শীতের আমেজে খেজুরের রস
প্রকাশিত : ১০:১৭, ১৯ জানুয়ারি ২০২৩ | আপডেট: ১০:২৫, ১৯ জানুয়ারি ২০২৩
শীত আসলেই প্রকৃতি সাজে নতুন রূপে। সকালে কুয়াশায় চাদরে মোড়ানো থাকে চারদিক। তারপর দেখা মেলে মিষ্টি রোদের। রোদ শেষে আবার কুয়াশা, এ যেন অদ্ভুত এক সৌন্দর্য্যের মিলনমেলা।
এ সময়ে গ্রামীণ জনপদে দেখা মেলে খেজুর গাছ থেকে রস আহরণের অসাধারণ দৃশ্য। ভোরে খেজুর রস আহরণের বিষয়টি বেশ বিস্ময়ের। খেজুর গাছকে বলা হয় ‘মধুবৃক্ষ’। এ গাছ থেকে বিশেষ পদ্ধতিতে রস আহরণ করা হয়।
সারা বছর ফেলে রাখা খেজুর গাছের যত্ন বেড়ে যায় শীতকাল আসলেই। কারণ, খেজুর গাছ থেকে আহরণ করা সুমিষ্ট ও মূল্যবান রস দিয়ে তৈরি করা হয় গুড়-পাটালি।
তাছাড়া শীতের সকালে এক গ্লাস খেজুরের রস আত্মার তৃপ্তি আনে। শীত যত বাড়ে খেজুর রসের মিষ্টিও তত বাড়ে। শীতের আমেজকে বাড়িয়ে দিতে খেজুরের রসের তাই জুড়ি নেই।
শীত শুরুর সঙ্গে সঙ্গে গাছিরা খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। খেজুর গাছ কেটে পরিষ্কার করে শুরু করেন রস সংগ্রহ। খেজুরের রস সংগ্রহকারীরা প্রতিদিন বিকেলে নলি, কোমরবন্ধ রশি সাথে নিয়ে খেজুর গাছের সাদা অংশ পরিষ্কার করে ছোট-বড় কলসি ও হাড়ি (মাটির পাত্র) বেঁধে রাখেন রসের জন্য। মাটির কলসিতে সারারাত রস জমে। ভোরের আলো বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গাছিরা রস ভর্তি মাটির ভাঁড় নামিয়ে এনে এক জায়গায় জড়ো করেন। পরে এই রস টিনের ট্রে (তাবাল) পাত্রে জ্বাল দিয়ে ঘন করে গুড় মাটির ভাঁড় (হাঁড়ি) বা বিভিন্ন আকৃতির পাত্রে রাখা হয়। গুড় জমাট বেঁধে পাত্রের আকৃতি ধারণ করে। কখনও কখনও এর সঙ্গে নারিকেল কিম্বা তিল মিশিয়ে ভিন্ন স্বাদ দেওয়া হয়।
খেজুরের রস দিয়ে তৈরি করা নলের গুড়, ঝোলা গুড়, দানা গুড় ও বাটালি গুড়ের মিষ্টি গন্ধেই যেন অর্ধভোজন হয়ে যায়।
সাধারণত চার বছর বয়সের পর থেকে খেজুর গাছের রস আহরণ শুরু হয় যখন গাছে ১২-১৫টি পাতা থাকে। খেজুরের চিনি, গুণমান ইত্যাদির পরিমাণ মাটি, জলবায়ু এবং খেজুরের প্রকারের উপর নির্ভর করে। পুরুষ গাছ স্ত্রী গাছের চেয়ে বেশি রস দেয় এবং রসও তুলনায় বেশি মিষ্টি হয়।
কেউ কেউ কাঁচা রস বাজারে বিক্রি করেন। শীতের সকালে অনেকেই গ্রামে কিনতে আসেন খেজুরের এ রস। তারা বাসায় নিয়ে পিঠে, পায়েস রান্না করে সবাই মিলে খায়, অনেকে আবার মেয়ে-জামাইকে এ সময়টাতেই নিমন্ত্রণ জানায়।
প্রতি বছর হেমন্তেই শুরু হয় গাছিদের মহাব্যস্ততা। শীতকালজুড়েই তাদের এই ব্যস্ততা লক্ষ্য করা যায়। গ্রামীণ জনপদে খেজুর গাছ ও গাছিদের নিবিড় সম্পর্ক চোখে পড়ে। অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে ঐতিহ্যের খেজুর গাছ কেটে গাছিরা রস আহরণ করেন। দেশজুড়ে এ রসের রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। বিশেষ করে শীতকালে গ্রামাঞ্চলের প্রায় প্রতিটি ঘরেই খেজুর রস দিয়ে চলে পিঠা-পুলি তৈরির হরেক আয়োজন।
বৃহত্তর গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকা অর্থাৎ যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর ও খুলনা জেলায় বরাবরই খেজুরগাছ জন্মে বেশি।
‘যশোরের যশ, খেজুরের রস’ আবহমানকাল ধরে চলে আসা এই প্রবাদটি যশোরের ক্ষেত্রে আজও প্রাসঙ্গিক। যশোরে প্রাকৃতিকভাবেই খেজুরগাছ বেশি হয়। দিগন্তজোড়া মাঠে খেজুরগাছের দীর্ঘ সারির দেখা মিলবে। অপরিকল্পিতভাবে সড়কের পাশে, খেতের আইলে, বাড়ির আঙিনায়, উঁচু জমিতে রয়েছে সারি সারি খেজুরগাছ।
এক সময় অর্থকরী ফসল বলতে খেজুর গুড়ের বেশ কদর ছিল। কারণ ধান উৎপাদনে জমির ব্যবহার ছিল স্বল্প। পড়ে থাকত দিগন্তজোড়া মাঠ, জমি থাকতো বনজঙ্গলে ভরা। আর সেখানে বিনা রোপণ ও বিনা পরিচর্যায় বুনোলতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে উঠত খেজুরগাছ। তা থেকে রস বের করে তৈরি হতো উৎকৃষ্ট গুড়। প্রবাদে প্রচলিত যশোরের খ্যাতি খেজুরের রসে। যশোরের ঐতিহ্যবাহী গুড় পাটালির ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
তবে টাঙ্গাইল,ফরিদপুর, রাজশাহী সহ দেশের প্রায় অধিকাংশ গ্রামেই খেজুর রস পাওয়া যায়।
বর্তমানে খেজুর গাছ কমে যাওয়ায় পর্যাপ্ত পরিমাণ রস সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না গাছিদের। তাছাড়া গুড় তৈরি করতে অধিক খরচ হওয়ায় লাভের ভাগ খুব বেশি হয় না। এজন্য অনেক গাছি এ কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ কাজের ফাঁকে এ পেশাকে ঐতিহ্য হিসেবেই টেনে নিয়ে যাচ্ছেন।
খেজুর গাছ থেকে রস, আর সেই রস থেকে গুড় উৎপাদন কৃষকের একটা বাড়তি আয়ের উৎস। তাই কিছু কৃষক বা গাছিরা অন্যান্য কাজের সঙ্গে তাদের খেজুর গুড় তৈরির কাজ ধরে রেখেছেন বছরের পর বছর।
ব্রিটিশ আমলে খেজুর গুড় থেকেই তৈরি হতো চিনি। এ চিনি 'ব্রাউন সুগার' নামে পরিচিত ছিল। খেজুরের রস থেকে উন্নতমানের মদও তৈরি করা হতো। এই চিনি ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাঠানো হতো। বিলেত থেকে সাহেবরা দলে দলে যশোর অঞ্চলে এসে চিনির কারখানা স্থাপন করে চিনির ব্যবসায় নামেন। সে সময় চিনির কারখানাগুলো চৌগাছা এবং কোটচাঁদপুর শহরের আশপাশে কেন্দ্রীভূত ছিল।
যশোরের খেজুরের রস ও গুড় স্বাদে, গন্ধে অতুলনীয়। যশোরের ইতিহাস থেকে জানা যায়, এ অঞ্চলের চৌগাছা এবং কোটচাঁদপুরের আশপাশে প্রায় ৫০০ চিনি কারখানা গড়ে উঠেছিল। তখন কলকাতা বন্দর দিয়ে খেজুর গুড় থেকে উৎপাদিত চিনি রপ্তানি করা হতো। মূলত ১৮৯০ সালের দিকে আখ থেকে সাদা চিনি উৎপাদন শুরু হলে খেজুর গুড় থেকে চিনির উৎপাদনে ধস নামে। একে একে কারখানাগুলোও বন্ধ হয়ে যায়। খেজুরের গুড় থেকে চিনি তৈরি না হলেও এখন পর্যন্ত বাঙালির কাছে খেজুর গুড় পাটালির কদর কমেনি।
খেজুরের রসের উপকারিতা
খেজুরের রস পান করলে শরীরের দুর্বলতা দূর হয়। এতে উচ্চ প্রাকৃতিক চিনি এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদান রয়েছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে খেজুরের রস পান করলে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে হয়। পুষ্টিগত দিক থেকে খেজুর রসের উপকারিতা অনেক।
খেজুরের রসে প্রচুর এনার্জি বা শক্তি রয়েছে। এতে জলীয় অংশও বেশি। এই রসকে প্রাকৃতিক ‘এনার্জি ড্রিংক’ বলা যেতে পারে। এতে গ্লুকোজের পরিমাণ বেশি থাকে।
খেজুরের রস কাঁচা খাওয়া যায়, আবার জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করেও খাওয়া যায়। গুড়ে আয়রন বা লৌহ বেশি থাকে এবং হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সহায়তা করে। যারা শারীরিক দুর্বলতায় ভোগেন, কাজকর্মে জোর পান না, খেজুরের রস তাদের জন্য দারুণ উপকারী।
খেজুরের রস প্রচুর খনিজ ও পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ। এতে ১৫-২০% দ্রবীভূত শর্করা থাকে। খেজুরের গুড় আখের গুড় থেকেও বেশি মিষ্টি, পুষ্টিকর ও সুস্বাদু। খেজুরের গুড়ে প্রোটিন, ফ্যাট ও মিনারেল সবই রয়েছে।
খেজুরের রসে দ্রবীভূত শর্করা বা গ্লুকোজের পরিমাণ কমবেশি ১৫% থেকে ২০% এবং এতে আছে প্রচুর প্রোটিন, সহজপাচ্য ফ্যাট এবং খনিজ বা মিনারেল। এত পুষ্টিগুণসম্পন্ন এবং জলীয় অংশ বেশি হওয়ার কারণে খেজুরের রসকে প্রাকৃতিক এনার্জি ড্রিংকও বলা হয়ে থাকে।
পরীক্ষা করে দেখা গেছে খেজুরের রস থেকে তৈরি গুড়ে প্রচুর পরিমাণ লৌহ বা আয়রন থাকে। ফলে খেজুরের রস খেলে বা প্রতিদিন অল্প পরিমাণে খেজুরের গুড় খেলে রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক থাকে, অ্যানিমিয়া প্রতিরোধ হয়। খেজুরের রসে প্রচুর পরিমানে পটাশিয়াম ও সোডিয়াম থাকায়, খেজুরের রস বা গুড় পেশীকে শক্তিশালী করতে বিশেষ কার্যকরী। তাছাড়া এতে রয়েছে প্রচুর ম্যাগনেশিয়াম, যার ঘাটতির কারণে আমাদের অবসন্ন বা ক্লান্তি ভাব আসে।
তাই খেজুরের রস বা গুড় সেবনে শারীরিক দুর্বলতা দূর হয়ে কর্মস্পৃহা ফিরে আসে। প্রচুর ভিটামিন ও মিনারেল সমৃদ্ধ হওয়ায় খেজুরের রস রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, শীতের দিনে শরীর গরম রাখে। ফলে সর্দিকাশির হাত থেকে বাঁচায়। অতিরিক্ত মেদ ঝরাতে বা ওজন কমাতে চিনির পরিবর্তে খেজুরের রস বা গুড় খাওয়া যেতে পারে – এক্ষেত্রে এর পরিবর্ত হিসাবে অন্য কিছু ভাবা যায় না। পর্যাপ্ত পটাশিয়াম থাকায় শরীরের মেটাবলিজম বৃদ্ধি পায়, ফলে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে।
বিশেষজ্ঞদের মতে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতেও খেজুরের রসের কার্যকরী ভূমিকা আছে। খেজুরের রস থেকে উৎপাদিত গুড় অনিদ্রা ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতেও কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে। খেজুরের রস হজমে সাহায্যকারী উৎসেচকগুলির কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। ফলে খাবার তাড়াতাড়ি হজম হয়। আপনি যদি প্রতিদিন খাওয়ার পর সামান্য পরিমাণ খেজুরের গুড় খান তাহলে হজম তাড়াতাড়ি হবে।
সাবধানতা
খেজুরের রস ভোর বা সকালে খাওয়াই ভালো। দিনের আলো বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি ক্রমশ গেঁজে ওঠে এবং অম্লত্ব বৃদ্ধি পায়, তা পান করলে বমি হতে পারে এবং শরীরের জন্যও ক্ষতিকর। যাদের ডায়াবেটিস আছে, তারা খেজুরের রস বা গুড় না খাওয়াই ভালো। তবে এ ব্যাপারে আপনার ডাক্তারের পরামর্শ নিতে পারেন। খেজুরের রসের কলসি বাঁধার সময় কলসির মুখ জাল দিয়ে ঢেকে দেওয়া উচিত।
তবে গাছিরা যে হাড়ি ঝুলিয়ে রাখে তাতে অনেক সময় কীট পতঙ্গ প্রবেশ করে অস্বাস্থ্যকর রসে পরিণত করতে পারে। অনেক সময় বাদুড় কলসির ভিতর মুখ ঢুকিয়ে রস খায়। এ থেকে নিপা ভাইরাসের সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই খেজুরের রস ফুটিয়ে খাওয়া বেশি নিরাপদ। বাদুড় যখন খেজুরের রসে মুখ দেয়। তখন তাদের মুখ থেকে নিঃসৃত লালা এমনকি তাদের মলমূত্র খেজুরের রসের সাথে মিশে যায়। এই দূষিত রস কাঁচা অবস্থায় খেলে নিপাহ ভাইরাস সরাসরি মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে। এর ফলে জ্বর, মাথাব্যথা, দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট, কাশি, বমি, ডায়রিয়া নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়। যা মৃত্যুর কারণ পর্যন্ত হতে পারে।
এসএ/