শিল্পের টেকসই উন্নয়নে পরিবেশ দূষণ কমানোর আহ্বান
প্রকাশিত : ২২:৪০, ২০ এপ্রিল ২০১৯ | আপডেট: ২২:৫০, ২০ এপ্রিল ২০১৯
দেশের প্রধান রপ্তানি খাত পোশাক শিল্পকে আরও টেকসই করতে উন্নত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দূষণ কমানোর আহ্বান এসেছে একটি আলোচনা অনুষ্ঠান থেকে। শনিবার ঢাকার ব্রাক সেন্টারে অ্যাকশনএইড এবং ফ্যাশন রেভোলিউশন আয়োজিত ‘ভয়েসেস অ্যান্ড সল্যুশনস’ শীর্ষক সেমিনারে গত এক দশকে দেশীয় পোশাক শিল্পের অনেক সংস্কার উদ্যোগও আলোচনায় আসে।
অনুষ্ঠানে পোশাক শিল্পে পানি ও পরিবেশ দূষণ নিয়ে আয়োজকদের কয়েকটি তথ্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন কারখানা মলিকরা। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর চলমান সংস্কার প্রক্রিয়ার সুফল হিসেবে গড়ে ওঠা বিভিন্ন পরিবেশ বান্ধব কারখানার বিষয়টি তুলে ধরেন তারা।
অ্যাকশনএইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, শিল্পের ক্রমাগত বিকাশের ফলে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সম্পদের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আবার উৎপাদিত বর্জ্যের কারণে প্রতক্ষ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ।
বিশেষজ্ঞরা এই পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, এখনই টেকসই উৎপাদন ও ভোগ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা দরকার। পরিবেশের উপর পোশাক শিল্পখাতের এই নেতিবাচক প্রভাব কমাতে উদ্ভাবনী উদ্যোগ ও প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শিল্প কলকারখানার পানি, জ্বালানী ব্যবহার হ্রাস করে বর্জ্য নিষ্কাশন কমানো প্রয়োজন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে একশনএইড বাংলাদেশ-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির পোশাক খাত কিভাবে পরিবেশের উপর প্রভাব ফেলছে তার উপর একটি প্রবন্ধ উপপস্থান করেন। প্রবন্ধে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাণিজ্য খাত ফ্যাশন শিল্প। যেটি পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দূষণকারী খাত। একইসাথে এটি সারা বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পানি ব্যবহারকারী খাত। অপরদিকে, শুধুমাত্র এই একটি খাত থেকেই বিশে^র ২০ শতাংশ বর্জ্য পানি এবং ১০ শতাংশ কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ হয়।
প্রবন্ধে বলা হয়, শিল্প কারখানার সকল ক্ষেত্র, যেমন কাটা, বয়ন, সেলাই, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং তৈরী পোশাক উৎপাদন বায়ূ, পানি এবং মাটি দূষণ করে থাকে। বেশিরভাগ কারখানা নদীর তীরে অবস্থিত হওয়ায় তাদের বর্জ্য নদীতে ফেলা হয়। ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স কর্পোরেশনের এক গবেষণা মতে, প্রতিবছর পোশাক শিল্প কারখানায় পোশাক ও তুলা ধৌতকরণ এবং রঙ এর কাজে ১৫শ বিলিয়ন লিটার পানি ব্যবহার করা হয়। কারখানাগুলো ব্যবহারের পর এই বিষাক্ত পানি নদী এবং খালে নিষ্কাশন করে।
এ প্রসঙ্গে ফারাহ্ কবির বলেন, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পখাত দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখলেও, পরিবেশের জন্য এটি উদ্বেগজনক। পানি দূষণের ফলে একদিকে কমছে মাছের সংখ্যা অপরদিকে হ্রাস পাচ্ছে চাষের উপযোগী জমি। বেশিরভাগ স্থানীয় কৃষক ও মৎস্যজীবীদের জীবিকা এখন ঝুঁকিপূর্ণ। পরিস্থিতি সামাল দিতে সব পক্ষকে একসাথে কাজ করতে হবে।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও বিজিএমইএ-এর সাবেক সভাপতি আতিকুল ইসলাম বলেন, সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিল্পকারখানা হতে নিষ্কাশিত বর্জ্যরে পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে। জলাশয়কে ডাস্টবিন হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থাকে করতে হবে আরো উন্নত।
মেয়র আরো বলেন, রানা প্লাজা ধ্বসের পর বাংলাদেশের শিল্প খাতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। তবে, অংশীদারদের মধ্যেই এখনো সচেতনতার অভাব রয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য বাস্তবায়নে পোশাক শিল্পখাতে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করতে হবে। নিজেদের দায়িত্ব না এড়িয়ে নিজেদের ব্যবহারে ও মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। জোর দিতে হবে গবেষণায় এবং শিক্ষাব্যবস্থায় টেকসই উৎপাদন ও ব্যবহারের বিষয় অন্তর্ভুক্তকরণে।
অনুষ্ঠানের ধারণাপত্রে বলা হয়, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় গত দুই দশকে ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাণ ব্যাপক মাত্রায় হ্রাস পেয়েছে। অতিরিক্ত ব্যবহার এবং নগরীকরণের কারণে পুনরায় পানি সরবরাহের অভাবই হলো এর মূল কারণ। ঢাকার পানি সরবরাহের প্রায় ৮২ শতাংশই ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীল। পানির এই বিশাল চাহিদা পূরণের জন্য, ভূ-পানির স্তর প্রতি বছর ২-৩ মিটার পরিমাণে হ্রাস পাচ্ছে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, যদি পর্যাপ্ত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হয় তবে ২০৫০ সালের মধ্যে ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাণ কমে গিয়ে ১১০ থেকে ১১৫ মিটারে নেমে আসবে। এছাড়া পোশাক শিল্পের বর্জ্য হতে নির্গত মিথেন বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। পোশাক প্রক্রিয়াকরণে ব্যবহৃত রাসায়নিক রং মাটির সঙ্গে মিশে ভূপৃষ্ঠ এবং ভূগর্ভস্থ পানি দূষিত করে।
কিউটেক্স সল্যুশনস লিমিটেড-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাহুরা খানম বলেন, বর্জ্য নিষ্কাশন শুধু পরিবেশ দূষণই করছে না বরং জ্বালানী খরচ বৃদ্ধি করছে। বর্তমানে গড়ে অধিকাংশ কারখানার জ্বালানী দক্ষতা মাত্র ২০-২৫ শতাংশ। শিল্পকারখানার এই নেতিবাচক প্রভাব রোধে সরকার, নগর কর্তৃপক্ষ এবং শিল্প কারখানাসমূহের ভালো উদ্যোগগুলো সমন্বয়ের অভাবে সঠিকভাবে কার্যকর হচ্ছে না।
বিজিএমইএ-এর সদ্য নির্বাচিত পরিচালক জনাব শরীফ জহির বলেন, কাঁচামাল দক্ষতার সাথে ব্যবহার করলে বর্জ্যরে পরিমাণ আরো কমিয়ে আনা সম্ভব। পানি ও জ্বালানী ব্যবহার কমিয়ে এনে বর্জ্য নিষ্কাশনের হার হ্রাস করার লক্ষ্যে আরো কাজ করা জরুরি। প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এক্ষেত্রে ভালো উদ্যোগগুলো সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া জরুরি। পরিবেশবান্ধব মেশিন ব্যবহারসহ ভালো উদ্যোগগুলো প্রচারের মাধ্যমে অংশীদারদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করে এই সমস্যার সমাধানের দিকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।
বিজিএমইএ-এর সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ফারুক হাসান জানান, “বর্জ্য নিষ্কাশনের পরিমাণ কমিয়ে আনতে আমরা কাজ করছি। এজন্য কর্মচারী ও শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। এজন্য আরো উন্নয়ন ও বিনিয়োগ দরকার।”
ঢাকা চেম্বার অফ কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি-এর সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহিম বলেন, সমমানের বিকল্প খাতের অভাবে আগামী ১০-১৫ বছর এই শিল্পখাতের উপর নির্ভর করেই বাংলাদেশকে এগোতে হবে। বিজিএমইএ টেকসই পণ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ ও গবেষণা কার্যক্রমে গুরুত্ব দিচ্ছে। উৎপাদনের সাথে ব্যবসায়িক চাহিদার সমন্বয় ঘটাতে হবে। একইসাথে, পরিবেশ রক্ষা, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করবে এই সংগঠন।
ফ্যাশন রিভোলিউশন-এর কান্ট্রি কো-অর্ডিনেটর নওশীন খায়ের, সবার আগে সকলের মানসিক পরিবর্তন জরুরি। সম্প্রতি অনেক নতুন ব্র্যান্ড টেকসই উৎপাদন এবং ব্যবহারে উৎসাহী হচ্ছে।
ইউল্যাব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমরান রহমান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের উচিৎ তাদের নীতিমালায় টেকসই উৎপাদন ও ব্যবহারের উপর জোর দেওয়া। এখন পর্যন্ত ফ্যাশন শিল্প নিয়ে নীতিমালা তৈরির জন্য পর্যাপ্ত তথ্য উপাত্ত নেই। তাই আরো বেশি গবেষণার প্রয়োজন।
পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. সুলতান আহমেদ দিনব্যাপি এই আলোচনার দ্বিতীয়ভাগে বলেন, দেশের কারখানাগুলোর পরিবশ বিষয়ক তদারকি ব্যবস্থাপনা আছে। তবে তদারকির জন্য যথেষ্ট লোকবল নেই। আমাদের পরিবেশ রক্ষার জন্য প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনা। একইসঙ্গে দরকার সকলের মানসিকতার পরিবর্তন।
আয়োজকরা প্রবন্ধে বলেন, বর্তমানে সমস্ত শিল্প কর্মসংস্থানের ৪৫ শতাংশই হয় পোশাক এবং টেক্সটাইল খাতে, যা মোট জাতীয় আয়ের ৫ শতাংশ। দেশে রপ্তানি আয়ের ৭৮ শতাংশ আসে এই খাত থেকে। এই খাত, যেখানে কাজ করছে দেশের ৪ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ, তার পরিচালনার ফলে পরিবেশের উপর যে নেতিবাচক প্রভাব, তা বিবেচনা করে এই শিল্পকে টেকসই করার প্রতি মনোযোগ দেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে দাড়িয়েছে।
আর তাই এই সেমিনার এ আলোচনার মধ্য দিয়ে একটি প্লাটফর্মের সূচনা করা হয় যেখানে ফ্যাশন শিল্পখাতের অংশীদারগণ তাদের সমস্যা ও চ্যালেঞ্জসমূহ নিয়ে কথা বলবেন এবং অভিজ্ঞতার আলোকে প্রাপ্ত সমাধান তুলে ধরবেন সকলের সামনে।
আরকে//
আরও পড়ুন