শিশুশ্রম রোধে প্রয়োজন কার্যকর পদক্ষেপ ও সামাজিক সচেতনতা
প্রকাশিত : ১২:৩১, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | আপডেট: ১৩:২৭, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১
দশ বছর বয়সী মামুন, যার বাবা একজন দিনমজুর। করোনার আগে সে একটি স্কুল পড়াশোনা করত। কিন্তু করোনাকালীন সময়ে একটি ইস্পাতের কারখানা কাজ করছে পরিবারের চাহিদা যোগান দেয়ার জন্য। করোনা পরবর্তী সময়ে স্কুল খুললে আবার স্কুলে ফিরবে কি না জানে না এই শিশু।
তার অভিভাবকেরও খুব একটা ইচ্ছে নেই তাকে আবারো স্কুলে ফেরানোর। করোনাকালীন সময়ে এভাবেই মামুনের মতো অনেক শিশু স্কুল থেকে ঝরে পড়বে আর শিশুশ্রমে নিয়োজিত হয়ে যাবে। অথচ বলা হয় আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এটা ভবিষ্যতমুখী অনেকেই শিশুশ্রমে হারিয়ে যাচ্ছে।
শিশুশ্রম বিশ্বব্যাপী একটি পুরাতন সমস্যা। বিশ্বের নামীদামী সংস্থাগুলো শিশুশ্রম নিয়ে কাজ করছে, তবুও কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। একশ্রেণির মুনাফাখোর শিশুদের অল্প মজুরি দিয়ে অধিক মুনাফা অর্জন করতে চায়। শিশুদের ঠেলে দেয় অনেক ঝুকিপূর্ণ কাজে । যেখানে তাদের জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। করোনাকালীন সময়ে দারিদ্র্য সুযোগ নিয়ে শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করছে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী ও কল-কারখানা মালিক। বাসের হেল্পার, ইট ভাটায় ও নির্মাণ শ্রমিকের কাজে ব্যাপকভাবে শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে বস্তি এলাকায় মাদক চোরাচালানের সাথে অসাধু লোকজন শিশুদের জড়িয়ে দিচ্ছে।
জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ এবং বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী আঠারো (১৮) বছরের কম বয়সী সকল বাংলাদেশিকে শিশু হিসেবে এবং চৌদ্দ (১৪) থেকে আঠারো (১৮) বছরের কম বয়সী শিশুদেরকে কিশোর/কিশোরী হিসেবে গণ্য করা হয়। স্কুল চলাকালীন সময় চৌদ্দ (১৪) বছরের নিচে কোন শিশুকে তার পরিবারের লিখিত অনুমতি ছাড়া উৎপাদনশীল কাজে নিয়োগ দেয়া বা কাজ করিয়ে নেয়াকে শিশুশ্রম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অথবা শিশু শ্রম বলতে শিশুদের শ্রমের সময় প্রত্যক্ষভাবে উৎপাদন কাজে এবং পরোক্ষভাবে গার্হস্থ্য শ্রমে ব্যয় করাকে বোঝায়।
মূলত ১৮ বছরের কম বয়সী স্কুলগামী শিশুদের উৎপাদনশীল কাজে নিয়োগ করাকেই শিশুশ্রম বলে গণ্য করা হয়।
দারিদ্র্যপীড়িত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে শিশুশ্রমের মাত্রা খুব বেশি। শিশু শ্রমের ভয়াবহতা নিয়ে ভারতের নোবেল বিজয়ী কৈলাস খের বলেন, ‘শিশু শ্রম দারিদ্র্য, বেকারত্ব, নিরক্ষরতা, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং অন্যান্য সামাজিক সমস্যা স্থায়ী করে।’
বর্তমানে কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে শিশুশ্রম একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘদিন বিদ্যালয় বন্ধ থাকার কারণে অনেক অভিভাবক শিশুদেরকে বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত করেছেন, যার ফলে একই দিকে শিশুরা স্কুল থেকে ঝরে পড়ছে এবং শিশুশ্রমে ঝুঁকে পড়ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে এডুকেশন ওয়াচের অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন ২০২১-এ ঝরে পড়ার ব্যাপারে উদ্বেগজনক মতামত পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাথমিকের ৩৮ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন বিদ্যালয় খুলে দেয়ার পরও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে যেতে পারে। ২০ শতাংশ মনে করেন, ঝরে পড়ার হার বাড়বে এবং ৮ দশমিক ৭ শতাংশ মনে করেন, শিক্ষার্থীরা শিশুশ্রমে নিযুক্ত হতে পারে। মাধ্যমিকের ৪১ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন, বেশি শিক্ষার্থী ক্লাসে অনুপস্থিত থাকতে পারে। ২৯ শতাংশ মনে করেন, ঝরে পড়ার হার বাড়বে। ৪০ শতাংশ অভিভাবক মনে করেন, শিক্ষার্থীদের অনিয়মিত উপস্থিতির হার বাড়বে এবং ২৫ শতাংশ মনে করেন, ঝরে পড়ার হার বাড়বে।
৪৭ শতাংশ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মনে করেন শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতের হার বাড়বে, ৩৩ দশমিক ৩ শতাংশ মনে করেন ঝরে পড়া বাড়বে এবং ২০ শতাংশ মনে করেন অনেকেই শিশুশ্রমে যুক্ত হতে পারে। ৬৪ শতাংশ এনজিও কর্মকর্তা মনে করেন, শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির হার ও ঝরে পড়া বাড়বে।
এছাড়াও গত জুনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও ইউনিসেফ বলেছে, দুই দশকের চেষ্টায় বিশ্বে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ৯ কোটি ৪০ লাখ কমিয়ে আনার যে সফলতা ও অর্জন তা কোভিড-১৯ মহামারির কারণে ঝুঁকির মুখে পড়েছে । তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহামারির মধ্যেই শিশুশ্রমে থাকা শিশুদের হয়তো আরও বেশি কর্মঘণ্টা কাজ করতে হবে বা আরও বাজে পরিস্থিতিতে পড়তে হবে। তাদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাও মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অ্যাকশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট-এএসডি সম্প্রতি ঢাকায় ১৯৪ জন শ্রমজীবী শিশুর ওপর একটি জরিপ চালিয়েছে। মহামারিকালে রাজধানীর কর্মজীবী শিশুদের ৮৬ দশমিক ৬ শতাংশ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে উঠে এসেছে সেই জরিপে।
ফলে শিশুদের স্কুল থেকে ঝরে পড়া এবং বাল্য বিবাহের হারের সঙ্গে শিশু নির্যাতনও বাড়বে বলে আশঙ্কা করছে এএসডি।
জরিপে অংশ নেয়া শিশুদের ৩৬ দশমিক ৬ শতাংশ জানিয়েছে, মহামারি শুরু হওয়ার পর তারা কাজ হারিয়েছে। আয় রোজগার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় পেশা পরিবর্তন করেছে ৪৯ দশমিক ৫ শতাংশ শ্রমজীবী শিশু। তাদের একটি অংশ ভিক্ষাবৃত্তিতেও জড়িয়ে পড়ছে।
শিশুশ্রম বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে দারিদ্র্যতা। বাংলাদেশে এখন ২০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। করোনার কারণে আরো ২০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নামতে পারে। সম্প্রতি পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক যৌথ গবেষণায় দেখা যায়, করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে তৈরি হওয়া পরিস্থিতির প্রভাবে শহরের নিম্ন আয়ের মানুষের আয় কমেছে ৮২ শতাংশ। আর গ্রামাঞ্চলের নিম্ন আয়ের মানুষের আয় ৭৯ শতাংশ কমেছে। যেভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রে বৈষম্য বাড়ছে সেখানে দারিদ্র্যতার সংখ্যা বাড়ছে, যার ফলে শিশু শ্রমের সংখ্যাও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে।
সরকার ৯টি খাতকে চিহ্নিত করে শিশুশ্রম রোধে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ২০২০ সালের অক্টোবরে ঢাকার শ্রম ভবনে জাতীয় শিশুশ্রম কল্যাণ পরিষদের এক সভায় এই সিদ্ধান্ত হয় বলে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছিল। পরিকল্পনাটি হচ্ছে, ২০১০ সালের জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতির আলোকে জাতীয় কর্মপরিকল্পনার আওতায় ওই নয়টি কৌশলগত ক্ষেত্র চিহ্নিত করে দায়িত্ব বণ্টন করা হয়েছে।
এর মধ্যে শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ্যে নীতি বাস্তবায়ন এবং প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নের বিষয়টি দেখবে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং ন্যাশনাল কমিশন টু রিভিউ দ্য ওয়ার্কিং অফ দ্য কনস্টিটিউশন। শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়টি দেখবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির উন্নয়নে কাজ করবে।
শিশুশ্রম রোধে সামাজিক সচেতনতা তৈরিতে কাজ করবে তথ্য ও ধর্ম মন্ত্রণালয় এবং সিটি করপোরেশন। কর্মসংস্থান ও শ্রম বাজারে শিশুশ্রম বন্ধের বিষয়টি দেখবে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। আইন প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। শিশুশ্রম প্রতিরোধে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার বিভাগ কাজ করবে।
শিশুশ্রম একটি বিশ্বব্যাপী পুরনো জটিল সমস্যা। এই সমস্যা নিরসনে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে সরকারকে আন্তরিকভাবে গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। শিশুদের নিয়ে কাজ করা উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে এখানে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। সুশীল সমাজসহ সর্বস্তরে শিশুশ্রম রোধে একটি সামাজিক সচেতনতা তৈরি করতে হবে। দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি গ্রহণ করে শিক্ষাকে সবার জন্য সহজ করতে হবে।
তাই একটি সুন্দর সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য শিশু শ্রম রোধের বিকল্প নেই।
‘এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি।
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য’র মতো সবাই নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই প্রতিটি নবজাতকের জন্য পৃথিবী হবে সুন্দর, আনন্দময়। সুস্থভাবে বেড়ে উঠবে অমিত সম্ভাবনাময়ী সকল শিশু।
লেখক : উন্নয়ন কর্মী
এআই/ এসএ/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।