিবসটি পালন করে আসছে।
বাঙালির জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতা সংগ্রামে রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের পাশাপাশি এ দেশের বুদ্ধিজীবীরা খুবই সক্রিয় ও মূল্যবান অবদান রাখেন। মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির চূড়ান্ত বিজয়ের প্রাক্কালে পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এ দেশীয় দোসর জামায়াত-আলবদর-আলশামস-ইসলামী ছাত্রসংঘ নিজেদের পরাজয়ের প্রতিশোধ ও স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বশূন্য করার হীন লক্ষ্যে বেছে বেছে বিভিন্ন ক্ষেত্রের এ দেশের সেরা মেধাবী সন্তানদের নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে।
এত কিছুর পরও `৭১-এর ঘাতক-খুনিচক্র বাংলাদেশের অগ্রগতিকে স্তব্ধ করে দিতে পারেনি। বাংলাদেশ শুধু ওঠে দাঁড়ায়ইনি, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের এক বিস্ময়, রোল মডেল। জেনারেল জিয়া-এরশাদ সামরিক জান্তা, বিএনপি ও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে নানা আনুকূল্য ও কৌশলের মাধ্যমে স্বাধীনতা ও মানবতাবিরোধী এ অপশক্তি বাংলাদেশের সমাজ-রাজনীতিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার অপচেষ্টা করেছে।
এখনও সে অপচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আদালত কর্তৃক জামায়াতে ইসলামীকে মানবতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী, সন্ত্রাসী দল হিসেবে চিহ্নিত, নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নিবন্ধন বাতিল এবং ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনালে বিচার শেষে এর অধিকাংশ জ্যেষ্ঠ নেতার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ইতিমধ্যে ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার পরও আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দাঁড়িপাল্লা ছেড়ে ধানের শীষ এবং পরোক্ষভাবে ড. কামাল হোসেনের বৃহত্তর ঐক্যের ছায়াতলে আজ তারা আশ্রয় গ্রহণ করেছে। এরা স্বাধীনতার শত্রু, দেশের শত্রু, মানবতার শত্রু, প্রগতির শত্রু, গণতন্ত্রের শত্রু, উন্নয়নের শত্রু।
এরা খুবই নিষ্ঠুর, প্রতিশোধপরায়ণ ও ফ্যাসিবাদী। স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী, মানুষ হত্যাকারী, নারী ধর্ষণকারী চিহ্নিত এই গোষ্ঠীর নির্বাচন তো দূরের কথা, সাধারণ রাজনীতি চর্চারও অধিকার থাকার কথা না, থাকতে পারে না। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত, কয়েক লাখ মা-বোনের সল্ফ্ভ্রম ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মোৎসর্গের মধ্য দিয়ে অর্জিত এ বাংলাদেশে এদের ঠাঁই নেই। এদের ও এদের ছদ্মবেশী, মুখোশধারী পৃষ্ঠপোষক-আশ্রয়দাতাদের সম্বন্ধে দেশবাসী সাবধান।
লেখন: ড. হারুন-অর-রশিদ
উপাচার্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়