ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪

শিশুদের নীরব ঘাতক মোবাইল ফোন!

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৬:৩৯, ২৫ এপ্রিল ২০১৮ | আপডেট: ১১:০৭, ২৯ এপ্রিল ২০১৮

নার্গিস আক্তার জুঁই। রাজধানীতে একটি বেসরকারী ব্যাংকে চাকরী করেন। প্রতিদিন সকালেই ছুটতে হয় অফিসে। তার চার বছর বয়সী বাচ্চাটা মা যাওয়ার সময় কান্না জুড়ে দেয় সাথে যাওয়ার জন্য। অগত্য কী আর করা। প্রথম প্রথম বাচ্চার হাতে স্মার্ট ফোন তুলে দিতেন। ভিডিও গেম খেলার জন্য। বাচ্চা সেটা নিয়ে শান্ত হতো। জুঁই বুঝলেন, বাচ্চাকে শান্ত করার জন্য এটা ভাল পদ্ধতি। এরপর নিজেই বাচ্চার জন্য কিনে আনলেন আলাদা ট্যাব। বাচ্চা এখন দিন রাত সেই ট্যাব হাতেই থাকে। ঘুমুতে গেলেও ট্যাব, খেতে গেলেও ট্যাব। ট্যাবেই যেন তার নিত্য সঙ্গী।

শরাফত সাহেব খুব খুশী। অফিসে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করে বলেন, আমার ছেলেটা মোবাইলে খুব পাকা। নিজে নিজে ইন্টারনেট থেকে নানা ধরনের অ্যাপস ডাউনলোড করা, এটা ওটা বের করা সব পারে। সহকর্মীরা উৎসাহ দেয়। বাহ, মেধাবী ছেলে আপনার। সরাফত সাহেব আত্মতৃপ্তিতে ভোগেন।

সাহেদা বেগমের দুই সন্তান। চার বছর ও দু`বছর বয়স তাদের। একেবারেই খেতে চায়না। খাওয়াতে বসালেই নানা বায়না। প্রতিবেশীদের দেখা দেখি সাহেদা বেগম খাওয়ানোর সময় বাচ্চাদের হাতে মোবাইল ফোন দেন। তারা ইউটিউবে গান শুনতে শুনতে, কার্টুন দেখতে দেখতে খায়। সাহেদা বেগম নিশ্চিন্ত হন। যাই হোক, বিনা ঝামেলায় বাচ্চারা এখন পেটপুরে খায়।

এভাবেই বাবা-মায়েরা সন্তানকে শান্ত রাখতে বা তাদের দাবি মেটাতে সন্তানের হাতে তুলে দিচ্ছেন স্মার্ট ফোনসহ নানা ধরণের দামী গেজেট। এতে একদিকে যেমন বাবা মায়েরা নিশ্চিন্ত হচ্ছে অন্যদিকে তেমনি তারা এটাকে আভিজাত্যের অংশ মনে করছে।

কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে ভিন্ন কথা। বিজ্ঞানের দাবি, শিশুদের হাতে মোবাইল ফোনসহ কোনো ইলেকট্রনিক্স গেজেট দেওয়া উচিত নয়। এতে নানা ধরনের রোগের জন্ম হয় শিশুদের শরীরে। নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ ডা. প্রাণ গোলাপ দত্ত একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে বলেন, মোবাইল ফোন শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক। মোবাইল ফোন থেকে নির্গত রশ্মি শিশুদের দৃষ্টিশক্তির ভীষণ ক্ষতি করে। যেসব শিশু দৈনিক পাঁচ-ছয় ঘন্টা মোবাইল ফোনে ভিডিও গেম খেলে, খুব অল্প বয়সে তারা চোখের সমস্যায় পড়বে। ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত একুশে টেলিভিশন অনলাইনের কাছে দাবি করেন, সেদিন খুব বেশী দূরে নয় যেদিন মোবাইল ফোনকে সিগারেটের চেয়ে বেশি ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত করা হবে।

যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক এক গবেষণায় দেখা যায়, ১১ বছর বয়সী শিশুদের প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৭০ জন মোবাইল ফোন নিয়মিত ব্যবহার করে। বাংলাদেশে তেমন কোনো গবেষণা প্রতিবেদন তৈরী না হলেও অনুমাণ করতে কষ্ট হয়না পরিমাণটা কম নয়। গবেষণা প্রতিষ্ঠাণ `উই আর সোশ্যাল` ও `হুট স্যুট` নামক প্রতিষ্ঠানের করা এক গবেষণা প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, ভারত ও তার আশেপাশের রাষ্ট্রগুলোতে মোবাইল ফোন ব্যবহারের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। চীনের মতো প্রযুক্তি বান্ধব রাষ্ট্রে যেখানে শিশুরা দৈনিক দুই ঘন্টা মোবাইল ফোনে ব্যবহার করে, সেখানে ভারত ও তার আশেপাশের রাষ্ট্রগুলোতে শিশুরা গড়ে পাঁচ ছয় ঘন্টা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহফুজা খানম বলেন, খেলাচ্ছলেই শিশুদের হাতে মোবাইল ফোন দেয় বাবা মায়েরা। তারা মোবাইলের নানা দিক ঘুরে বিভিন্ন বিষয় বের করে। বাবা মা তখন হাসি দেয়। সেই হাসির অর্থ, ` আমার বাবু পারে`। এর ফলে বাচ্চা দ্বিগুণ উৎসাহী হয়। কিন্তু আমাদের বাবা মায়েরা জানেন না, এটা শিশুদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার জন্য নীরব ঘাতক। ড. মাহফুযা খানম এ সময় বলেন, বয়স্কদের চেয়ে শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। মস্তিষ্কের গঠন নরম। ফলে মোবাইল ফোনসহ নানা ধরণের ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যের ব্যবহার তাদের নানা ধরনের রোগের ঝুঁকিতে ফেলে।

একই কথা বললেন বুয়েটের তড়িৎ কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শেখ আনোয়ারুল ফাত্তাহ। একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে তিনি বলেন, শিশুদের মস্তিষ্ক ইলেকট্রনিক্স পণ্য থেকে নির্গত ক্ষতিকর রস্মি ধারণের উপযুক্ত নয়। তাছাড়া মোবাইলের যে ভলিউম তার কম্পন খুবই ভয়াবহ। শিশুরা একনাগাড়ে মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে তাদের মৃগি রোগ ও হাঁপানীর ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুরা এক মিনিট মোবাইলে কথা বললে মস্তিষ্কে যে কম্পন সৃষ্টি হয় তা স্থির হতে সময় লাগে দুই ঘন্টা। ওই গবেষণায় আরো দাবি করা হয়, যেসব বাচ্চারা দৈনিক পাঁচ-ছয় ঘন্টা মোবাইল ব্যবহার করে তাদের বুদ্ধির বিকাশ সাধারণ বাচ্চাদের চেয়ে কম হয়। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবিক সম্পর্ক উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার মিতি সানজানা বলেন, নগর জীবন আমাদের সম্পর্কগুলোকে জটিল করছে। আমরা সময় পার করার জন্য ও বিনোদনের অনুসঙ্গ হিসেবে আমাদের শিশুদের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দিচ্ছি। এর ক্ষতিকর দিক নিয়ে ভাবছি না। মোবাইলের পরিবর্তে তাদের হাতে বই দেওয়া উচিত। পর্যাপ্ত খেলাধূলার সুযোগ দেওয়া উচিত। পারিবারিক সম্পর্কগুলোর চর্চা বাড়ানো উচিত। একটা সুস্থ আগামী প্রজন্মের জন্য এর বিকল্প নেই।

শিশুরা আগামী দিনের ভবিষ্যত। তাদের দৈহিক ও মানসিক সুস্থ গঠনের লক্ষ্যে আমরা আরো সচেতন হবো এটাই প্রত্যাশা।

এমজে/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি