শারীরিক দূরত্ব যেন মানসিক দূরত্ব না বাড়ায়
প্রকাশিত : ২০:২৩, ২৮ জুন ২০২০
ডা. হাসনাইন নান্না
‘সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং’ বা ‘সামাজিক দূরত্ব’ -পরিভাষাটিকে আমরা হয়তোবা ভুল প্রয়োগ করে ফেলছিলাম। এর পরিবর্তে ‘ফিজিক্যাল ডিসট্যান্সিং’ বা ‘শারীরিক দূরত’ কথাটাই অনেক বেশি উপযুক্ত। বিষয়টি নিয়ে আগে একবার বলার চেষ্টা করেছি। অনেকেই সে বিষয়ে একমত হয়েছেন। ফলে আমরা অনেকেই ‘সামাজিক দূরত্ব’ না বলে ‘শারীরিক দূরত্ব’ বলা শুরু করেছি। এবং এর প্রভাবও পড়তে শুরু করেছে বলেই বোধ হচ্ছে।
করোনাভাইরাসের আবির্ভাবের শুরুর দিকে আমরা সামগ্রিকভাবে যতটা অমানবিক ও অসামাজিক ছিলাম ততটা এখন আর নেই। ‘সামাজিক দূরত’ শব্দগুচ্ছই আমাদেরকে সামাজিকভাবে দূরে ঠেলে দিচ্ছিল, বিচ্ছিন্ন করে ফেলছিল। এখন শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে সামাজিক নৈকট্যের দারুণ ছন্দে আবার আমরা ফিরে আসার চেষ্টা করছি।
আমরা বিশ্বাস করি, ‘শারীরিক দূরত্ব’ বজায় রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ঠিকই কিন্তু বন্ধুবান্ধব বা পরিবার বা প্রতিবেশীর সাথে সামাজিক, মানসিক বা মানবিক যোগাযোগ ছিন্ন করতে বলা হয়নি। বরং এই দুঃসময়ে একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজনীয়তা বেশি বেড়েছে। বিশেষ করে, যাদের করোনা টেস্টে পজিটিভ রিপোর্ট এসেছে, তাদের পাশে মমতা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন আছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে যদি তাদেরকে সঠিকভাবে যত্ন করা যায়, সেবা দেয়া যায়, তাহলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা সুস্থ হয়ে উঠবেন।
দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর তিন মাস পর আমরা এখন দেখছি, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মত মানুষ আজো আছে। মনুষ্যত্ব হারিয়ে যায়নি। আপনজনকে ফেলে চলে যাওয়ার, চিকিৎসা না করিয়ে দূরে ঠেলে দেয়ার অমানবিক প্রবণতা অনেকটাই কমে এসেছে। যারা মারা গেছেন এবং রিপোর্টে করোনা পজিটিভ এসেছে তাদের মৃতদেহ দাফন/সৎকারে প্রয়োজন রয়েছে অপরের এগিয়ে আসার। অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এগিয়ে আসছেও। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেক পরিবারই তাদের নিকটজনের শেষকৃত্যে কোন স্বেচ্ছাসেবীকে কাছে আসতে দেন নি। প্রশাসনের সহযোগিতার হাত ফিরিয়ে দিয়ে নিজেরাই সবটুকু করেছেন। যেটা শুরুর দিকে ছিল প্রায় অনুপস্থিত। দাফন কাজে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সংখ্যাও বেড়েছে।
তারপরও মাঝে মাঝে সংবাদপত্রে/ টিভি চ্যানেলের দিকে তাকালে কষ্ট হয়। রাস্তায় বের হলে দুঃখ হয়। হঠাৎ হঠাৎ দু-একটি ঘটনা শুনলে বেদনাহত হয়ে যাই। যখন দেখি কারও সাথে কারও সামান্য স্পর্শ লাগায় তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। এরকমই একটি ঘটনা শুনলাম। জুম্মার নামাজ পড়ে মুসল্লিরা বের হচ্ছিলেন। ভিড়ের মধ্যে একজনের হাত লেগে যায় সামনের জনের পিঠে। সামনের জন সাথে সাথে অত্যন্ত তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন। ঘুরে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে বকাবকি করতে থাকেন।
ঘটনাটা শুনে ভাবছিলাম, যদি পিছনের জনের করোনা পজিটিভ হয়। তার হাতে করোনাভাইরাসবাহী কোন পদার্থ (যেমন সর্দি/কাশি/হাঁচি থেকে নির্গত তরল) লেগে থাকে। তারপরও সামনের জনের পিঠ থেকে তার শরীরের ভেতরে ঢোকার সম্ভাবনা কত কম। কারণ, ভাইরাসটি জামা ভেদ করে পিঠের চামড়া ভেদ করে ভেতরে ঢুকতে পারবে না। ঢুকতে হলে তাকে নাক চোখ ঠোঁট এসব অঙ্গ দিয়ে ঢুকতে হবে। সামনের লোকটি যদি বাসায় গিয়েই জামাটি ধোয়ার ব্যবস্থা করেন তাহলেই আর কোন ভয়ের কিছু নেই। নিজেও যদি হাত মুখ ভালভাবে সাবান দিয়ে ধোয়ার ব্যবস্থা নেন তাহলেও কোন দুশ্চিন্তার আর কিছু নেই। তবে পেছনের লোকটি যদি ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত না হন তাহলে কোনভাবেই সামনের জনের সংক্রমিত হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।
কিন্তু অবস্থা এরকম যে, আমরা সবাই সবাইকে সন্দেহ করা শুরু করেছি। সবাই ভাবছি অন্যজনের বুঝি করোনা পজিটিভ! এই সন্দেহ বেশি দিন চলতে থাকলে আমরা সবাই-ই ‘সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত’ হয়ে যাবো কিনা সেটাও সন্দেহ! সন্দেহ বাতিকতা নিতান্তই একটি মানসিক ব্যধি ছাড়া আর কিছু নয়।
ঘরে থাকতে থাকতে নানা রকম শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও মনোদৈহিক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন অনেকেই। সেসব নিয়ে বিস্তারিত আর এখানে বলছি না। শারীরিক দূরত্ব যেন আমাদের মানসিক দূরত্বের কারণ না হয়, মনের সাথে মনের দূরত্ব যেন বাড়িয়ে না দেয়, সে বিষয়ে এখন চিন্তার সময় এসেছে।
হোম অফিস চালুর বদৌলতে রাতারাতি বিত্তশালী হয়ে উঠছে টেক জায়ান্টরা। কিন্তু মানুষ হারাচ্ছে তার সবচেয়ে বড় বিত্ত- ‘চিত্ত’। অনেকে ভাবছেন অফিস-খরচ তো কমছে। কিন্তু, শেষমেষ যে মূল্য দিতে বাধ্য হতে পারি আমরা, তা হয়তো অনেক বেশি হয়ে যাবে। বেশি দিন হোম অফিসের চর্চার ফলে দেহের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক অঙ্গ প্রত্যঙ্গের যে ক্ষতি হতে পারে তা অপূরণীয়। শরীর ও মনের স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে অনেক অর্থবিত্ত এক সময় অর্থহীন হয়ে যাবে। কারণ, বাস্তব সামাজিক যোগাযোগ ছাড়া, পরার্থপরতা ছাড়া, অন্যকে সেবা দেয়া ছাড়া মানুষের মন বিকশিত হয় না। তৃপ্তি পায় না। তাছাড়া, দৈনন্দিন জীবনে যন্ত্রের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা মানুষের প্রকৃত কল্যাণ করতে সক্ষম না।
অথচ মানুষ ক্রমশই যন্ত্র নির্ভর হয়ে পড়ছে। যন্ত্র নির্ভর জীবন মানুষের সুস্বাস্থ্যের জন্য মোটেই উপযোগী নয়। ঘরে বসে থাকার চেয়ে বরং স্বাভাবিক হেঁটে চলে বেড়ানোর ছন্দময় জীবন, সামাজিক মেলামেশার জীবনই মন ও শরীরের জন্য উপকারী। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে এই কথাগুলো আমাদের প্রায়ই বলতে হয়। রোগীদেরও শুনতে হয় বাধ্য হয়ে। তবু অধিকাংশ মানুষেরই যন্ত্রনির্ভর আরামের জীবনের দিকেই ঝোঁক। যন্ত্র নির্ভরতার দিকে ঝুঁকে পড়ার এই প্রবণতা রোধ করতে হবে। বিকল্প বের করতে হবে আমাদেরই।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর বহুল ব্যবহার হয়তো আপাত: দৃষ্টিতে কিছু কাজকে সহজ করেছে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটা জীবনকে মোটেই সহজ করতে পারবে না। বরং কঠিন করে দেবে, জটিল করে দেবে। করোনাকালে মানুষ অনেক যন্ত্রনির্ভর হয়েছে। শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে মানসিক দূরত্ব তৈরি করেছে। অমানবিকতার অনেক উদাহরণ আমরা দেখতে পাচ্ছি রোজই। মানসিকভাবে দূরে সরে যাওয়ার ফলেই যে মানবিকতা হারাচ্ছি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মানবিক গুণাবলী হারিয়ে ফেললে আমাদের হৃদযন্ত্রটিও যে তার কর্মক্ষমতা বহুলাংশে হারিয়ে ফেলবে তা যেন ভুলে না যাই। মনের ভেতর ভালোবাসা দয়া মায়া মমতা ইত্যাদি না থাকলে শুধু হৃদযন্ত্রই না, পুরো শারীরবৃত্তীয় ব্যবস্থাই ভেঙে যাবে। তাই মানুষে মানুষে মনের সম্মিলন ধরে রাখতে হবে।
সবারই মনে রাখা দরকার যে, সতর্ক থাকার মানে কাউকে অস্পৃশ্য বা অচ্ছ্যুত ভাবা নয়। সচেতন থাকার মানে কাউকে ঘৃণা করা নয়। করোনা পজিটিভ কাউকেই যেন আমরা অবহেলা বা ঘৃণা না করি। কাউকেই যেন কুকুরের মতো দূর দূর করে তাড়িয়ে না দেই। কাউকেই যেন রাস্তায় ফেলে দিয়ে চলে না যাই। সে আমার নিকটজন হোক অথবা দূরের কেউ হোক। আমাদের নিজ নিজ দায়িত্ব যেন আমরা পালন করি। স্বাস্থ্যবিধি ও সচেতনতা মেনেই যেন পালন করি। সে আমি চিকিৎসক হই কিংবা হই পুলিশ বা কোন স্বেচ্ছাসেবী। মানসিক দূরত্ব বাড়িয়ে আমাদের সামাজিক দায়িত্ব যেন এড়িয়ে না যাই, মানবিক কর্তব্য যেন ভুলে না যাই।
(লেখক- হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও সহযোগী অধ্যাপক, কার্ডিওলজি বিভাগ, খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।)
এনএস/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।