শুভ বৌদ্ধ মধু পূর্ণিমা
প্রকাশিত : ২৩:০১, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮
আজ শুভ মধু পূর্ণিমা। বৌদ্ধ বিশ্বের জন্য এটি অত্যন্ত আনন্দঘন একটি তিথি এবং এর আবেদন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বৌদ্ধদের ত্রৈমাসিক বর্ষাব্রত যাপনের দ্বিতীয় পূর্ণিমা তিথিতেই এই পূর্ণিমা উৎসব উদযাপন করা হয়।
অর্থাৎ ভাদ্রপূর্ণিমা তিথিই বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসে মধু পূর্ণিমা নামে পরিচিত। বৌদ্ধরা এদিন বিহারে গিয়ে বুদ্ধ ও ভিক্ষুসংঘকে মধু এবং নানা ধরনের পুষ্প, ফল ও খাদ্য ভোজ্যাদি দান করে থাকেন।
বিশেষ করে বৌদ্ধ বালক-বালিকা, শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতী ও বৃদ্ধ-প্রৌঢ়সহ সব শ্রেণীর নর-নারীরা এ দিন বৌদ্ধ বিহারগুলোতে গিয়ে বুদ্ধ ও ভিক্ষুসংঘকে মধু দান করার উৎসবে মেতে ওঠে। এ দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রতিটি বৌদ্ধবিহার ও বিহারের প্রাঙ্গণগুলো মধুদানের এক আনন্দঘন পরিবেশে মুখর হয়ে ওঠে।
আমরা জানি বুদ্ধ বুদ্ধত্ব লাভের পর মোট পঁয়তাল্লিশ বর্ষ বর্ষাবাসব্রত পালন করেন প্রাচীন ভারতবর্ষের নানা বিহার, অরণ্য, পর্বত, গুহা, আরাম প্রভৃতি নানা স্থানে। তন্মধ্যে একবার বর্ষাবাস যাপন করেন পারলেয়্য নামক বনে। সেই পারলেয়্য বনে ছিল নানা পশুপাখি ও জীবজন্তুর আবাস।
বুদ্ধের অপরিসীম মৈত্রী প্রভাবে বনের সেসব পশুপাখি ও জীবজন্তুরা তাদের স্বভাবজাত হিংস্রতা পরিহার করে মহামানব বুদ্ধকে অহিংসা, দান, সেবা ও শ্রদ্ধার আদর্শ প্রদর্শন করেছিল। এমনকি অরণ্যের বন্য হস্তীসহ সেখানকার নানা ধরনের পশুপাখি ও জীবজন্তু বুদ্ধকে নানাভাবে তিন মাস সেবাযত্ন করেছিল।
ভাদ্র মাসের এই পূর্ণিমার সঙ্গে বুদ্ধজীবনের বানরের মধুদানের এক বিরল ঘটনা জড়িয়ে আছে। সে দিনের বানরের এই মধুদান একটি নিছক ঘটনা মনে হলেও এর থেকে আমরা একটি পশুর ত্যাগ, সেবা ও দানচিত্তের এক মহৎ শিক্ষা পেয়ে থাকি।
বনের একটি বানর হয়ে বুদ্ধকে দান দিয়ে যেখানে তার মহৎ উদার ও ত্যাগের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছে, সেখানে আমরা সর্বশ্রেষ্ঠ জীব মানুষ হয়েও বিপন্ন মানুষের প্রতি সেই উদারতা, ত্যাগ, দান, সেবা দেখাতে পারছি না। পারছি না মানুষের প্রতি ভালোবাসা, মৈত্রী, করুণা, দয়া প্রভৃতি মানবীয় গুণাবলির আদর্শ ও আচরণ দেখাতেও।
আজ মানুষের প্রতি মানুষের সেবা, দান, ভালোবাসা ও সহানুভূতি তেমন নেই বললেই চলে। মানুষের আর্তনাদ ও অভাব-অনটন দেখেও মানুষ তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চায় না। মানুষ মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মান প্রদর্শন করছে না। মানুষ মানুষের জীবন সংহার করছে দেখেশুনে। মানুষ যেন তার মানবিক গুণাবলি থেকে দিন দিন দূরে সরে যাচ্ছে। এটাই কী মানুষের ধর্ম?
মানুষের প্রেমভরা হৃদয় যেন কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। এ রকম হওয়ার তো কথা ছিল না। যেখানে বনের একটি বানর বুদ্ধকে মধু দান করে তৃপ্তি পেয়েছে, আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছে; এমনকি বনের বন্য হস্তিও যেখানে বুদ্ধকে তিন মাস সেবা করে অপার আনন্দ অনুভব করেছে, সেখানে আমরা জীবের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হয়েও মানুষের প্রতি সেই দান, ত্যাগ, ভালোবাসা দেখাতে পারছি না। এর চেয়ে লজ্জার বিষয় আর কী হতে পারে?
গোটা বিশ্বসহ আমাদের দেশের সর্বস্তরে আমরা আজ এই করুণ ব্যাধিতে আক্রান্ত। অন্যদিকে আবার চলছে দান ও সেবার বিনিময়ে কত বিপন্ন ব্যবসা আর কত জঘন্য অপরাধ ও নির্মমতা। মানুষের স্বভাব হয়ে গেছে বনের হিংস্র পশুপাখি ও জীবজন্তুর চেয়েও অনেক খারাপ। আমরা আগে তাদের দেখলে অবজ্ঞা করতাম, অবহেলা করতাম। এখন তারা আমাদের দেখে অবজ্ঞা করে, অবহেলা করে।
এমনকি আগে আমরা বনের পশুপাখি-জীবজন্তুদের দেখলে ভর্ৎসনা করতাম, গাল-মন্দ করতাম। কিন্তু এখন তারা আমাদের দেখে ব্যঙ্গ করে, ভর্ৎসনা করে। কারণ বর্তমান বিশ্বে এখন আমরা সব ধরনের মনুষ্যত্ব ধর্ম ও মানবতার গুণ হারিয়ে ফেলেছি।
আমরা হয়ে গেছি পূর্বের আদিম অসভ্য বর্বরের চেয়েও খারাপ। দিনদুপুরে মানুষ খুনখারাবি করছে। নানা সন্ত্রাস, অপরাধ এমনকি গুম ও হত্যা করতে একটুও কুণ্ঠাবোধ করছে না। এটাই কি মানবতা? এটাই কী সভ্যতা? এসব দেখে আমি নিজেকে ধিক্কার দিই।
আজ বিবেকের কাছে প্রশ্ন জাগে আমরা কি দান দিয়ে, মানুষকে সেবা দিয়ে এবং অপার ত্যাগে আমাদের চিত্তকে কি প্রীতিতে প্রসারিত করতে পারি না? আমরা কি পারি না অসহায়, নিঃস্ব, হতদরিদ্র এবং বিপন্ন মানুষের প্রতি মৈত্রী, করুণা ও ভালোবাসায় আমাদের হৃদয়কে প্রসারিত করতে? আজ বাংলাদেশসহ বিশ্ব পরিস্থিতি দেখে এমন প্রশ্নগুলোই আমাদের বারবার ভাবিয়ে তুলছে।
আজ শুভ মধু পূর্ণিমা আমাদের সেই মহৎ শিক্ষাই দিচ্ছে- আমরা যেন আমাদের মানবীয় গুণাবলিতে পুনরুজ্জীবিত হই, সিক্ত হই এবং দানে, ত্যাগে ও পরপোকারে বিশ্ব মানবতায় এগিয়ে যাই।
অতএব, বৌদ্ধদের এসব পূজা-পার্বণ ও ইতিহাস-ঐতিহ্য থেকে আমরা মানুষের জন্য, বিশ্ব মানবতার জন্য নানা ধরনের দান, সেবা ও ত্যাগের মহৎ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি, যেখানে আমাদের সব ধরনের সংকীর্ণতা এবং হিংসা, দ্বেষ, লোভ ও চিত্তের হিংস তা দূরীভূত হয় এবং মৈত্রী, দয়া, দান, সেবা, উদারতা প্রভৃতি মানবিক গুণাবলিতে আমাদের চিত্ত যেন করুণাসিক্ত হয়। এগুলো ধর্মের সর্বজনীন শিক্ষা।
এ জন্যই বুদ্ধের শিক্ষা হল জীবনের সব ক্ষেত্রে অকৃত্রিম উদার চিত্ত হওয়া, বিবেক-বুদ্ধিকে জাগিয়ে তোলা এবং দান-ত্যাগ-সেবায় নিজকে পরিপূর্ণ করা। কারণ অজ্ঞানতা, মূর্খতা মানুষের কখনও কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না।
মন্দ ও অকুশলকর্মে মানুষ কখনও মহৎ হতে পারে না। এমনকি এসব অপকর্মে দেশ ও সমাজ কখনও উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে এগোতে পারে না। পারে না বিশ্ব মানবতাকে উপকৃত করতে। অন্ধকার দিয়ে যেমন আলোকে আহ্বান করা যায় না, তেমনি অকুশল এবং মন্দকর্ম দিয়ে কখনও সৎ, শুভ ও মঙ্গলকে আলিঙ্গন করা যায় না। এটাই হচ্ছে বৌদ্ধ যুক্তিবিজ্ঞানের মূল কথা।
অতএব, চলুন আমরা আজ মহামতি বুদ্ধের এই শিক্ষা থেকে জীবন প্রতিষ্ঠার সব গুণ ও আদর্শ গ্রহণ করি। দান, সেবা ও ত্যাগে জীবনকে মহিমান্বিত করি। বিদ্যা ও জ্ঞানে আমাদের জীবনকে ধন্য ও সার্থক করি। বৌদ্ধ মধু পূর্ণিমা সফল হোক।
সব্বে সত্তা সুখিতা ভবন্তু- জগতের সকল জীব সুখী হোক। ভবতু সব্ব মঙ্গলং- সকলের মঙ্গল লাভ হোক। বাংলাদেশ সমৃদ্ধময় হোক। বিশ্বে শান্তি বিরাজ করুক। নিব্বানং পরমং সুখং- নির্বাণ পরম সুখ, নির্বাণ পরম শান্তি।
প্রফেসর ড. সুকোমল বড়ুয়া : সাবেক চেয়ারম্যান, পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; সভাপতি, বিশ্ব বৌদ্ধ ফেডারেশন-বাংলাদেশ চ্যাপ্টার
এসি
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।