ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪

শুভ জন্মদিন বঙ্গমাতা

মামুন আল মাহতাব

প্রকাশিত : ২০:৩৯, ৮ আগস্ট ২০২০

স্বাস্থ্যমন্ত্রী তখন সদ্য প্রয়াত মোহাম্মদ নাসিম। হঠাৎ একদিন ডাক পড়লো মন্ত্রণালয়ে। ডাকটা পড়েছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত একটা কারণে। গাজীপুরে বিকেএসপি-র পাশে তখন সদ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি আধুনিক হাসপাতাল। মালিকানা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টের আর ম্যানেজমেন্ট-এ মালয়েশিয়ার বিখ্যাত কেপিজে গ্রুপ। হাসপাতালটি বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব এর নামে। ওখানে সপ্তাহে এক-দুইদিন ওপিডি-তে রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্য দেশের কিছু বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিলো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে। অমন বিশিষ্টদের মাঝে নিজেকে দেখে গর্বিত যে হইনি তা নয়, তবে বেগম মুজিবেরর নামে প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার গর্বটি ছিল অনেক গুণ বেশি।

বঙ্গবন্ধুর নামে প্রতিষ্ঠিত দেশে প্রথম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি আর সাথে বঙ্গমাতার নামে প্রতিষ্ঠিত দেশের প্রথম বিশেষায়িত হাসপাতালে রোগী দেখার বিরল সুযোগ- এদেশে হাতে গোনা দুই-একজনেরই কপালে জুটেছে। সেই থেকে শুরু। মাঝেসাঝে দু’একটা ব্যতিক্রম ছাড়া শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেমোরিয়াল কেপিজে স্পেশালাইজড হাসপাতালে রোগী দেখার কাজটা অব্যাহত রেখেছিলাম কোভিড বাগড়া দেয়ার আগ পর্যন্ত। যে দিন-ই গিয়েছি, পরম প্রশান্তি বোধ করেছি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচাইতে কম উচ্চারিত এবং সম্ভবত সবচাইতে কম মূল্যায়িত এ মহীয়সী নারীর প্রতি ঋণের খানিটা শোধ করতে পেরে। 

বাংলাদেশের ঋণ যদি কোন পরিবারের প্রতি থেকে থাকে, তবে তা বেগম মুজিবের পরিবারের প্রতি। এই পরিবারের কর্তা ব্যক্তিটি বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, বিন্দু থেকে বাঙালির স্বাধিকারের স্বপ্নকে সিন্ধুসম করার মহানায়ক তিনি। জীবনের এক পঞ্চমাংশ সময় জেলখানায় কাটিয়েছেন বাঙালিকে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি স্বাধীন পতাকা আর মানচিত্র এনে দেয়ার তাগিদ থেকে। এই পরিবারের সদস্যদের পবিত্র রক্তে স্নাত বাংলাদেশের ধুলোবালি।

বেগম মুজিবের পরিবারের জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাঙালির জয়রথ এখন ঊর্ধ্বশ্বাসে ধাবমান। কোভিডে যখন বিচলিত বিশ্ব, তখন তার প্রতি প্রচণ্ড আস্থায় অবিচল বাংলাদেশ। পাশে আছেন পরিবারের কনিষ্ঠা কন্যা শেখ রেহানা। দূরে থেকে কাছে আছেন তিনি বাঙালি আর বাংলাদেশের। যোগ্যতম পরিবারটির অন্যতম উত্তরসূরি হিসেবে শেখ হাসিনাকে সঙ্গ দিচ্ছেন সব সময়, তা সেই বিডিআর হত্যাকাণ্ডের সময়-ই হোক, অথবা বিশ্বনাথের অসহায় শিশুদের ঈদ উপহারেই হোক। এই পরিবারের অকাল প্রয়াত শেখ কামাল আর শেখ জামাল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে পিছপা হননি। পৃথিবীতে তাদের স্বল্পস্থায়ী বিচরণকালটা তারা আলোকিত করে রেখেছেন স্ব-স্ব জায়গা থেকে, নিজ-নিজ মহিমায়। বেঁচে থাকলে দ্যুতি ছড়াতেন আরও । ছড়াতেন নিশ্চিত শেখ রাসেলও। 

অমন একটি পরিবারের যিনি কাণ্ডারী, সেই বেগম মুজিব শুধু তার পরিবারটিকেই সামাল দেননি, সামাল দিয়েছেন গোটা বাংলাদেশকেই। কারণ এই পরিবারের কর্তার জ্বরের কারণেই হয়তো বদলে যেতে পারতো বাংলাদেশের ইতিহাস আর বাঙালির ভবিতব্য। ইতিহাসে এমন-ই গুরুত্বপূর্ণ এই পরিবারটি। অমনটা বলার প্রেরণা ৭-ই মার্চের প্রেক্ষাপটটা। ১৯৭১ এর ৭-ই মার্চ জ্বরে পুড়ে যাচ্ছিল বঙ্গবন্ধুর শরীর। প্রচণ্ড চাপও ছিল তার উপর চারপাশ থেকে নানামুখী। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর সিদ্দীক সালিকের সে সময় কর্মস্থল ছিল ঢাকা সেনানিবাস। তাঁর লেখা উইটনেস কটু সারেন্ডার থেকে জানা যায়, পাক সেনাবাহিনীর ধারণা ছিল বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্সের ময়দান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন আর তা হলে তারা সেদিন-ই বাঙালির উপর সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। অন্যদিকে দলীয় ও ছাত্রনেতাদের প্রত্যাশা ছিল পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার। ছিল জনগণের প্রত্যাশাও। অথচ সেই মুহূর্তে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যেত, কারণ পাকিস্তানিরা একে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করার সুযোগ পেত।

রেসকোর্সের পথে গাড়িতে ওঠার আগে বঙ্গবন্ধু বেগম মুজিবের পরামর্শ নেন। বেগম মুজিব তাকে বলেছিলেন, তার বিবেক যা বলে তাই করতে। বঙ্গবন্ধু তাই-ই করেছিলেন। জন্ম হয়েছিল ৭-ই মার্চের মহাকাব্যের, সুচনা হয়েছিল পরাধীন জাতি থেকে বাঙালির জাতিরাষ্ট্রের পথে চুড়ান্ত যাত্রার।

বঙ্গবন্ধুর জীবনে প্রতিটি মোড়ে-মোড়ে বেগম মুজিবের এমনি-ই সব নিপুণ হাতের ছোঁয়া। বঙ্গবন্ধুর লেখার ছত্রে-ছত্রে ছড়িয়ে আছে তার বর্ণনা। বেগম মুজিব তার অসামান্য দক্ষতায় ধারণ করেছিলেন বাংলাদেশকেও, বাংলাদেশের প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে। ৭১-এ বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানের কারাগারে, তার পরিণতি যখন অজ্ঞাত, তখনও তিনি সামলেছেন পুরো পরিবারটিকে। বন্দিত্ব থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন শেখ কামাল আর শেখ জামাল। বন্দিত্বকালীন অবস্থায় ২৭ জুলাই শেখ হাসিনার কোল আলো করে এসেছিলেন বাংলাদেশের আজকের ডিজিটাইলেজেশন-এর রূপকার বঙ্গবন্ধুর প্রথম দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। এসব কিছুই সামাল দিয়েছেন এই মহীয়সী নারী এক হাতে।

বেঁচে থাকলে হয়তো সামলে নিতেন আজও বাংলাদেশ নামক তার বড় সংসারটিকে শেখ হাসিনার প্রেরণা হয়ে, একদিন যেমন সামলে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রেরণাদায়ী হয়ে। আমরা কখনই বুঝিনি তার অবদান, মূল্যায়িত হননি তিনি সেভাবে কোনদিনও তার জায়গাটি থেকে। তবে বুঝেছিল ঠিক-ই পঁচাত্তরের ঘাতকরা। তাদের বুলেটে তাই বিদীর্ণ হয়েছিল সেদিন রাতে বেগম মুজিবের শরীরটিও। 

আজকে যখন কোভিডকে পরাজিত করে বাঙালির সামনে এগিয়ে চলার আর বাঙালিকে সামনে এগিয়ে নেওয়ায় তার প্রাণপ্রিয় দুই কন্যার নিরলস প্রচেষ্টা, তখন এই দিনে- অগাস্টের ৮ তারিখে বঙ্গমাতার জন্মদিনে তার অভাবটা আরও বেশি করে অনুভূত হয়। শুধু যদি তিনি আজ তার দু’কন্যার পাশে থাকতেন! বঙ্গমাতা আজ বেঁচে থাকলে কি হতো জানিনা, তবে জানি বাঙালিকে সামনে এগিয়ে নেওয়ায় তার উত্তরসূরীদের পথ চলাটা আরও অনেক বেশি মসৃণ হতো। 

লেখক: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগের চেয়ারম্যান এবং সম্প্রীতি বাংলাদেশ- এর সদস্য সচিব।

এসি

 


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি