ঢাকা, শুক্রবার   ১৪ মার্চ ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

শিক্ষার অভাবে পথশিশুদের ভবিষ্যত কী হবে?

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৭:২৭, ১০ জুলাই ২০১৭ | আপডেট: ২১:৪৩, ১৪ জুলাই ২০১৭

Ekushey Television Ltd.

রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকার একটি বস্তিতে ২০১৬ সালের ১১ জুন ১৩ জন সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুকে শিক্ষাদানের লক্ষে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘জুম বাংলাদেশ স্কুল’।  রাজধানীর বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে পরবর্তী সময়ে গড়ে তোলা হয় ‘জুম বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন’নামের একটি সংগঠন। এই সংগঠনের ব্যানারে বর্তমানে গুলিস্তান ও পলাশীসহ তিনটি শাখায় আড়াই শতাধিক সুবিধাবঞ্চিত শিশুকে পাঠদান করা হচ্ছে। যার মধ্যে রয়েছে ঝরে পড়া শিক্ষার্থী, মাদকাসক্ত, বস্তি ও ছিন্নমূল শিশুরা।

স্কুলের সংগঠকদের আন্তরিকতা এবং অন্যান্য কর্মকাণ্ড সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের অভিভাবকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ফলে সন্তানকে দোকানে কিংবা কাগজ টোকানোর কাজে না দিয়ে স্কুলে পাঠানো শুরু করেন তারা। ফলে ধীরে ধীরে বাড়ছে স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রমের ব্যাপ্তি।

বর্তমানে স্কুলটিতে পাঠদান ও সহায়তা দেন সামান্তা,তানজিলা, মিজান, ফারজানা, আসিফ রিয়ন, রাজিব সরকার ও নুর মামুন। স্কুলে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের বিনা পয়সায় পড়ানোর পাশাপাশি শিক্ষা উপকরণ প্রদান, বিভিন্ন দিবস উদযাপন ও শিশুদের নিয়ে আনন্দ ভ্রমণ করেন সংগঠকরা।

সম্প্রতি জুম বাংলাদেশ স্কুলের প্রধান উদ্যোক্তা এসটি শাহীনের সঙ্গে কথা হয় ইটিভি অনলাইনের যুগ্ম বার্তা সম্পাদক ওয়ারেছুন্নবী খন্দকারের। সাক্ষাতকারের বিভিন্ন অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

ইটিভি অনলাইন : আপনিতো সাংবাদিকতা পেশায় ছিলেন হঠাৎ কী কারণে জুম বাংলাদেশ বা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা হলো?

আমি ২০১২ সালে থেকে সাংবাদিকতার সাথে জড়িত, কাজ করেছি বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালসহ নিউজ পেপারে। প্রথম থেকে একটা বিষয় খেয়াল করতাম, বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রতিনিয়তই প্রকাশ পেত পথ শিশুদের করুণ অবস্থা। তাদের থাকার জায়গা নেই, নোংরা পরিবেশে জরাজীর্ণ অবস্থায় তারা বেড়াচ্ছে রাস্তায়। খেতে পারছেনা দু’বেলা দু মুঠো খাবার। তাদের লেখাপড়ার ইচ্ছা থাকলেও পাচ্ছেনা সুযোগ। শিক্ষার অভাবে এই শিশুদের ভবিষ্যত কী হবে? এসব কিছু থেকেই মূলত: মনের মধ্যে এক ধরণের প্রেষণা কাজ করে যে সমাজের এই শিশুদের জন্য আমারও কিছু করার আছে ।

ইটিভি অনলাইন : কবে থেকে চিন্তা এবং কবে থেকে কাজ শুরু করলেন

চিন্তা শুরু তো ২০১২ সাল থেকেই। আমি সাংবাদিকতার পাশাপাশি বিভিন্ন জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক সংগঠনের সাথে জড়িত। এইসব সংগঠনে আমার নেতৃত্বে নিয়মিত বিভিন্ন ইভেন্ট হতো সমাজের ছিন্নমুল সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে। সেখান থেকেই মূলত একটি স্বতন্ত্র চিন্তাবোধ কাজ করে যে এই শিশুদের স্থায়ী সমস্যা সমাধানের জন্য আমাকে কিছু করতে হবে। এরপর ২০১৫ সালে জুম বাংলাদেশ নামে একটি প্লাটফম দাঁড় করাই। প্রথম দিকে আমরা ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্পটে পথশিশুদের খাবার, পোশাক ও শিক্ষা সমগ্রী বিতরণ করি জুম বাংলাদেশ এর ব্যানারে।

ইটিভি অনলাইন : প্রথম স্কুল প্রতিষ্ঠায় কী কী অভিজ্ঞতা কিংবা বাধার সম্মুখিন হতে হয়েছে

স্কুল হিসেবে জুম বাংলাদেশ এর যাত্রা শুরু হয় ২০১৬ সালের ১১ মার্চ সেগুনবাগিচায়। প্রথম দিকে অনেকটা বাধার সম্মুখীন হয়েছিলাম। যেমন যেখানে সেগুনবাগিচা শাখার ক্লাশ হয় ওখানকার স্থানীয় লোকজন আমাদের বিশ্বাস করতে পারছিল না। তারা ভেবে নিয়েছিল আমরা কোনো এক গ্রুপ তাদের সাথে প্রতারণা করতে পারি। তবে এখন অবশ্য তাদের এ ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ওই লোকগুলোই বিভিন্নভাবে এখন আমাদের সহযোগিতা করছে।

ইটিভি অনলাইন : জুম বাংলাদেশ স্কুলকে ফাউন্ডেশনে পরিণত করেছেন... নিয়ে ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী?

প্রথম দিকে শুধু ‘জুম বাংলাদেশ স্কুল’ নামেই এটির পরিচিত ছিল। এরপর আমরা এটিকে ‘এভারগ্রিণ জুম বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন’ নাম দিয়ে যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধক (আরজেএসসি) থেকে রেজিষ্ট্রেশন নিয়েছি যার নম্বর এস-12467. জুম বাংলাদেশ যে শুধু শিশুদের নিয়ে কাজ করে এ ধারণাও ভুল, স্কুলের পাশাপাশি বিভিন্ন হাসপাতালে মুমূর্ষ রোগীদের আমরা রক্ত ম্যানেজ করে দেই। জুম বাংলাদেশ ব্লাড ডোনেশন টিম নামে ভলান্টিয়ারদের নিয়ে আমাদের বিশাল একটি টিম আছে। টিমের সদস্যরাই মূলত: এ কাজগুলো করে থাকেন। এছাড়াও আমরা বিভিন্ন সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান করে থাকি। জুম বাংলাদেশ নিয়ে ভবিষ্যত পরিকল্পনা সূদুর প্রসারী। আমাদের টার্গেট আছে ঢাকার বাহিরে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় একটি করে স্কুল প্রতিষ্ঠা করা, সেখানে ওই সব অঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা লেখাপড়া করার সুযোগ পাবে। পাশাপাশি ঢাকায় একটা শেল্টার হোম করা যেখানে শিশুরা সবসময় থাকবে, আমরা তাদের হাতেকলমে গড়ে তুলব। নিশ্চিত করব তাদের সুন্দর ভবিষ্যত। তবে বর্তমানে জুম বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের নিজস্ব কোনো অফিস নেই। সম্প্রতি একটি ভাড়া করা অফিসে সাংগঠনিক কিছু কাজকর্ম চলছে। সেখানে শিশুদের পাঠদান করানো হচ্ছে কক্ষের কোণায় মাটিতে পাটি বিছিয়ে।

ইটিভি অনলাইন : পড়ালেখা শেষে শিশুদের খাবার দেওয়া হয়,কোথা থেকে আসে টাকা?

খাবারটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই সব শিশুদের কাছে। খাবার দিলে বাচ্চারা পড়তে আসে, না দিলে স্কুলে তাদের উপস্থিতি কমে যায়। তাই আমরা চেষ্টা করি প্রতিটি ক্লাশ শেষে ওদেরকে পুষ্টিকর খাবার দেওয়ার। খাবারের টাকাটা আমরা নিজেরাই সংগ্রহ করি স্বেচ্ছাসেবকদের কাছ থেকে। পাশাপাশি আমাদের খুব কাছের কিছু বড় ভাই আছেন যারা ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে জড়িত। তারা আমাদের এ ব্যাপার কিছুটা সহযোগিতা করেন। তবে মাঝেমাঝে টাকার অভাবে দুই টাকার বিস্কুট দিয়েও চালিয়ে নিতে হয়।

ইটিভি অনলাইন : যারা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছেন তাদের সামান্য কিছু সন্মানি দেওয়া হয়, সেটা জোগান দেন কীভাবে?

স্বেচ্ছাসেবকদের টাকা দেওয়া হয় এ ধারণা ভুল। জুম বাংলাদেশ তার কোনো ভলান্টিয়ারদের টাকা দেয় না। এটি একটি অলাভজনক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। তবে যারা নিয়ামিত ক্লাশ নেন অর্থাৎ শিক্ষক তাদেরকে যাতায়াত ভাতা দেওয়া হয়। মূলত: এ কনভেন্সটাও আসে স্বেচ্ছাসেবীদের কাছ থেকে। আমাদের ভলান্টিয়ার আছে ৩০০ জনেরও বেশি। তারা সবাই বিভিন্ন কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এ ভলান্টিয়াররাই মূলত তাদের লেখাপড়ার খরচ বাঁচিয়ে প্রতিমাসে ৫০/১০০ টাকা জমা দেন জুম বাংলাদেশের কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার জন্য।

ইটিভি অনলাইন : এখন কতগুলো আউটলেটে কতগুলো শিশু লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে?

জুম বাংলাদেশ স্কুলের মোট তিনটি শাখায় (সেগুনবাগিচা, গুলিস্তান, পলাশী) প্রায় ২৫০ জন শিশু লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে। শাখাগুলোতে জুম বাংলাদেশ থেকে শিশুদের নিয়মিত লেখাপড়া করানো হয়। পাশাপাশি ওদের শিক্ষা সামগ্রীও বিনামূল্য বিতরণ করা হয়। প্রতিদিন বিকাল ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্ত চলে ক্লাশ।

ইটিভি অনলাইন : স্বেচ্ছাসেবীদের আগ্রহ এবং প্রতিক্রিয়া কি রকম?

ভলান্টিয়াররা অনেক আগ্রহ নিয়েই জুম বাংলাদেশে নিয়মিত আসা-যাওয়া করেন। শিশুদের সাথে সময় কাটাতে সবার ভালো লাগে। পাশাপাশি ওদের শেখাতে পেরে সবাই আনন্দিত। দিনদিন আমাদের ভলান্টিয়ার সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের বিভিন্ন ইভেন্টগুলোতে তারা সক্রিয় থাকেন। এছাড়া জুম বাংলাদেশ ভলান্টিয়ারদের জন্য একটি প্লাটফর্ম হিসেবে রূপ ধারণ করেছে। এখান থেকে তারা নীতিনৈতিকতা সম্পর্কে ধারণা পান। ঢাকার বাহিরেও আমাদের ভলান্টিয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ইটিভি অনলাইন : কোনো ধরণের ঝামেলা কিংবা অসহযোগিতার সম্মুখিন হতে হয় কী? হলে কীভাবে মোকাবিলা করেন?

চলতে হলে তো ঝামেলা থাকবেই, আর ভালো কাজে বাধা বেশি এটা আমরা সবাই জানি। প্রতিনিয়তই টুকটাক ঝামেলা হয়। প্রথমে শিশুদের লেখাপড়া শেখানোর কথা বললে অভিভাবকরা ভুল বোঝেন। তবে পরবর্তীতে যখন তাদেরকে বোঝানো হয় তখন অবশ্য তারা এটাকে ইতিবাচক হিসেবে নেন।  

ইটিভি অনলাইন : সব সময় মানুষ দান করবে এমনটা নাও হতে পারে, তাই জুম বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিষয়টি কীভাবে নিশ্চিত করবেন?  

আজ থেকে ২/১ বছরের মধ্যে জুম বাংলাদেশ চলবে নিজস্ব অর্থায়নে। এ নিয়ে আমরা কাজ শুরু করে দিয়েছি। কুটির শিল্প ও ক্ষুদ্র শিল্প নিয়ে কিছু ব্যবসায়িক পরিকল্পনা করছি। সেখানে আমরা উদ্যোক্তারা ভলান্টিয়ারদের সাথে নিয়ে এ কাজটি করব। এতে করে ভলান্টিয়াররা উপকৃত হবেন আর ব্যবসার লভ্যাংশ ব্যয় হবে জুম বাংলাদেশ এর কর্মকাণ্ডে। এছাড়া জুম বাংলাদেশ বলপেন নামে আমাদের একটি কলমের ব্যবসা ছিল, তবে সেটি বন্ধ আছে। এ ব্যবসাটাও চালু করার উদ্যোগ নিয়েছি।

ইটিভি অনলাইন : সাধারণত: অভিভাবকরা চান তাদের সন্তান চাকু্রি করুক, প্রতিষ্ঠিত হোক, কিন্তু জুম বাংলাদেশ নিয়ে আছেন আপনিপরিবারে কোনো সমস্যা হয় না? তারা কীভাবে দেখছেন বিষয়টি?

মানুষের সবচেয়ে বড় সাপোর্ট তার পরিবার। পরিবার যদি সাপোর্ট করে তাহলে যে কোনো অসাধ্য কাজ সহজভাবেই করা যায়। এখানে আমি অনেক হ্যাপি, আমার পরিবার বিশেষ করে বাবা-মা-ভাই সবাই আমাকে অনেক উৎসাহ দেন। চাকুরির বিষয়টি আমি আপাতত মাথায় আনছি না। আমি এখনও ছাত্র, ঢাকা কলেজ থেকে মার্স্টাস করছি। পড়াশুনা শেষে ব্যবসা করার পরিকল্পনা আছে। আর জুম বাংলাদেশ ঘিরেই মূলত: সব স্বপ্ন দেখি।


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি