ঢাকা, রবিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

শেষ বিকেলের আলো

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২১:১৭, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ২১:২১, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

Ekushey Television Ltd.

"আন্নেরা কই থন আইসেন আফু? আমগোরে দেখতা নি আইসো? কত মাইনসে আহে.......হুদা আহে না......." জীবন সায়াহ্নে দু:খ ভারক্রান্ত মনে আক্ষেপ নিয়ে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন বিনতি সেন বনলতা। বয়সের দিক থেকে সত্তোরের কোঠায় পাঁ রেখেছেন আরও আগেই। 

বনলতা সেনের জীবনের এই অন্তিম লগ্নে এসে ঠাঁই হলো এক আশ্রমে। শেষ বয়েসের হেরে যাবার গল্প শুনাতে গিয়ে  করলেন নিজ থেকেই।

নিজ নিয়তিকে মেনে নিয়ে আক্ষেপ করছিলেন তার সঙ্গে আশ্রমে থাকা অন্য এক পৌঢ়া মৃণালিনী দেবীর (ছদ্মনাম) ভাগ্যে ঘটে যাওয়া নির্মমতার কথা মনে করে। এক কথা, দু’কথায় অব্যক্ত কথাগুলো ভাষা পেতে শুরু করে মৃণালিনী দেবীর। শখ করে ছেলের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন আশ্রমে আসার বছর দুই পরে। আশ্রমের ছুটি যে সহজে মেলে না। সেবার পূজোর আয়োজন সারা বাড়ি জুড়ে। বউমাকে দেখে আবেগে কেঁদে দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন মৃণালিনী দেবী।

কতদিন পর দেখা! ছেলে-বউ বাচ্চা। কাজের চাপে মাকে ভুলে যেতেই পারে। কিন্তু মৃণালিনী কি করে ভুলেন? যেই বউমাকে জাপটে ধরলেন, এমনি করে সাথে সাথে এক ঝটকা মেরে সরিয়ে দিলেন বুড়ো মানুষটাকে। বুড়ো বয়েসের শরীরের গন্ধে যদি দামি পারফিউমের ঘ্রাণ ফিকে হয়ে যায়? এই ভয়ে কাছেই ঘেষতে দিলেন না। নিরুপায় হয়ে কাজের মেয়েকে দিয়ে কোনো রকমে স্টোর রুমটা পরিষ্কার করে থাকার মত করে নিয়েছিলেন তিনি।

পূজোর সকাল, তাই সবাই ট্রেন্ডি কাপড়ে তৈরি। মাকে ছাড়া পূজো দেরি হয়ে যাবে এই চিন্তায় কাঁপা হাতে তিন বছর আগে ছেলের দেওয়া শেষ শাড়িটা পরে নিলেন মৃণালিনী। বাড়ির কর্ত্রী বাদ দিয়ে ছেলের ইচ্ছায় বৃদ্ধা পূজোর থালি নিতে হাত বাড়ালে বউমা প্রদীপের গরম তেলটা হাতেই ফেলে দিল। গরম তেল পড়ে  মৃণালিনীর কুচকে যাওয়া চামড়া ছেত করে পুড়ে গেল। পুড়ে যাওয়া অংশে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছিল তার। কিন্তু মৃণালিনীর শরীর পুড়া জ্বালার চেয়ে মনের জ্বালাটা কয়েকশ গুণ বেশি ছিলো। বউ না হয় অন্য বাড়ির মেয়ে। তার অবহেলা মনকে বুঝানো যায়। কিন্তু দশ মাস দশ দিন যে ছেলে সে জঠরে ধারন করেছিলো সেই ছেলের এমন তাচ্ছিল্য, অবেহেলা ও বকাঝকার কিছুতেই মনে সইছিলো না তার। বুড়ো বয়েসে মৃণালিনীর আধিখ্যেতা নাকি তার সংসারে অশান্তি ডেকে আনছে!

সেদিন দু`বেলা অভুক্ত, পোড়া হাত দিয়ে খাবার যে জো নেই। মাঝরাতে খিদের জ্বালায় মৃণালিনী রসুইঘরে (রান্নাঘরে) যান। কিন্তু বউমা মৃণালিনীর পুড়ে লাল হয়ে যাওয়া হাতটা এক ঝটকায় টান দিলে তিনি আছাড় খেয়ে সামনের বেদিতে পড়ে যান। বুড়ো মানুষ ভুলে গেলেন যে বউ এর জিনিসে বাইরের কেউ হাত দিলে তার মেজাজ চটে যায়। মাঝখান থেকে ছেলেটার মায়ের কাজের জন্য বারবার বউয়ের কাছে মাফ চাইতে হল।

মৃণালিনীর ছেলেটা ছোটবেলা থেকেইবড় বাধ্য। ঝামেলা একদম সইতে পারে না! তাইতো মৃণালিনীর শেষ ইচ্ছেটাও পূরণ করেছিল। পরদিন ভোরেই আশ্রমে রেখে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে তড়িৎ গতিতে। বুধবার সকালে মৃণালিনী দেবীকে আশ্রমে রেখে যাওয়ার সময় মায়ের প্রতি মায়া দেখিয়ে পাঁচশো টাকা হাতে গুঁজে দিলেন। যাওয়ার সময় বলে গেলেন তার সংসারে যেন মৃণালিনী আর অশান্তি না করেন। মৃণালিনী এবারও তার ছেলের কথা রেখেছেন। ওই ঘটনার পর পাঁচ বছর হয়ে গেলেও ছেলের সংসারের অশান্তি করতে আর কখনও সে যায়নি! কোনো ধরনের যোগাযোগও নেই তার ছেলের সংসারের সাথে। ছেলে বউ নিয়ে সুখে আছে এতেই মৃণালিনীর শান্তি খুজে পান। মরবার আগে এর চেয়ে আর বেশি কী বা  চাওয়ার আছে মৃণালিনীর!

উপরের ঘটনাকে কেউ আমার মস্তিষ্ক প্রসূত মনে করলে ভূল করবেন। এই ছিল চট্টগ্রামের রাউজানের নোয়াপাড়ায় অবস্থিত "আমেনা বশর বৃদ্ধাশ্রম" এর প্রতিনিয়ত ফেলা দীর্ঘশ্বাস এর কেবল একটি। আমি কেবল নামটা বদলে দিয়েছি,আশ্রমের দাদুকে যে কথা দিয়েছি তার নাম কেউ জানবে না। নাম জানলে যে বদনাম হবে আদরের ছেলের!

এমন হাজার গল্পের সাক্ষী একেকটা আশ্রম। এই প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের যত্নের কমতি রাখেনি, তবুও ছানি পরা চোখগুলো প্রতিনিয়ত খুঁজে ফিরে তাদের প্রিয়জনদের হাসিমাখা মুখগুলোকে। একেকটা আশ্রম যেন পরাজিত মানবতার দুঃসহ কষ্টের, গ্লানির আর কান্নার অসহ্য বেদনার এক নীড়। যে সন্তানের ভবিষ্যতের চিন্তায় মা-বাবা জীবনের শেষ সম্বলটুকু বিলিয়ে দিয়েছেন,নিজেদের অস্তিত্বের কথা ভাবেননি। আজ কিনা তাদেরই একটু আদর, একটু সম্মান, সামান্য কথা বলার সময় ভিক্ষা করতে হয় অফিসার, গ্রাজুয়েট ব্যস্ত সন্তানের কাছে!

আমরা আধুনিক হচ্ছি পোশাকে-কলমে! কিন্তু প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে পারছি না! মানবিকতার চরম অপমান ও মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় আমাদের দিন দিন গ্রাস করে ফেলছে। আমি এ রমক আধুনিক যুগের সন্তান হতে চাইনা! জীবন সায়াহ্নে এমন সন্তানের মা হতে চাইনা! এমন সন্তানও হতে চাই না!

শেষ বিকেলের আলোয় জয় হোক মানবতার। ভালো থাকুক জগতের সকল বাবা-মায়েরা।

 

লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (তৃতীয় বর্ষ)

টিকে

 


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি