ঢাকা, শুক্রবার   ১০ জানুয়ারি ২০২৫

শিশুদের করোনা ঝুঁকি কতটা

 ডা. মনজুর হোসেন 

প্রকাশিত : ১১:১৩, ১২ আগস্ট ২০২১

তরঙ্গ বা ঢেউ মহামারির একটি স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য এবং প্রতিটি ঢেউ বিপুলসংখ্যক মানুষকে আক্রান্ত করে। ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ নামে অভিহিত মহামারিটি ‘এইচ১এন১ ইনফ্লুয়েঞ্জা এ’ ভাইরাসের কারণে একটি অস্বাভাবিক ও মারাত্মক ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারি ছিল। এমনকি সেই ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ মহামারিতেও তরঙ্গ ছিল।

১৯১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া ওই মহামারির সময় চারটি তরঙ্গ দেখা গিয়েছিল এবং তা ৫০ কোটি মানুষকে সংক্রমিত করেছিল, অর্থাৎ তৎকালীন বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সংক্রমিত হয়েছিল। মৃতের সংখ্যা ২০ কোটির বেশি বলে অনুমান করা হয়। যদিও এ ধারণাটি রক্ষণশীল এবং অনেকের ধারণা মৃতের সংখ্যা আরও বেশি ছিল। এটি ছিল মানব ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক মহামারিগুলোর একটি। তাই বর্তমানে করোনা মহামারিতেও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।

ভাইরাসের এ তরঙ্গ বা ঢেউয়ের কারণগুলোর একটি হলো ভাইরাসজনিত এবং দ্বিতীয়টি হলো মনুষ্য-সম্পর্কিত। ভাইরাসটির নিজস্ব রূপান্তর (মিউটেশন) আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আর দ্বিতীয়টি আমরা আমাদের আচরণ ও শিষ্টাচার অনুসরণের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।

দেশে কোভিড-১৯-এর প্রথম ঢেউয়ের পর আমরা দ্বিতীয় ঢেউয়ের কবলে ছিলাম। দ্বিতীয় ঢেউ কমতে না কমতেই তৃতীয় তরঙ্গ হানা দিয়েছে। এ কারণে এখন কয়েকটি আশঙ্কা দেখা দিয়েছে- ১. তীব্রতা ও ভয়াবহতা আরও উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে এবং ২. শিশুরা ব্যাপকহারে সংক্রমিত হতে পারে। ইতোমধ্যেই এর আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

কোভিড-১৯-এর প্রথম তরঙ্গে প্রাথমিকভাবে প্রবীণ ও দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থ ব্যক্তিদের মধ্যে আক্রান্তের হার ও তীব্রতা বেশি ছিল। কিন্তু শিশুদের মাঝে আক্রান্তের হার ছিল খুবই কম। দ্বিতীয় তরঙ্গে বেশিসংখ্যক অল্প বয়সি ব্যক্তি (৩৫-৪৫ বছর) ও শিশুদের দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতা ছাড়াও গুরুতর রোগে আক্রান্ত হতে দেখা গেছে।

তথ্যানুযায়ী, ১৮ বছরের কম বয়সি শিশুরা প্রায় ৮.৫ শতাংশ আক্রান্ত হয়েছে। তাদের বেশির ভাগ সাধারণত হালকা রোগে ভুগেছে, তবে কেউ কেউ গুরুতর অসুস্থও হয়েছে। যদিও শিশুদের মৃত্যুর হার অন্যান্য বয়সের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম ছিল। অর্থাৎ শিশুরা প্রাপ্তবয়স্কদের মতো সংক্রমিত হলেও গুরুতর রোগাক্রান্ত হচ্ছে না। সংক্রমিত শিশুদের খুব অল্পসংখ্যকের মাঝারি-গুরুতর রোগ হতে পারে। শিশুদের প্রায় ৯০ শতাংশ সংক্রমণ হালকা ছিল।

তবে মনে রাখতে হবে, সংক্রমণের সামগ্রিক সংখ্যা যদি ব্যাপক পরিমাণে বৃদ্ধি পায়, তবে মাঝারি-গুরুতর রোগের সংখ্যাও শিশুদের মধ্যে বৃদ্ধি পেতে পারে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোয় ইন্দোনেশিয়ায় অধিকসংখ্যক শিশু করোনাভাইরাসে মারা গেছে, যাদের অনেকেই পাঁচ বছরের কম বয়সি, মৃত্যুর হার অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে বেশি।

কেবল ইন্দোনেশিয়াতেই নয়- থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশেও বিপজ্জনক ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে এবং এসব দেশে টিকা দেওয়ার হার কম হওয়ায় করোনার রেকর্ড প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। একই সঙ্গে আমরা কোভিড প্রতিরোধে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করছি না, তাই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের তরঙ্গে অবশিষ্ট অপ্রতিরোধক (Unvaccinated) জনগণ সংক্রমিত হতে পারে-যাদের মধ্যে বিপুলসংখ্যক শিশুও আছে।

এখন মিলিয়ন ডলারের প্রশ্নটি হলো-কীভাবে তৃতীয় তরঙ্গকে আটকানো যায়? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন করোনাভাইরাসের অতিরিক্ত তরঙ্গগুলো রোধ করার মূল চাবিকাঠি হলো ভাইরাসটির জন্য পরীক্ষা বাড়ানো এবং প্রয়োজনবোধে সামাজিক দূরত্বের ব্যবস্থাগুলো বাস্তবায়ন ও অনুসরণ অব্যাহত রাখা। কারা এ ভাইরাসের সংস্পর্শে এসেছে তা নির্ধারণের জন্য বিস্তৃত টেস্টিং ও যোগাযোগের সন্ধান প্রয়োজন এবং সেই ব্যক্তিদের অবশ্যই ১৪ দিনের জন্য বিচ্ছিন্ন থাকতে হবে।

Center for Research, Innovation, Development and Action-এর পর্যালোচনায় উঠে এসেছে, বিপজ্জনক ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারণে বাংলাদেশে ভয়াবহ তরঙ্গের আশঙ্কা বিদ্যমান। এ উচ্চ সংক্রামক করোনাভাইরাস এখনই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলে করোনার তীব্রতা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে।

মে মাসের প্রথম তিন সপ্তাহে সংক্রমণ কিছুটা কম থাকার পর ২৫ মে, ২০২১ থেকে সংক্রমণের উচ্চহার দেখা গেছে (শনাক্তের হার ১০ শতাংশের বেশি)। বাংলাদেশে ৮ মে প্রথম ডেল্টা (ভারত) ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট উচ্চ সংক্রমণশীল, আলফা (যুক্তরাজ্যের) ভ্যারিয়েন্টের থেকে ৪০ শতাংশ বেশি সংক্রামক এবং তা আক্রান্তদের হাসপাতালে ভর্তির ঝুঁকি দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়।

তৃতীয় তরঙ্গে শিশুদের গুরুতর রোগের আশঙ্কা আছে। প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের আরও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তরঙ্গ ১ ও ২-এ সংগৃহীত তথ্যানুসারে, শিশুদের গুরুতর কোভিড সংক্রমণের ক্ষেত্রে আইসিইউয়ে ভর্তির প্রয়োজন কম। তবে মিউট্যান্ট স্ট্রেনগুলো কীভাবে আচরণ করবে সে সম্পর্কে আমাদের সজাগ থাকতে হবে।

ডেল্টা ওয়েভ COVID-19 সংক্রমণে বেশির ভাগ শিশুর গুরুতর রোগাক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। তাই আমাদের আরও ভালোভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। ইতোমধ্যেই COVID-19-এর গুরুতর অসুস্থতা শিশুদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে নিউমোনিয়া ও এমআইএস-সি (MIS-C) উল্লেখযোগ্য। কিছু ক্ষেত্রে অসম্পূর্ণ লক্ষণ সংক্রান্ত কোভিড-১৯ সংক্রমণের ২-৬ সপ্তাহ পর ‘মাল্টি-সিস্টেম ইনফ্ল্যামেটরি সিনড্রোম (MIS-C), প্রতি লাখে ১২ জনের মধ্যে প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হওয়ার কারণে দেখা যেতে পারে।

কিছু ক্ষেত্রে এটা গুরুতর হতে পারে। এবং তীব্র অসুস্থতার জন্য ২-৬ সপ্তাহ পর কোভিড-১৯-এর কারণে প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ায় আইসিইউ সেবার প্রয়োজন হতে পারে। তবে সময়মতো চিকিৎসা করা হলে বেশির ভাগের সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই প্রাথমিক পর্যায়েই রোগ নির্ণয় হলে চিকিৎসায় ভালো ফল মিলতে পারে। এমআইএস-সি আক্রান্ত বেশির ভাগ শিশু অন্যের মধ্যে সংক্রমণটি সঞ্চার করতে পারে না।

শিশুদের ক্ষেত্রে প্রস্তুতি ও সাবধানতা
গত ১৫ মাস থেকে COVID-19 অসুস্থতার চিকিৎসা সম্পর্কে চিকিৎসকরা অনেক কিছু শিখেছেন এবং তাদের অভিজ্ঞতা বেড়েছে। শিশুদের কোভিড চিকিৎসা বিষয়েও শিশু বিশেষজ্ঞরা অধিক সংবেদনশীল ও প্রশিক্ষিত হয়েছেন। ইতোমধ্যে ‘মাল্টি-সিস্টেম ইনফ্ল্যামেটরি সিনড্রোম (MIS-C) আক্রান্তদের কেমন পর্যবেক্ষণ, তদারকি ও যত্ন প্রয়োজন, সে সম্পর্কে ধারণা হয়েছে।

অধিকসংখ্যক শিশু রোগীর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে, বিভিন্ন প্ল্যাটফরমে অসুস্থতা ও সতর্কতার লক্ষণ সম্পর্কে পিতা-মাতাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং সচেতনতা জোরদার করতে হবে। উচ্চ-নির্ভরশীলতা ইউনিট (HDU) এবং নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটগুলোসহ শিশুদের জন্য আরও কোভিড ওয়ার্ডের ব্যবস্থা করতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে, প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যবিধি শিশুর জন্য একই। পিতা-মাতার মাস্ক ব্যবহার, হাত ধোওয়ার স্বাস্থ্যবিধি এবং শারীরিক বা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, গণসমাবেশ নিয়ন্ত্রণ করা অপরিহার্য এবং শিশুদেরও এ ব্যাপারে শিক্ষা দিতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী ২ থেকে ৫ বছর বয়সের শিশুদের মাস্ক ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত। তবে প্রাপ্তবয়স্কদের কোভিড উপযুক্ত আচরণ অনুসরণ করতেই হবে। মা-বাবার উচিত বাচ্চাদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যাগুলো লক্ষ করা এবং শিশু নির্যাতন ও সহিংসতা রোধে সজাগ থাকা। এছাড়াও স্ক্রিনের সময় অর্থাৎ মোবাইল, ট্যাব বা ল্যাপটপের ব্যবহার নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা অবশ্য করণীয়।

স্কুল আবার চালু করার আগে শিশুদের সুরক্ষার জন্য নির্দিষ্ট গাইডলাইনও তৈরি করতে হবে। আমাদের প্রস্তুতি পুরোদমে থাকলে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ থাকবে না। স্কুল খোলার আগে স্কুলসংশ্লিষ্ট সব প্রাপ্তবয়স্ককে (শিক্ষক, পিওন, ড্রাইভার, দারোয়ান পরিচ্ছন্নতাকর্মী এবং সব অভিভাবক) দ্রুততার সঙ্গে টিকা গ্রহণ করতে হবে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী বাচ্চাদের স্কুল খোলার জন্য সর্বাগ্রে নিরাপদ পরিবেশ প্রস্তুত করা প্রয়োজন।

শিশুদের ভ্যাকসিন দেওয়ার বিষয়ে বিবেচনা
এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, শিশুদের তুলনায় প্রাপ্তবয়স্কদের কোভিড-১৯ রোগে মারা যাওয়ার আশঙ্কা হাজারগুণ বেশি। তাই উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ বয়স্কদের গ্রুপকে প্রথমে টিকা দেওয়ার জন্য অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। ধীরে ধীরে ১৮ বছরের উপরে সবাইকে টিকার আওতায় আনা হচ্ছে। কিছু দেশ ইতোমধ্যে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের টিকা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছে।

ইতোমধ্যে ফাইজারের টিকা ৫ বছরের উপরের শিশুদের জন্য পরীক্ষায় নিরাপদ ও কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। একইভাবে মডার্না ভ্যাকসিন ১২ থেকে ১৭ বছরের কিশোর-কিশোরীদের দেওয়ার জন্য অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।

পরবর্তী যা ঘটতে পরে : ১. আরেকটা নতুন তরঙ্গের আঘাত; ২. ধীরে ধীরে জনসংখ্যার বেশির ভাগ অংশ অসম্পূর্ণ বা লক্ষণবিহীন সংক্রমণ দ্বারা প্রতিরোধ ক্ষমতা বা অনাক্রম্যতা (Herd Immunity) অর্জন। ৩. সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রোগটি অপসৃত হতে পারে বা কম সংক্রমণ হারের সঙ্গে সমাজে বা সম্প্রদায়ে স্থানিক (Endemic) আকার ধারণ করতে পারে। তবে সবার আগে ব্যাপক হারে শিশুদের সংক্রমণের আশঙ্কাটাই বেশি। উপযুক্ত আচরণ অনুসরণের মাধ্যমে এ সংক্রমণ থামানো সম্ভব।
অধ্যাপক ডা. মনজুর হোসেন : শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ; সভাপতি, বাংলাদেশ শিশু চিকিৎসক সমিতি

এসএ/


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি