সংকোচ নয় প্রতিবাদেই সমাধান
প্রকাশিত : ২২:৫৩, ১৩ মার্চ ২০২০
রাজধানীর সবচেয়ে ব্যস্ততম এলাকা কারওয়ান বাজার মোড়। এখানেই সোনারগাঁ হোটেলের ঠিক বিপরীত দিকে জাহাঙ্গীর টাওয়ারে আমার কর্মস্থল। থাকি কাঁঠাল বাগানের দিকে।
বাসা থেকে অফিসের দূরত্ব বেশিদূর না হওয়ায় পায়ে হেঁটেই অফিসে যাওয়া-আসা হয়। এ পথের মাঝেই দেশের অন্যতম জনপ্রিয় আরেকটি টেলিভিশন রয়েছে বাংলাভিশন। চ্যানেলটির পাশের রাস্তা দিয়ে হাতিরপুল হয়ে সোজা সময় টিভির সামনে দিয়ে কারওয়ান বাজার ও পান্থপথে বের হওয়া যায়।
সড়কটি প্রধান সড়কের মতোই সব সময় ব্যস্ত। এই সোনারগাঁ মোড়ে প্রতিদিন সময় ভাগ করে একজন পুলিশ ও আনসার সদস্য যানজট নিরসন ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে কাজ করেন।
কিন্তু আসা-যাওয়ার মাঝে যে দৃশ্য প্রতিদিন দেখি তাতে অনেকটা চোখ কপালে না উঠলেও বিবেকের কাছে যে কেউ ধাক্কা খাবে। তাদের ওপর যে দায়িত্ব রয়েছে সেটি পালন করার কথা যেন ভুলেই গেছেন কর্তব্যরত এসব নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা।
প্রতিদিন এ রাস্তা দিয়ে অন্তত দু’বেলা যাওয়া-আসার মাঝে চোখে পড়ে নানা অসঙ্গতি আর কারসাজি। জবাবদিহিতার চর্চা না থাকায় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলে সরাসরি চাঁদাবাজি। আর এ চাঁদা আদায় করতে গিয়ে অনেক সময় বাঁধছে যানজট, তবে এতে নেই কারো ভ্রক্ষেপ। তাদের এমন নির্লজ্জ কাজের কারণে রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে চাঁদা আদায় করায় নিত্য তৈরি হচ্ছে যানজট, সংকুচিত হয়ে পড়ছে রাস্তা।
সরকার ঘুষ বা দুর্নীতি বন্ধে জোরালো প্রচেষ্টা চালিয়ে গেলেও সবার নাকের ডগায় নিশ্চিন্ত মনে তারা এমন কাজটি করে যাচ্ছে। তবে এটি শুধু যে এ জায়গার ঘটনা তা নয়, পুরো ঢাকা শহরেই আমরা এমন চিত্র প্রায়ই দেখি। গাড়ি থামিয়ে চাঁদা আদায়ে কখনো কখনো যাত্রীরাও হয়রানির শিকার হচ্ছে। চাঁদা না দিলে গাড়ির কাগজ নেই বা কোনো অজুহাতে যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে গাড়িটি আটকে রাখে।
যাক ফিরে আসি নিজের কথায়, এ রাস্তায় দিনের আলোয় একেকটি রিকশা ও মালবাহী গাড়ি থেকে শুরু করে পিকআপ ভ্যানকে দাঁড় করিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছেন হাজার হাজার টাকা। অনেকে প্রতিবাদ করতে চান, কিন্তু পুলিশ বলে কথা। জীবনের ভয়ে, ঝামেলা এড়াতে প্রশাসনের এমন হীনকাজ দেখেও মুখে কুলুপ এঁটে, চর্মচক্ষুকে অস্বীকার করে, বিবেকের কাছে পরাজিত হয়ে ছুটে চলেন নিজ নিজ গন্তব্যে।
তাই কে ভাববে এসব নিয়ে? কার সাহস আছে পুলিশের এই চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার?
নিত্যদিনের এমন চিত্র দেখে নিজেও প্রতিবাদ না করায় বিবেক আমাকে প্রতিনিয়ত কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। অফিসে কাজের ফাঁকে, বাসায় শুয়ে শুধু এই চাঁদাবাজির দৃশ্য চোখে ভাসে। বারবার মনে প্রশ্ন জাগে আমি এতোটাই কাপুরুষ যে অন্যায় দেখেও মুখে কুলুপ এঁটে আছি, প্রতিবাদ করছি না। কেউ যেন পেছন থেকে টেনে ধরছে আমায়। কিন্তু, এবার জেগে ওঠার সিদ্ধান্ত নিলাম।
ঘটনা গত মঙ্গলবারের। অফিস থেকে ফেরার পথে সেই মোড়ে খানিকটা দূর থেকে দৃশ্য অবলোকন করছিলাম। কিভাবে প্রতিবাদ করা যায় সে সূত্র খুঁজছিলাম।
হঠাৎ মনে হলো ৯৯৯’র কথা। ফোন দিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে বিস্তারিত বললাম। অপরপ্রান্ত থেকে বলা হলো-এটা ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব। আপনি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। তারা কেন্দ্রীয় ট্রাফিক পুলিশ কন্ট্রোল রুমের নাম্বার দিলেন, পরবর্তী পদক্ষেপে এগিয়ে গেলাম।
যোগাযোগ করা হলে ট্রাফিক কন্ট্রোল রুম থেকে বলা হলো, অনেকে দেখেও আমাদের জানায় না, আপনি সচেতন বলেই জানিয়েছেন। আপনাকে ধন্যবাদ। আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি, আপনিও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তাকে আপনার অভিযোগের কথা জানান।
মুঠোফোনে ট্রাফিক কন্ট্রোল রুমের ভেসে আসা এমন কথায় প্রতিবাদের ইচ্ছাশক্তি আরও বেড়ে গেল কয়েকগুণ। গেলাম কারওয়ান বাজার মোড়ের পুলিশ বক্সে। দায়িত্বরত এক পুলিশ কর্মকর্তার নাম শংকর। তার নিকট তুলে ধরলাম ঘটনার আদ্যপান্ত।
তিনি বললেন, ‘দেখেন মিডিয়া আর আমরা হচ্ছি ভাই ভাই। তাই বিষয়টি সেভাবে নিলে ভাল হত।’
তিনি নিজেকে ভাল প্রমাণ করতে গিয়ে অকপটে চাঁদাবাজিকে সায় দিলেন। তারপরও বললেন, ‘এটি আমাদের দায়িত্বে নেই, উত্তরে পড়েছে। আপনি তাদের সাথে যোগাযোগ করুন।’
সেখানকার দায়িত্বরত পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে আবারও তুলে ধরলাম নিজের সাহসে যতটা কুলায়। তিনি বললেন, এখনই ব্যবস্থা নিচ্ছি। তিনিও ট্রাফিক কন্ট্রোল বিভাগের মতোই অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে বললেন, ‘সবাই যদি আপনার মত সচেতন হতো, তাহলে এসব হতো না। আমি এখনি ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
ওই পুলিশ কর্মকর্তার নাম সংগ্রাম। তার এমন বক্তব্যে যতটা আশাবাদি হয়েছি, তারচেয়ে আশঙ্কায় ছিলাম হয়তো এটি ক্ষণিকের জন্য হবে। পরদিন একই চিত্র দেখতে হবে আমায়। তারপরও বুকে আশা বেঁধে তিনি কি ব্যবস্থা নেন তা দেখতে ঘটনাস্থলের পাশেই দাঁড়িয়ে থাকলাম।
কিছুক্ষণ পর এক পুলিশ কনস্টেবল সম্ভবত আসলেন। নাম শফিউদ্দিন। তিনি ওই চাঁদাবাজ পুলিশদের পাশে ডেকে নিয়ে কি যেন বললেন। এর কিছুক্ষণপরই তাদের চেহারাটা কেন জানি মলিন হয়ে গেল। দায়িত্ব পালনে সজাগ হলেন, কেউ টাকা দিতে চাইলেও পেছনে দুটো ... দিয়ে নিজেকে সাধু প্রমাণের চেষ্টায় লেগে পড়লেন।
এমনকি আগত পুলিশ কর্মকর্তাও তাদের সাথে কাজে লেগে গেলেন। কোন রিকশাকেই মোড়ের ধারে কাছে থামতে দিচ্ছেন না, মুহূর্তেই যানজট নিরসন হয়ে গেল। অসাধারণ এক পরিবেশ তৈরি হয়ে গেল। এ যেন কল্পনার সেই স্বপ্নের এক টুকরো বাংলাদেশ।
এ দৃশ্য দেখে আনন্দে বুকটা ভরে যাচ্ছিল। ভাবতাম আহ সবসময়ই যদি এমন থাকতো! দেশটা কতোইনা ভাল হতো।
তবে আশঙ্কা ছিল, কিছুক্ষণপর হয়তো আবারো সেই পুরনো দৃশ্য দেখতে হবে। কিন্তু না, হয়নি। পরপর দুদিন পর্যবেক্ষণ করলাম, এখন পর্যন্ত সেই দৃশ্যই আছে।
ফলে অকপটে সেই পুলিশ কর্মকর্তার জন্য মন থেকেই ভালবাসা ও সুন্দর একটা স্বপ্নের বীজ অঙ্কুরিত হল হৃদয়ে। মনে বিশ্বাস জন্মালো সাহস নিয়ে এগিয়ে আসলে একদিন জাতির পিতার রেখে যাওয়া সেই সোনার বাংলাদেশ গড়ে উঠবে।
ইট-পাথরের শহরে একটু সুখের আশায়, প্রিজনের মুখে হাসির রেশটুকু আনতে কত কিছুই না করতে হয়। হয়তো যারা এমন অপকর্মে লিপ্ত তারাও কোনো সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় এমন নিন্দনীয় কাজ করছেন।
অপরদিকে, স্বার্থপরতার এই সমাজটায় ন্যায়ের ভাষা যখন হারিয়ে গেছে, তখন প্রতিটি দালানের ইটেও ঢুকে পড়েছে অবিশ্বাস ও অনৈতিকতার বাতাস। তারপরও সোনালি ভোরের আশায় এখনো কতিপয় এমন পুলিশ কর্মকর্তা আপনার একটু এগিয়ে আসার অপেক্ষায় দিন গুনছেন। তিনিও স্বপ্ন দেখেন সকল অন্যায় আর অপরাধকে ছুড়ে ফেলে সুন্দর একটি বাংলাদেশ গড়ার।
তাই আসুন ঘুমের ঘোরে না থেকে সবকিছু সয়লাব হওয়ার আগেই জেগে উঠি। যেখানেই দেখবো অন্যায়, আওয়াজ তুলবো প্রতিবাদের। সংকোচ আর মনের ভয়কে পেছনে ফেলে দেশের জন্য এগিয়ে যাবো। কেননা, আমরা জাগলেই কেবল উঠে দাঁড়াবে বাংলাদেশ।
এসি
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।