সংকট কী বিদ্যানন্দের?
প্রকাশিত : ১৯:২৯, ১৮ এপ্রিল ২০২৩
কয়েক বছর আগে থেকেই মানবতার সেবায় ভূমিকা রেখে আসছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। দেশে করোনা ভাইরাস মহামারি দেখা দেওয়ার পর যখন মানুষের জীবনযাপন ও জীবনমান বদলে যায়, সেই চরম দুঃসময়ে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে স্বেচ্ছাসেবামূলক বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করেছেন এ সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরা।
করোনা পরিস্থিতিতে হঠাৎই কর্মহীন হয়ে পড়েন বহু মানুষ। ঘরে সংকট দেখা দেয় খাবারের। চক্ষুলজ্জায় হাতও পাততে পারতেন না কারো কাছে। শিশুসন্তানসহ পরিবারের সবাইকে থাকতে হয়েছে অভুক্ত, অর্ধভুক্ত। শহরের ফুটপাত ও বস্তির এমন ভাসমান, অসহায় নিম্ন আয়ের হাজার হাজার মানুষকে প্রতিদিন বিনা মূল্যে রান্না করা ও শুকনো খাবার পৌঁছে দিয়েছে বিদ্যানন্দ।
দেশের উপকূলীয় প্লাবন ভূমিতে দুস্থ মানুষের কাছেও চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দিয়েছে বিদ্যানন্দের ভাসমান হাসপাতাল ‘জীবন খেয়া’। বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের তত্ত্বাবধানে মোংলা বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে উপকূলের ২১টি পয়েন্টে চিকিৎসাসেবা দিয়েছে ‘জীবন খেয়া’। আটজন চিকিৎসক, দুইজন দন্ত চিকিৎসক এবং দুইজন চক্ষু বিশেষজ্ঞসহ নার্স, ফার্মাসিস্ট, স্বেচ্ছাসেবক ও কর্মচারীরা হাসপাতালটি পরিচালনা করছেন।
সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ সহায়তা থেকেই এসব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে।
আনন্দের মাধ্যমে শেখা—এ মূলমন্ত্র থেকেই ‘বিদ্যানন্দ’ নামের সৃষ্টি। পড়ব, খেলব, শিখব—এ স্লোগানকে সামনে রেখে ২০১৩ সালের ২২ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জের প্রত্যন্ত এক গ্রাম থেকে বিদ্যানন্দের কার্যক্রম শুরু হয়। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে পরে আরও নানামুখী উদ্ভাবনী প্রকল্প পরিচালনার মধ্য দিয়ে বিদ্যানন্দ আজ দেশে-বিদেশে আলোচিত ও অনুকরণীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে পরিণত হয়েছে। সংগঠনটি তাদের নানাবিধ কর্মকাণ্ডে মানুষের জন্য কাজ করে পেয়েছে রাষ্ট্রীয় সর্বচ্চ সম্মান একুশে পদক।
২০১৬ সালে শুরু হওয়া ‘এক টাকায় আহার’ প্রকল্পের মাধ্যমে পথশিশু, এতিম ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা মাত্র এক টাকার বিনিময়ে খাবার কিনে খাওয়ার সুযোগ পায়। প্রতিদিন হাজার হাজার শিশুকে খাবার প্রদানের মাধ্যমে এ প্রকল্প এরই মধ্যে ৮০ লাখেরও বেশি মানুষকে খাদ্য সহায়তা দিয়েছে।
সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী, রংপুর, রাজবাড়ী, কক্সবাজার, বান্দরবান পার্বত্য জেলা ও খাগড়াছড়িতে রয়েছে বিদ্যানন্দের স্কুল ও শিখন কেন্দ্র। শিশু শ্রেণি থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত এসব স্কুল ও শিখন কেন্দ্রে প্রায় এক হাজার শিক্ষার্থীকে বিনা মূল্যে শিক্ষা, শিক্ষা উপকরণ ও শিক্ষা বৃত্তি প্রদান করা হয়।
দরিদ্র শিশু ও বয়স্ক মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বিদ্যানন্দের রয়েছে ‘এক টাকায় চিকিৎসা’ কার্যক্রম। দুর্গম এলাকার এতিম অনাথ শিশুদের জন্য বিদ্যানন্দের রয়েছে বেশ কয়েকটি এতিমখানা। এতে ঠাঁই হয়েছে অসংখ্য এতিম শিশুর। দুস্থ মহিলাদের আত্মনির্ভরশীল করতে রয়েছে ‘বাসন্তী গার্মেন্টস’ প্রকল্প। এর মাধ্যমে দরিদ্র কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালে সচেতন করতে ‘বাসন্তী স্যানিটারি প্যাড’ নামে মাত্র এক টাকায় বিশেষ প্যাডের ব্যবস্থা করা হয়।
ঢাকায় নানা কাজে আসা নারীদের মাত্র ৭১ টাকার বিনিময়ে এক রাত থাকার সুবিধা দেওয়া হয় আবাসিক হোটেল ‘বাসন্তী নিবাসে’। ‘যখন খুশি, তখন খাবে’ পথশিশুদের খাওয়ার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে বিদ্যানন্দের উদ্ভাবনী প্রকল্প ‘খাবারের এটিএম মেশিন’। প্রতি বছর রমজান মাসে বিদ্যানন্দের ইফতার ও সাহির বিতরণ কার্যক্রম ‘সিয়াম সাধনায় একসাথে’ পরিচালিত হয়। ‘দুস্থদের সাথে আমার কুরবানি’ উত্তরবঙ্গের দুর্যোগকবলিত এলাকায় গরু-ছাগল কোরবানি করে রান্না করা হয় এবং বিতরণ করা হয় দুস্থ পরিবারগুলোর মাঝে। সাহিত্যের বই প্রকাশের জন্য রয়েছে ‘বিদ্যানন্দ প্রকাশনী’।
এতো কিছুর পরেও সম্প্রতি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিদ্যানন্দের যাকাত, ভুল ছবি পোস্ট, অডিট রিপোর্টসহ নানা বিষয় নিয়ে নানা রকমের আলোচনা-সমালোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বিষয়গুলো নিয়ে বেশ সংকটে পড়েছে সংগঠনটি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- এই সংকট আসলে কার, বিদ্যানন্দের নাকি আমাদের মত রুচিশীল মানুষদের?
‘কাজ করতে গেলে ভুল হবেই’ এই প্রবাদ যেমন প্রচলিত ঠিক তেমনি ভুল করলে ক্ষমা করাও মহৎগুন।
একটি সেবামূলক সংগঠন, সেবাই যাদের প্রধান উদ্দেশ্য, যাদের কর্মীরা সবাই বিনা পারিশ্রমিকে মানুষের জন্য কাজ করছে, তাদের বিরুদ্ধে একজোট হয়েছে এক শ্রেণীর মানুষ।
বিষয়টি নিয়ে ফেসবুক লাইভে কথা বলেছেন বিদ্যানন্দের প্রতিষ্ঠাতা কিশোর কুমার দাস। বিদ্যানন্দের চেয়ারম্যানের পদ ছাড়তেও তার আপত্তি নেই বলে জানিয়েছেন তিনি।
যাকাত নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘জাকাত ফান্ড আমরা নিতে চাইনি। এক হুজুর আমাকে বললেন, আপনি নেবেন না কেন, এটাকে অস্পৃশ্য মনে করছেন কেন? মানুষ দিলে আপনাকে নিতে হবে। না নিলে আরেক ধরনের বিজ্ঞাপন হবে। এজন্য আমরা চুপচাপ থাকি, মানুষ দিলে দেবে, না দিলে নাই। টোটাল ফান্ডের মাত্র ৫ শতাংশ যাকাত থেকে আসে।’
পার্বত্য চট্টগ্রামে কার্যক্রম চালানো বেশিরভাগ জমি শর্তসাপেক্ষে লিজ নেওয়া বলে দাবি করেন কিশোর। তিনি বলেন, ‘বিদ্যানন্দ কার্যক্রম বন্ধ করলে জমিগুলো মালিকের কাছে ফেরত যাবে। অনাথদের শিক্ষা কার্যক্রমে এ জমি ব্যবহৃত হবে।’
মজিদ চাচা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ভালো ট্রল হচ্ছে। একবার একটা পোস্টে সত্যিকারের নাম দেই। সেই নামটা বিখ্যাত কারও নামে ছিল। তখন বলা হয়, ইচ্ছে করে ওই লোককে অপমান করার জন্য ওই নাম দেওয়া হয়েছে। সেজন্য আমরা সাধারণত রূপক নাম ব্যবহার করি। শুধু মজিদ না অনেকগুলো নাম পাবেন, একই নাম বার বার পাবেন।’
একই গরুর ছবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আপনাদের কাছে চ্যারিটিটা হচ্ছে একটা অ্যাকশন, আমাদের কাছে সেটা যাত্রাপথ। প্রতিটি যাত্রাপথে মানুষকে ইনভলভ করি।’
তিনি বলেন, ‘অডিট নিয়ে যারা কথা বলছেন, তারা আমাদের একটা রিপোর্ট নিয়ে অডিট ফার্মে যান, জিজ্ঞসা করেন এটার কোথায় কোথায় ত্রুটি আছে। বিদ্যানন্দের টাকা ব্যক্তিগতভাবে নেওয়া হয় না। ব্যাংকে যায়, অডিট ফার্মগুলো ব্যাংক থেকে রিপোর্ট নেয়। আমাদের বেশিরভাগ খরচ বড় বড় ভেন্ডর থেকে করা হয়। আমাদের অডিট রিপোর্ট অনলাইনে আছে।’
জামাকাপড়ের ভুল ছবি পোস্ট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ইটস অ্যাবসুলেটলি অনেস্ট মিস্টেক। প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে মাফ চাই।’
তিনি বলেন, ‘পদ ছাড়তে আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি চাই এখান থেকে সরতে। আমাদের ৮-১০ টা ফেসবুক পেজ আছে৷ কম্বাইন্ড এ পর্যন্ত প্রায় ৩০ হাজার লেখা লিখেছি। এর মধ্যে ৩০টা ভুল আপনি পাবেনই। এরকম লেখার জন্য আমাদের পেইড প্রতিষ্ঠান নেই। বিদ্যানন্দ বন্ধ হয়ে যাবে, এটা নিয়ে আমো ভয় পাই না। যদি মনে হয় প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিক, ইটস অ্যাবসুলেটলি ওকে।’
কারও কোনো ক্ষোভ বা অনুযোগ নেই জানিয়ে কিশোর বলেন, ‘আমরা মন খারাপ করছি, কিন্তু ক্লান্ত না। দেশের গোয়েন্দা সংস্থার কাছে আমরা নিয়মিত রিপোর্ট করি। আমরা লাগামছাড়া প্রতিষ্ঠান না। আপনার নীতির সঙ্গে মিললে অনুদান দেবেন। দাতব্য প্রতিষ্ঠানে প্রশ্ন করার রীতিটা ভালো, অদূর ভবিষ্যতের জন্য। ধাক্কাটা আমাদের মধ্যদিয়ে গেছে, এ প্রশ্ন বাকিদের প্রতিও আসবে, প্রতিষ্ঠানগুলো আরও বেশি শুদ্ধ হবে।’
সবকিছু দেখে, শুনে বুঝে এটা বলতেই হবে- প্রতিহিংসা নয় পরামর্শ নিয়ে বিদ্যানন্দের পাশে থাকুন। কারণ বিদ্যানন্দ পেশাজীবীদের দ্বারা পরিচালিত নয়, স্বেচ্ছাসেবীদের দ্বারা প্ররিচালিত প্রতিষ্ঠান।
কোন ঐশী লোভ নয়, কেবলমাত্র মানুষের ভালো করতে চাওয়া থেকে এমন একটা স্বেচ্ছাসেবা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠা অভূতপূর্ব অনুপ্রেরণা।
শুধু সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্র নয়, সকল শ্রেণীর ষড়যন্ত্র থেকে এই প্রতিষ্ঠানকে নিরাপদ রাখা আমাদের দায়িত্ব।
এসএ/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।