ঢাকা, রবিবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

শিল্পায়ন ও অবকাঠামো উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু

ড. শামসুল আলম

প্রকাশিত : ১০:১৮, ১৭ মার্চ ২০২১

জন্মদিনের স্মৃতি তর্পণে আজকে ভারাক্রান্ত হূদয়ে স্মরণ করি বঙ্গবন্ধুকে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ বিনির্মাণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রধান লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের মানুষকে একতাবদ্ধ করে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের মাধ্যমে আর্থসামাজিক সমৃদ্ধি অর্জন করা। উল্লেখ্য, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ছিল মাত্র ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা এখন ৩৩০ বিলিয়ন ডলার। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল শূন্য। ১৬ ডিসেম্বর অপরাহ্নে আত্মসমর্পণের আগে হানাদার বাহিনীর প্রশাসন পাকিস্তান স্টেট ব্যাংকের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সব ছাপানো টাকা বাইরে এনে আগুনে পুড়িয়ে ছিল। দেশ ছিল কপর্দকশূন্য। তথাপি বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নেতৃত্বের জোরে যুদ্ধবিধ্বস্ত ভঙ্গুর অবকাঠামো ও অপ্রতুল প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ-সুবিধা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতি ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে শুরু করে। কার্যকরভাবে এ দায়িত্ব পালনে প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গঠনের ওপর অগ্রাধিকার দিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২ দেশে ফেরার ১৮ দিনের মাথায় ৩১ জানুয়ারি, ১৯৭২ ‘বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন’ প্রতিষ্ঠা করেন। স্মর্তব্য, ভারত স্বাধীন হওয়ার তিন বছর পর ১৯৫০ সালে এবং পাকিস্তানে ১৯৫৩ সালে পরিকল্পনা কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথনির্দেশক হিসেবে পরিকল্পনা কমিশন প্রতিষ্ঠার এক বছরের কম সময়ের মধ্যেই প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৭৩-১৯৭৮) প্রণীত হয়।   

প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন ছিল সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাষ্ট্রচালিত শিল্পমুখী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর ব্যাংক, বীমাসহ গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক ও ম্যানুফ্যাকচারিং প্রতিষ্ঠানগুলো সফলভাবে পরিচালনার উদ্দেশ্যে জাতীয়করণ করা হয়। আর এর ফল ছিল চমকপ্রদ। দেশ স্বাধীনের এক বছরের মধ্যেই প্রায় বিধ্বস্ত পাটকলগুলো এর মোট উৎপাদন ক্ষমতার ৫৬ শতাংশ কাজে লাগাতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে টেক্সটাইল, কাগজ ও সার কারখানাগুলোর ক্ষেত্রে এ অনুপাত গিয়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৬০, ৬৯ ও ৬২ শতাংশে, যা ছিল পাকিস্তান আমলের চেয়েও বেশি।

প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা মেয়াদে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, সে অনুযায়ী কৃষি, প্রাণিসম্পদ, বন ও মত্স্য সম্পদ খাতে ভিত্তি বছরের (১৯৬৯-৭০) তুলনায় ৪ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করা হয়। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সামষ্টিক অর্থনীতিতে অভীষ্ট গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৫। ম্যানুফ্যাকচারিং ও অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় যথাক্রমে ৭ দশমিক ১ এবং ১২ দশমিক ১ শতাংশ। অন্যদিকে ওই পরিকল্পনা মেয়াদে জিডিপিতে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের অবদান প্রায় ১১ শতাংশের কাছাকাছি প্রাক্কলন করা হয়, যার মূল চালিকাশক্তি হিসেবে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পকে ব্যাপকভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অবকাঠামো নির্মাণ খাতে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে মর্মে বিস্তারিত নীতি ও উন্নয়ন কৌশল গৃহীত হয়। এ খাতে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে ওই পরিকল্পনা মেয়াদের মোট বিনিয়োগের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বরাদ্দ দেয়া হয়। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দেশজ বিনিয়োগের সিংহভাগ অংশ সেচ, ড্রেনেজ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, আশ্রয়ণসহ অবকাঠামো বিনির্মাণে ব্যয় করার পরিকল্পনা গৃহীত হয়, যা ছিল স্বাধীনতা-পূর্বকালের তুলনায় অনেক বেশি। যদিও বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাত পুঁজিনির্ভর খাত, তথাপি বঙ্গবন্ধু অন্যান্য শিল্পের প্রসারের লক্ষ্যে এ খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। শিল্পায়নের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা মেয়াদের মোট বিনিয়োগের প্রায় ২০ শতাংশ অংশ শিল্প-কারখানা নির্মাণ ও উন্নয়নের জন্য স্থির করা হয়। শিল্প খাতের ভেতর থেকে পেট্রোলিয়াম রিফাইনারি শিল্প বাদ পড়লেও কোল্ড স্টোরেজ, টেলিফোন ও কেবল ফ্যাক্টরি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। স্বাধীনতা-উত্তরকালে রাষ্ট্রের দায়দায়িত্বেই শিল্পায়ন ও অবকাঠামো তৈরি শুরু হয়েছিল। সে সময়ে দেশের মোট বিনিয়োগের ৮৯ শতাংশই আসত সরকারি বিনিয়োগ থেকে, বেসরকারি বিনিয়োগের অংশ ছিল মাত্র ১১ শতাংশ। শুরুতে আমাদের মাথাপিছু আয় ছিল ৯০ মার্কিন ডলার।   

স্বাধীনতা যুদ্ধের অব্যবহিত পর দেশের অর্থনীতিতে ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের অবদান ছিল জিডিপির ১০ শতাংশ। তার মধ্যে ভারী শিল্পের অবদান ছিল ৬ শতাংশ এবং অবশিষ্ট অংশের মধ্যে ছিল ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প। ১৯৬৮-৬৯ সালে নিবন্ধিত মধ্যম ও ছোট ফ্যাক্টরির সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ১৩০, যার মধ্যে ৭৯১টি টেক্সটাইল, ৫৭৬টি কেমিক্যাল, ৪০৬টি ফুড প্রসেসিং, ২৫৭টি মেটাল দ্রব্য এবং ১৪৯টি চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান উল্লেখযোগ্য ছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এসব কারখানা বিধ্বস্ত অথবা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ক্ষতিপূরণের লক্ষ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশন কর্তৃক প্রণীত প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দেশের অভ্যন্তরীণ ফ্যাক্টরিগুলোকে সচলের লক্ষ্যে ২৯ দশমিক ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এছাড়া পাকিস্তানি শোষকগোষ্ঠী কর্তৃক পরিত্যক্ত ফ্যাক্টরিগুলো পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে সরকার পাটকল, টেক্সটাইল মিল, চিনিকল, স্টিল মিল, প্রকৌশল ও জাহাজ নির্মাণ কারখানা, কাগজকল, সার কারখানা, কেমিক্যাল ফ্যাক্টরিসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ শিল্প-কারখানা রাষ্ট্রায়ত্তকরণ করে নেয়। দেশের শিল্পায়নের গতি অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে স্বাধীনতাপূর্ব ও পরবর্তী সময়ে বন শিল্প উন্নয়ন করপোরেশন, ক্ষুদ্র শিল্প করপোরেশন, মত্স্য উন্নয়ন করপোরেশন, ট্যানারি করপোরেশন ও কুটির শিল্প করপোরেশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান স্থাপন এবং পুনর্গঠন করা হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃস্থাপনসহ ভৌত অবকাঠামো ও কৃষি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে বঙ্গবন্ধুই কৃষি উন্নয়নের সামগ্রিক ভিত্তি তৈরি করে গিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পরপর বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, বিএডিসি, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট পুনর্গঠন, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট ও পারমাণবিক কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ইত্যাদি স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।   

স্বাধীনতার ঠিক পরপর শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়। দক্ষ অভিজ্ঞ মানবসম্পদ বলতে কিছু ছিল না। ছিল প্রাতিষ্ঠানিক ও পরিচালনাগত সমস্যা, উপযুক্ত শ্রমিকের অভাব, ব্যাকওয়ার্ড ও ফরোয়ার্ড লিংকেজ সমস্যা, পর্যাপ্ত বিদ্যুতের অভাব, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে চলতি মূলধনের ঘাটতি ও অন্যান্য আর্থিক অসচ্ছলতা, পরিবহনগত সমস্যা প্রভৃতি। এসব প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় শিল্পোন্নয়নের লক্ষ্যে নিম্নোক্ত পরিকল্পনা গৃহীত হয়: ১। অভ্যন্তরীণ সম্পদের পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার নিশ্চিত করা; ২। ক্যাপিটাল পণ্য শিল্পের প্রসারের মাধ্যমে একটি দক্ষ ব্যাকওয়ার্ড ও ফরোওয়ার্ড লিংকেজ প্রতিষ্ঠা; ৩। গবেষণার মাধ্যমে শিল্প খাতে দেশীয় প্রযুক্তির প্রসার ঘটানো; ৪। বেসরকারি খাতের দক্ষতা বৃদ্ধিতে ক্ষুদ্র, কুটির ও গ্রামীণ শিল্পের বিকাশ; ৫। স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে রফতানিমুখী ও আমদানি বিকল্প শিল্পের প্রসার এবং ৬। দেশের সব অঞ্চলে সুষমভাবে শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা।

আর এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গৃহীত কর্মকৌশলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কৌশলগুলো ছিল নিম্নরূপ: ১। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের বিদ্যমান সমস্যা দূর করে রাষ্ট্রীয় খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো আরো সুসংগঠিত করে তোলা; ২।  বেসরকারি খাতকেও সব সুযোগ-সুবিধা ও সহযোগিতা প্রদান; ৩। বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রবাহ বাড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ; ৪। শ্রমনির্ভর প্রযুক্তি এবং বিশেষ ক্ষেত্রে মূলধননির্ভর আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার; ৫। শিল্প-কারখানার উৎপাদন ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা;

অবকাঠামোগত উন্নয়নের ব্যাপারে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী উন্নয়ন অবকাঠামোয় সড়ক, জনপথ ও পরিবহন খাতের উন্নয়ন বিশেষ অগ্রাধিকার পেয়েছিল। উল্লেখ্য, স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে দেশে বিদ্যমান ৪ হাজার ৬৫৬টি সেতু ও কালভার্টের মধ্যে প্রায় ২৭৪টি সেতু ও কালভার্ট সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। ধ্বংস করা হয় ৪ হাজার ২৪৪টি ট্রাক, ১ হাজার ৯৫২টি বাস এবং অসংখ্য নৌযান। এ অবস্থা মোকাবেলা করার লক্ষ্যে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় চলমান অবকাঠামোগত উন্নয়ন কার্যক্রম সম্পন্নকরণ, প্রয়োজনীয়সংখ্যক সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ, পরিবহন যানের মানোন্নয়ন এবং নতুন অবকাঠামো উন্নয়নের বিষয়ে বিশেষ জোর দেয়া হয়। এছাড়া কম খরচে আধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থা চালুর ব্যাপারেও প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়। সড়ক ও পরিবহন খাতের উন্নয়নে ওই পরিকল্পনায় মোট ১০৪ দশমিক ৬৮ কোটি টাকার বরাদ্দ দেয়া হয়। কৌশলগত পরিকল্পনা হিসেবে সড়ক ও জনপথ বিভাগের ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি, সড়ক ও পরিবহন খাত-সংশ্লিষ্ট উপাত্তের সহজ প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার বিষয়ে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়। এছাড়া বিদ্যমান ডকইয়ার্ড ও পোর্ট, নৌযান, বিমান যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন, বিমানবন্দর স্থাপন এবং সমুদ্রবন্দর মাইন মুক্ত করা প্রভৃতি বিষয়েও বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দেশের বৈদ্যুতিক অবকাঠামো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৭১-এ কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা ছিল প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। দেশের প্রায় সব বৈদ্যুতিক গ্রিড লাইন, ১২৫-এর অধিক ট্রান্সমিশন লাইন, গ্রিড স্টেশন, ডিস্ট্রিবিউশন লাইন ও সাবস্টেশন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। যুদ্ধের পরপরই এসব অবকাঠামো পুনর্নির্মাণের ব্যাপক কর্মযজ্ঞ গ্রহণ করা হয় শিল্পায়নের ভিত্তি হিসেবে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়। বৈদ্যুতিক অবকাঠামো বিনির্মাণে ওই পরিকল্পনায় গৃহীত নীতি-কৌশল নিম্নরূপ: ১। দেশের সব স্থানে বিদ্যুৎ সরবরাহের ঘাটতি দূর করা এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা; ২। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ডিস্ট্রিবিউশন ব্যবস্থার মধ্যে ভারসাম্যহীনতা হ্রাস করা; ৩। গ্রামীণ বিদ্যুতায়নের আওতা বৃদ্ধি করা; ৪। দেশের পশ্চিমাঞ্চলে বৈদ্যুতিক উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে পশ্চিমাঞ্চলের বৈদ্যুতিক সংযোগ স্থাপন; ৫। বৈদ্যুতিক সরবরাহ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন।

অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের সাধারণ ও সুবিধাবঞ্চিত জনগণের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দলিলে। এ আশ্রয়ণ শুধু বাসস্থান নয়; বরং বাসস্থানের সঙ্গে পানি সরবরাহ ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা, ময়লা নিষ্কাশন, বিদ্যুৎ, পরিবহন, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও বিনোদনের সুবিধা-সংবলিত অবকাঠামো এবং বাজারের সৃষ্টি নিশ্চিত করা হয় প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে।

স্বাধীনতার শুরুতে অর্থভাণ্ডার ছিল শূন্য, তা সত্ত্বেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে, দৃঢ় মনোবল নিয়ে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের ভিত তৈরি করে বাঙালি জাতির কাছে একটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে গিয়েছেন। সেই উত্তাল সময়ে এ দলিল ছিল বাঙালি জাতির দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক ও অন্যান্য বঞ্চনা দূরীকরণের প্রধান হাতিয়ার। এ পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ ১৯৭১-৭২-এর যুদ্ধবিধ্বস্ত ভঙ্গুর অর্থনীতির চাকা সচল করতে সক্ষম হয়েছিল। উল্লেখ্য, ১৯৭১ ও ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ছিল যথাক্রমে ৭ দশমিক ৬৮ এবং ৬ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ (সূত্র: ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট ইন্ডিকেটর, বিশ্বব্যাংক), যা ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে ১২ দশমিক ১১ এবং ১৩ দশমিক ৩৭ শতাংশে উন্নীত হয়। একই সময়ে জিডিপিতে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের অবদান গড়ে ৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৮ দশমিক ৮৯ শতাংশে পৌঁছে। এটি প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রথম আড়াই বছরের সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের জাতির পিতার হূদয়বিদারক অন্তর্ধানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সার্বিক আর্থসামাজিক উন্নয়নের গতিশীলতা পরবর্তী প্রায় দুই দশকের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়।   
ড. শামসুল আলম: অর্থনীতিবিদ ও সদস্য (সিনিয়র সচিব)

সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ, পরিকল্পনা কমিশন


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি