শারদীয় দুর্গাপূজা ও সম্প্রীতির বাংলাদেশ
প্রকাশিত : ১৭:৩৩, ১০ অক্টোবর ২০২১
‘দুর্গ’ (দূর্- গম্+ড) শব্দের সঙ্গে টাপ্ প্রত্যয়যোগে ‘দুর্গা’ (দুর্গ+স্ত্রিয়াং টাপ্) শব্দটি গঠিত হয়েছে। শব্দকম্পদ্রুম গ্রন্থ অনুসারে দুর্গ (বা দুর্গম) নামক অসুরকে যিনি বধ করেন তিনিই দুর্গা (দুর্গং নাশয়তি যা সা দুর্গা)। দুর্গম অসুরকে বধ করে জীবের দুর্গতি নাশ করেন বলেও তাকে দুর্গা (দুর্গতিনাশিনী) বলা হয়।
তিনি আদ্যাশক্তি, মহামায়া, শিবানী, ভবানী, দশভুজা, চণ্ডী, নারায়ণী প্রভৃতি নামে ও বিশেষণে অভিহিত হন। পুরাণে কথিত আছে যে, আদ্যাশক্তি মহামায়া দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের লক্ষ্যে এবং সমগ্রজীবের কল্যাণার্থে যুগে যুগে ও কালে কালে বিভিন্নরূপে ভিন্ন ভিন্ন নামে আবির্ভূত হয়েছেন। দেবী দুর্গা তারই বিশেষ সময়ের, বিশেষ যুগের এক বিশেষরূপ।
শ্রীশ্রীচণ্ডী গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে প্রাচীনকালে ব্রহ্মার বরে পুরুষের দ্বারা অবধ্য মহিষাসুর দেবগণকে যুদ্ধে পরাস্ত করে স্বর্গের অধিকার কেড়ে নিয়ে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করে। স্বর্গ থেকে বিতাড়িত দেবগণ মহিষাসুরকে হত্যা করে স্বর্গরাজ্য উদ্ধার করার জন্য প্রথমে প্রজাপতি ব্রহ্মা এবং পরে তাকে মুখপাত্র করে বিষ্ণু (নারায়ণ) এবং শিবের সমীপে উপস্থিত হন। মহিষাসুরের কাহিনি শুনে তারা উভয়েই অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হন। সেই ক্রোধে তাদের মুখমণ্ডল ভীষণাকার ধারণ করে। প্রথমে বিষ্ণুর ও পরে শিব ও ব্রহ্মার মুখমণ্ডল থেকে এক মহাতেজ নির্গত হয়। দেবরাজ ইন্দ্রসহ অন্যান্য দেবতার দেহ থেকেও সুবিপুল তেজ নির্গত হয়ে মহাতেজের সঙ্গে মিলিত হয়। বিরাট পর্বতপ্রমাণ ও উজ্জ্বল তেজঃপুঞ্জ একত্রিত ও ঘনীভূত হয়ে অগ্নিবর্ণা, মহাতেজস্বিনী, পরমরূপবতী এক দেবীমূর্তি ধারণ করে। দেবগণের সম্মিলিত শক্তির সংহত বা মিলিতরূপ থেকে আবির্ভূত মহাশক্তির অধিষ্ঠাত্রী এই দেবী হলেন দুর্গা। সমুদ্র ও বিশ্বকর্মা দেবীকে বহুরকম অলংকার দান করেন। দেবগণও বিভিন্ন প্রকার অলংকার দিয়ে দেবীকে সজ্জিত করেন। তারপর দেবগণ প্রত্যেকে তাদের নিজ নিজ অস্ত্র দেবীকে দান করেন। হিমালয় দেবীকে বাহন হিসেবে সিংহকে দান করেন। দেবতাদের শক্তিতে শক্তিময়ী এবং বিভিন্ন অস্ত্রে সজ্জিত দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করেন। দেবী দুর্গাকর্তৃক দুরাত্মা মহিষাসুর নিধন বর্তমানে প্রচলিত দুর্গাপূজার দৃশ্যপট।
দুর্গাপূজা শরৎ এবং বসন্ত দুই ঋতুতে অনুষ্ঠিত হয়। তবে ধুমধামের সাথে শরৎকালেই এই পূজা বেশি হয়ে থাকে। শরৎকালে অনুষ্ঠিত দুর্গাপূজা শারদীয় দুর্গাপূজা নামে এবং বসন্তকালে অনুষ্ঠিত দুর্গাপূজা বাসন্তীপূজা নামে অভিহিত। বাসন্তীপূজা এখনও প্রচলিত থাকলেও শারদীয় দুর্গাপূজাই আবহমান কাল থেকে মহাসমারোহে উৎসবাকারে পালিত হচ্ছে।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। এ সম্প্রীতি আমাদের দীর্ঘ দিনের ঐতিহ্য। বাংলাদেশ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের নিরাপদ আবাসভূমি। বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে হৃদয়ে ধারণ করে নানা ধর্মের, নানা বর্ণের মানুষ একসাথে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করছে। সারা বিশ্বজুড়ে যখন সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে মানুষের মাঝে মানবতা, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য, সংহতি ইত্যাদি শব্দগুলো প্রশ্নবিদ্ধ তখন বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িকতার এক অপূর্ব নজির স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। বাঙালি মননে রোপিত অসাম্প্রদায়িক চেতনাই এর ভিত্তিমূল। যেহেতু বাংলার প্রকৃতি সাম্প্রদায়িকতাকে স্বীকার করে না সেহেতু বাঙালি মানসে অসাম্প্রদায়িক চেতনাই বিরাজ করে আসছে আবহমান কাল ধরে। আর এ কারণে নানা ধর্মের মানুষ তাদের ধর্মীয় কর্মকাণ্ড স্বতন্ত্রভাবে পালন করলেও ধর্মীয় উৎসব উদযাপন করে সম্মিলিতভাবে। ঈদ-উল-ফিতর, ঈদ-উল-আযহা, ঈদ-এ-মিলাদুন্নবী, জন্মাষ্টমী, শারদীয় দুর্গোৎসব, বৌদ্ধ পূর্ণিমা, বড়দিন প্রভৃতি ধর্মীয় অনুষ্ঠানসমূহ কোনো বিশেষ ধর্মের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকে না, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ ও উপস্থিতিতে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে উদযাপিত হয় প্রতিটি ধর্মীয় উৎসব। জাতীয় চেতনায় এবং শান্তির প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ এই স্লোগানকে মনেপ্রাণে ধারণ করে নির্বিঘ্নে সকল ধর্মের, সকল বর্ণের, সকল গোষ্ঠীর মানুষ সাড়ম্বরে পালন করে প্রতিটি ধর্মীয় উৎসব।
শারদীয় দুর্গাপূজা বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। শারদীয় দুর্গাপূজা বাঙালি হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হলেও এটি এখন বাংলাদেশের অন্যতম জাতীয় উৎসব। দেবীবন্দনায় মুখরিত হয় বাংলাদেশের সমগ্র আকাশ-বাতাস। বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে সর্বজনীন শারদীয় দুর্গোৎসব। বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের কাছে এ পূজা চিরায়ত ঐতিহ্য ও ধর্মীয় সংস্কৃতির মেলবন্ধনে এক অনুপম প্রীতিময় আনন্দ উৎসব। অশুভ ও অপশক্তির পরাজয় এবং শুভশক্তির জয়, সত্য ও সুন্দরের আরাধনায় সর্বজীবের মঙ্গল সাধন শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রধান বৈশিষ্ট্য। অশুভ ও আসুরিক শক্তি দমনের মাধ্যমে সমাজে ন্যায়বিচার, সত্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠা, সকল মানুষের সমানাধিকার নিশ্চিতকরণ, মানুষের মধ্যকার সকল প্রকার বৈষম্য বা ভেদাভেদ ও অন্যায়, অবিচার দূরীকরণ এবং অসত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, হানাহানিমুক্ত অসাম্প্রদায়িক মানবপ্রেমে উদ্বুদ্ধ সমাজগঠন করার শিক্ষালাভই দুর্গোৎসবের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
শরতের হিমেল হাওয়া, প্রকৃতির অভিনব রূপ, আকাশের নীলাভ রং এবং সাদা মেঘের ভেলা, প্রস্ফুটিত ফুলের সমারোহ মনকে ভরিয়ে তোলে অপার আনন্দে। কাশবনের দোলা আর শিশির ভেজা ঘাসে জড়িয়ে থাকা শিউলি ফুলে পাওয়া যায় শরতের স্নিগ্ধ ছোঁয়া। গাছে গাছে সবুজের সমারোহ। বিলে-ঝিলে লাল-সাদা শাপলা, নদীর কিনারের কাশবন পুরো প্রকৃতিকে মনোরম করে তোলে। প্রকৃতির সেই স্নিগ্ধ-কোমল সৌন্দর্যের মাঝেই শারদীয় দুর্গোৎসবের আগমনী সুর বেজে ওঠে এবং উৎসবের আমেজ ও সম্প্রীতির বন্ধনে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষকে আবদ্ধ করে।
শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝেই এই উৎসব শারদীয় শিহরণ জাগায় তা নয়; এই উৎসব সকল বাঙালিকেই উচ্ছল করে তোলে। উৎসবের আনন্দ ধর্মমতের গণ্ডি পেরিয়ে সকলেই ভাগ করে নেয়। এটা এই জনপদের দীর্ঘকালের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্য সমগ্র বাঙালির।
বাংলাদেশে দুর্গাপূজা মানেই সর্বজনীন। এখানে উৎসবের আনন্দে গোটা দেশে প্রাণের সঞ্চার হয়। যেকোনো পূজামণ্ডপে গিয়ে বোঝা যায় না কে কোন জাতির। উদ্যোক্তা কিংবা আয়োজক শুধু হিন্দু সম্প্রদায় নয়, অন্য সম্প্রদায়ের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। পূজার শুরু থেকে বিসর্জন পর্যন্ত সকল আয়োজনে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। উৎসবকে ঘিরে এই আনন্দঘন পরিবেশ এবং মিলন বিশ্বে বিরল। এটা এমন এক অপূর্ব দৃশ্য, যা কেবল বাংলাদেশেই দেখা যায়।
শারদীয় দুর্গোৎসব সমাজকে অসহিষ্ণুতা, হিংসা, বিদ্বেষ ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের অশুভ প্রভাব থেকে মুক্ত করে মানুষের মধ্যে ঐক্য, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সহমর্মিতা প্রতিষ্ঠা করে। ঐক্যবদ্ধ করে সমগ্র বাঙালিকে। এক মায়াবী বন্ধনে জড়িয়ে রাখে সমস্ত বাঙালিকে। উদ্বুদ্ধ করে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সম্প্রীতি চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হতে। সবার মধ্যে সম্প্রীতি ও ঐক্যের বন্ধন সুদৃঢ় করে। দুর্গোৎসবের শুভ্র ও আনন্দ জাগানিয়া পরশ শুধুমাত্র বাঙালি হিন্দুধর্মানুসারীদেরই নয়, এর চিরায়ত ঐকতান স্পর্শ করে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়কে। দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে যে অনাবিল আনন্দ সবার মনের মাঝে জেগে ওঠে তা বাঙালির প্রতিটি গৃহকে আলোকিত করে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের মঙ্গল ও হিতকামনায়।
সংস্কৃত ধৃ-ধাতুর উত্তর মন্ প্রত্যয়যোগে ধর্ম শব্দটি গঠিত হয়েছে। ‘ধৃ’ ধাতুর অর্থ ধারণ করা। যা ধারণ করে মানুষ সুন্দর, সুশৃঙ্খল ও পবিত্র জীবন-যাপন করে এবং যা মানুষের সার্বিক কল্যাণ সাধন করে তাকেই বলে ধর্ম। সহজভাবে বললে যা আমাদের কল্যাণের পথে ধরে রাখে তাই ধর্ম। স্বাভাবিক গুণ বা নৈতিক চরিত্র অর্থে ধর্ম শব্দটি বেশি ব্যবহৃত হয়। আধ্যাত্মিক শক্তির সঙ্গে আমাদের বাস্তব জীবনের অনুভূতিই ধর্ম। ভিন্নভাবে বললে ধর্ম হচ্ছে মিলন ও একাত্মতার নীতি। কোনো ধর্মই হিংসার কথা বলে না, বিভেদের কথা বলে না; বলে ঐক্য ও শান্তির কথা। ধর্ম মানুষকে ঘৃণা বা হিংসা করতে শেখায় না, শেখায় ভালোবাসতে এবং সভ্য হতে। মানবতাই ধর্মের শাশ্বত বাণী। ধর্ম মানুষকে ন্যায় ও কল্যাণের পথে আহ্বান করে, অন্যায় ও অসত্য থেকে দূরে রাখে, মানবতার পথ দেখায়।
সকল ধর্মের মূল বাণী হচ্ছে সৃষ্টির কল্যাণে আত্মনিয়োগ করা, সমগ্র জীবের কল্যাণ সাধনই ধর্মের মূল লক্ষ্য, কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের কল্যাণ সাধন নয়। এই চেতনাকে মনে-প্রাণে ধারণ করেই জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল মানুষের সুখ-শান্তি কামনায় এবং সর্বজীবের মঙ্গলার্থে আবহমান কাল ধরে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায় বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা ও উৎসবমুখর পরিবেশে নানা উপচার ও অনুষ্ঠানাদির মাধ্যমে পালন করে শারদীয় দুর্গোৎসব, আরাধনা করে দেবী দুর্গার। উৎসবমুখরতার মধ্য দিয়ে সকল প্রকার হীনতা, সংকীর্ণতা ও ধর্মান্ধতার ঊর্ধ্বে উঠে সকল প্রকার ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সর্বস্তরের জনগণ শারদীয় দুর্গোৎসব উদযাপন করে এবং আনন্দ উৎসবে অংশগ্রহণ করে। সকল বাঙালি মিলিত হয় অভিন্ন মোহনায়, অভিন্ন চেতনায়।
পূজার ধর্মীয় অংশটুকু হিন্দুদের; কিন্তু মেলা, উৎসব ও আপ্যায়নে অংশগ্রহণ এবং আনন্দ উপভোগ করেন সবাই। সকলের অংশগ্রহণ ও উপস্থিতিতে শারদীয় দুর্গাপূজা পরিণত হয় সর্বজনীন উৎসবে, পরিণত হয় সর্বস্তরের মানুষের মিলনমেলায়। ঐক্য ও সমন্বয়ের প্রতীক হিসেবে এ উৎসব পরিণত হয় সম্প্রীতিময় আনন্দযজ্ঞে। সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়ে উৎসবের আবহ এবং ঐক্যসূত্রে গ্রথিত হয় সকল মানুষের হৃদয়; দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয় ভাতৃত্বের বন্ধন। পূজা থেকে উৎসবে রূপান্তরের এই যে প্রক্রিয়া, এটি বাঙালি জাতির অসাম্প্রদায়িক সত্তার চিরন্তন বহিঃপ্রকাশ।
অতীত থেকেই দুর্গাপূজা উৎসবাকারে পালিত হয়ে আসছে সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে। সকলের মঙ্গল ও হিতকামনায়, এমন বৃহত্তম আয়োজন খুবই গুরুত্ব বহন করে। পূজার সময় মন্দিরে মন্দিরে ভক্তিমূলক গান, চণ্ডীপাঠ, অর্চনা, আরতি, ভক্তদের শ্রদ্ধার্ঘ্য এবং সেই সাথে কোলাকুলি, প্রণাম, আশীর্বাদ, মেলা ইত্যাদি দুর্গোৎসবকে ধর্মীয় আবেশে আনন্দঘন করে তোলে। দুর্গোৎসব মানুষে মানুষে মেলবন্ধন সৃষ্টি করে। সৃষ্টি করে মানুষের সঙ্গে মানুষের প্রীতিময় ও কল্যাণময় সম্পর্ক। ধর্মীয় উৎসবের পাশাপাশি দুর্গাপূজা সর্বস্তরের জনগণের মাঝে পারস্পরিক সহমর্মিতা ও ঐক্য সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
দুর্গাপূজা সর্বজনীন উৎসব এটা শুধু কথার কথা নয়- পূজাবিধি এবং দেবীর প্রতিমার রূপ-কল্পনায়ও এটা পরিলক্ষিত হয়। অন্য সব দেবতাই এককভাবে পূজিত হন; কিন্তু দেবী দুর্গা পূজিত হন সমষ্টিগতভাবে। তার সঙ্গে সিদ্ধিদাতা গণেশ, মহাবীর দেবসেনা (সেনাপতি) কার্তিক, ঐশ্বর্যের (ধন-সম্পদের) দেবী লক্ষ্মী ও বিদ্যার (জ্ঞানের) দেবী সরস্বতী পূজিত হন। দেবাদিদেব মহাদেবের স্থান থাকে সবার উপরে। দুর্গা দেবীর সঙ্গে তাঁর বাহন সিংহ, গণেশের বাহন ইঁদুর, কার্তিকের বাহন ময়ূর, লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা, সরস্বতীর বাহন হংস, এমন কি মহিষাসুরও পূজিত হন। উঁচু-নীচু সকলে একত্রে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করে।
পূজার পর শুভ বিজয়া। বিজয়ায় অবাধ মিলন। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ একত্রে বিজয়ার উৎসব পালন করে। সকল বাধা ও মনের সংকীর্ণতা দূর করে অনৈক্য-বিভেদ, হিংসা-বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িক মনোভাব দূরে ঠেলে মানুষে মানুষে সমাবেশ ঘটে পূজার উৎসবস্থলে। সকলের সহাবস্থান আর ঐক্যের মেলায় পরিণত হয় পূজার মন্দির। প্রকাশিত হয় বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনা। এ জন্যই শারদীয় দুর্গাপূজা সামাজিক সম্প্রীতি, মহামিলন এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার চিরন্তন উৎসব। সম্প্রীতিবিধ্বংসী কোনো প্রচেষ্টা দুর্গাপূজার সর্বজনীনতাকে বিনষ্ট করতে পারবে না। বাঙালি জাতিসত্তার মর্মমূলে গ্রথিত ঐকতানের কাছে তা পরাভূত হবেই। আপামর জনতা দুর্গোৎসবে সামিল হয়ে উৎসবের আমেজে যে ঐক্যচেতনায় বাধা পড়েছে তা ছিন্ন করার ক্ষমতা কারোর নেই। কোনো ঠুনকো আঘাতে এ বন্ধন কোনো দিন ছিন্ন হবে না।
দুর্গাপূজায় যদিও ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা হিন্দুদের, কিন্তু মূলবাণী সমগ্র মানবজাতির কল্যাণে নিবেদিত। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালির হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক চেতনা। দুর্গোৎসবে সকল ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে এক সামাজিক বন্ধন ও অসাম্প্রদায়িক পরিচয় ফুটে ওঠে, ভ্রাতৃত্ববোধের এক নতুন আবহ তৈরি হয়। দেবীর যুদ্ধরতরূপ লোকশিক্ষার একটি দৃষ্টান্ত। এটি হচ্ছে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির যুদ্ধ, অন্যায়, অসত্য ও অনাচারের বিরুদ্ধে ন্যায়, সত্য ও সদাচারের সংগ্রাম। দুর্গা দেবীর বন্দনার প্রেক্ষাপট হলো অন্তরের আসুরিক শক্তির বিনাশ। দুর্গাপূজা হচ্ছে শক্তি অথবা ঐশ্বরিক শক্তির আরাধনা। দুর্গা দেবীর ‘দশ হাত’ ঐক্য বা সম্মিলিত শক্তির প্রতীক। দুর্গার আবির্ভাব কাহিনীতেও ঐক্যের সুর ধ্বনিত (পূর্বে উল্লিখিত)। ঐক্যবদ্ধভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার, অন্যায়কে প্রতিহত করার শিক্ষাই দেবীর প্রতিমা হতে শিক্ষণীয়। সুতরাং দুর্গাপূজা শক্তি, সংহতি বা ঐক্যের প্রতীক।
দুর্গাপূজার কাঠামোতে দেশ ও জাতির সংহতি সাধনের স্পষ্ট ইঙ্গিত পরিলক্ষিত হয়। লক্ষ্মী ধন-সম্পদের, সরস্বতী জ্ঞানের, কার্তিক বীরত্বের এবং গণেশ সাফল্যের প্রতীক, আর দুর্গার দশটি হাতে দশটি প্রহরণ (অস্ত্র) অপরিমেয় বলবীর্যের প্রতীক। সিংহ বশ্যতার প্রতীক আর মহিষাসুর সমস্ত অসুরের প্রতীক। একটি বলিষ্ঠ জাতি সমস্ত অশুভকে দলিত করে পরিপূর্ণতা লাভ করে। দেবী দুর্গার আরাধনাকে কেন্দ্র করে আমাদের মনেও এই ধারণাই দৃঢ়ীভূত হয়।
দুর্গাপূজার সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিকটি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। জীবনে অশুভ অসুর শক্তির বিনাশ করে শুভ সুর শক্তির প্রতিষ্ঠা দুর্গাপূজার শাশ্বত দর্শন। দুর্গাপূজা জাতীয় মহা-আলোড়ন সৃষ্টিকারী ধর্মীয় অনুষ্ঠান। এতে মিলিত হয় সর্বস্তরের মানুষ। ব্রাহ্মণ, মালী, কুম্ভকার, তন্ত্রবায়, নরসুন্দর, ঋষিদাস প্রভৃতি সর্ববর্ণের সর্বস্তরের মানুষের সহায়তা ও মিলন প্রয়োজন হয় দুর্গাপূজায়। বহু বিস্তৃত উদার ব্যাপক অনুভূতি জাগে এই পূজায়। বাস্তবিকই ধনী-দরিদ্র, উঁচু-নীচু, ব্রাহ্মণ-শূদ্র, এমনকি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল স্তরের মানুষের মহামিলনের ক্ষেত্র এই দুর্গাপূজা। এই দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়। একইসঙ্গে মানুষ অর্থনৈতিকভাবেও উপকৃত হয়। মূল কথা হচ্ছে, আমাদের জাতীয় জীবনে দুর্গাপূজার ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম।
সমাজপ্রগতির নানান অনুষঙ্গের মধ্যে ধর্ম কিংবা ধর্মীয় আচার অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। ধর্মীয় আচার যখন কোনো একটা জাতির জীবনে উৎসবের মর্যাদা প্রাপ্ত হয় তখন তা ধর্মীয় চেতনার মধ্যে আবদ্ধ না থেকে হয়ে ওঠে অগ্রবর্তী সমাজ কাঠামোর ভিত্তিমূলের চলমান সোপান। বাঙালির জীবনে শারদীয় দুর্গোৎসব তেমনি এক বহমান অসাম্প্রদায়িক চেতনসত্তার প্রতিরূপ। যেখানে থাকে না কোনো জাত-পাতের বাছ-বিচার, থাকে না কোনো ভেদাভেদ, থাকে না সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। বাঙালি যে অসাম্প্রদায়িক জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তা প্রতিবছরই প্রমাণিত হয় দুর্গোৎসবের মধ্য দিয়ে। এ কারণেই দুর্গোৎসব হচ্ছে সম্প্রীতির আর বাঙালির আনন্দ উচ্ছ্বাস উদ্্যাপনের এক মহামিলনধর্মী অসাম্প্রদায়িক উৎসব।
শারদীয় দুর্গোৎসবে সকল বাঙালি যেমন ঐক্যবদ্ধভাবে উদ্যাপন করে, আনন্দ-উৎসবে মেতে ওঠে ঠিক তেমনি ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করতে হবে ষড়যন্ত্রকারী সাম্প্রদায়িক ও অপশক্তির বিরুদ্ধে এবং সমুন্নত রাখতে হবে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের অনন্য বৈশিষ্ট্যকে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে তুলতে হবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশ।
লেখক: অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান, সংস্কৃত বিভাগ; ট্রাস্টি, হিন্দুধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট; উপদেষ্টা, শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র; সিনেট সদস্য ও সাবেক প্রাধ্যক্ষ, জগন্নাথ হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এসি
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।