সন্দ্বীপ এখন আর অবহেলিত জনপদ নয় : মিতা
প্রকাশিত : ১৯:১৬, ১০ ডিসেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ১২:৫৫, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৭
মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন নয়নাভিরাম নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সুন্দরের আঁধার সাগর দুহিতা সন্দ্বীপ। ভৌগলিক কারণে দ্বীপ উপজেলা হলেও শত শত বছর ধরে এখানকার মানুষের জীবনধারা, শিক্ষা, সংস্কৃতির জন্য এটি `ট্যালেন্ট আইল্যান্ড’ হিসেবে পরিচয় লাভ করে। স্বাধীনতার চার দশক পরেও দীর্ঘদিন এটি অবহেলিত ছিল। ১৯৯১ সালের সন্দ্বীপের রাজনীতির অঙ্গনে ধুমকেতুর মতো আবির্ভাব ঘটে মুস্তাফিজুর রহমানের। তিনি সন্দ্বীপের অবকাঠামোগত উন্নয়নে হাত দেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ নানামুখী উন্নয়নে তিনি এগিয়ে নিয়ে যান ২০০১ সাল পর্যন্ত। তারপর সন্দ্বীপের উন্নয়নে ভাটা পরে। দীর্ঘদিনের অবহেলিত জনপদ সন্দ্বীপে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৩ (সন্দ্বীপ) থেকে নৌকা প্রতীকে বিজয়ী হন মাহফুজুর রহমান মিতা। সন্দ্বীপের মাটি ও মানুষের নেতা দ্বীপবন্ধু মুস্তাফিজুর রহমানের সন্তান তিনি। আধুনিক সন্দ্বীপের রূপকার দ্বীপবন্ধুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনি রাজনীতিতে আসেন। সন্দ্বীপের নানাবিদ সমস্যা ও সম্ভাবনা, ভাসান চর ইস্যু, নির্বাচন, উন্নয়ন এবং মনোনয়নসহ সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে ইটিভি অনলাইনের মুখোমুখি হয়েছেন বৈদেশিক শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সদস্য মাহফুজুর রহমান মিতা এমপি। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কাজী ইফতেখারুল আলম তারেক।
ইটিভি অনলাইন : আপনার নির্বাচনী এলাকায় নৌ-যাতায়াত সমস্যা দীর্ঘ দিনের। সম্প্রতি স্পিডবোট ভাড়া ২০০ টাকা নির্ধারনের দাবি উঠেছে। সংসদ সদস্য হিসেবে এই দাবিকে কীভাবে দেখছেন?
মিতা এমপি: মাননীয় নৌ-মন্ত্রী মহোদয় ভাড়া কমানোর পক্ষে মত দিয়েছেন। আমিও সংসদ সদস্য হিসেবে বলেছি- এটি কমাতে হবে। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বলেছেন, ইজারাদের সঙ্গে কথা বলে এটি ঠিক করা হবে। স্পিডবোট ভাড়া ২০০ টাকার মধ্যে রাখার পক্ষে একমত পোষণ করেছেন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান। এটা তো খাস কালেকশন। হঠাৎ একটা অর্ডার দিয়ে বন্ধ করা যায় না। কারণ ঘাট ইজারা দেন হচ্ছেন জেলা পরিষদ। জেলা পরিষদ মন্ত্রীর অধীনে নয়, এটি এলজিআইডি নিয়ন্ত্রণ করে। তবে মন্ত্রী অনুরোধ করতে পারেন। নৌমন্ত্রী একমত পোষণ করেছেন, এখানে এত টাকা ভাড়া নেয়া উচিত নয়। মন্ত্রীর বক্তব্যে উনি ১৫০ টাকার রাখার কথা বলেছেন।
ইটিভি অনলাইন : সাবমেরিন ক্যাবলের সাব সেন্টার আপনি সম্প্রতি পরিদর্শন করেছেন। আমার প্রশ্ন হলো, আপনার কাছে কবে নাগাদ সন্দ্বীপ বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হবে?
মিতা এমপি: সাবমেরিন ক্যাবলের সাব সেন্টারের জন্য জায়গা দেখা হয়েছে। কাজও শুরু হয়ে গেছে। ২০১৮ সালের জুনের মধ্যে জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ পাবে সন্দ্বীপবাসী। বিদ্যুত এসে গেলে সন্দ্বীপে ছোট-বড় ও মাঝারি শিল্প গড়ে উঠবে। ফলে দ্বীপ এলাকা বলে অবহেলার আর সুযোগ থাকবে না।
ইটিভি অনলাইন : বহুদিন সন্দ্বীপবাসী উন্নয়নের ধারা থেকে বঞ্চিত ছিল। হঠাৎ করে সন্দ্বীপ নিয়ে সরকারের আগ্রহ বাড়ার কারণ কী? এছাড়া এখানকার মেগা প্রকল্পগুলো কোনটা কি অবস্থায় আছে, তা একটু শুনতে চাই?
মিতা এমপি : জননেত্রী শেখ হাসিনা সন্দ্বীপের উন্নয়নের ব্যাপারে বেশ আন্তরিক। তিনি চান, সরকারের উন্নয়নের চলমান ধারার সঙ্গে সমন্বয় করে সন্দ্বীপকে এগিয়ে নিতে। অন্যদিকে এখানকার মেগা প্রকল্পগুলোর কাজও দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে।
ক) গত ১৮ নভেম্বর সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া ঘাটে ৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে আরসিসি জেটি পুননির্মাণের কাজ নৌমন্ত্রী উদ্বোধন করেছেন। এটি শেষ হতে ১৮ মাস সময় লাগবে। জেটি নির্মিত হলে যাত্রীদের আর কাঁদা পানিতে নেমে কুলে উঠতে হবে না।
খ) পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২টি প্রকল্প অনুমোদন হয়ে আছে। একটি হলো- সাড়ে ২৭ কিলোমিটারের বেড়িবাঁধটি তিন ফিট উচ্চতা বাড়াতে ৩৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা খরচ হবে। ইতোমধ্যে যা টেন্ডার এবং ওয়ার্ক অর্ডার হয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি কাজ শুরু হবে। অন্যটি, সাড়ে ১২ কিলোমিটারের বেড়িবাঁধটি পাথরের ব্লক দিয়ে ভাঙ্গন রোধ করা। এ প্রকল্পে খরচ হবে ১৯৭ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। প্রকল্পটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
গ) সন্দ্বীপে ইকোনোমিক জোন করার ব্যাপারে সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে। গাছুয়া, সন্তোষপুর, আমানউল্যাহ বেল্টে ৫০০ থেকে ১০০০ হাজার একর জমি পেলে একটি ইকোনোমিক জোন করা যাবে। সন্দ্বীপে অর্থনৈতিক এলাকা গড়ে তোলার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
ঘ) সন্দ্বীপকে মূল ভূখন্ডের সঙ্গে (উড়িরচর টু সন্দ্বীপ) যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। সন্দ্বীপের পশ্চিমাংশে চর জেগে ওঠায় অনেকগুলো জায়গা ভরাট হয়ে গেছে। ফলে এখন আর ক্রস বাঁধের প্রয়োজন নেই। সড়ক বাঁধ করতে পারলেই মূল ভূখন্ডের সঙ্গে সন্দ্বীপ সংযুক্ত হতে পারবে। আগামীতে নির্বাচিত হলে আমি এ কাজটি করতে চাই।
ঙ) সন্দ্বীপে একটি দুগ্ধ খামার (ক্যাটাল হাউজ) করার আগ্রহ দেখিয়েছে মিল্কভিটা। ফায়ার স্টেশনের জন্য জায়গা চিহ্নিত করা হয়েছে।
চ) পর্যটন খাতে সন্দ্বীপে একটা বড় সম্ভাবনা রয়েছে। নৌ যাতায়াত নিরাপদ হওয়ার পাশাপাশি এখানে বিদ্যুৎ এলে পর্যটকরা আসবেন। এই খাত নিয়ে আমার কিছু স্বপ্ন রয়েছে।
ছ) সন্দ্বীপে আমার একটি স্টেডিয়াম করার পরিকল্পনা রয়েছে। এর জন্য বেড়িবাঁধের ভেতর খাস জমি খুঁজছি।
জ) বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এখানে একটা ল্যান্ডিং স্টেশন হচ্ছে। বিআইডব্লিউটিএ- এই প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে। সন্দ্বীপের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে একটা বাথিং স্টেশন করবে বিশ্ব ব্যাংক। ঝড়-জলোচ্ছাস হলে যাতে করে বিদেশি জাহাজগুলো বিপদকালীন মুহূর্তে যেন নোঙর করতে পারে। এখানে তারা ড্রেজিং করবে। এ উপকূলকে কেন্দ্র করে সরকারের মাস্টার প্ল্যান রয়েছে।
ঝ) সন্দ্বীপ দুর্যোগপ্রবণ এলাকা। এই বিষয়কে মাথায় রেখে সংসদের ১২তম অধিবেশনে ৩১ ধারা অনুসারে একটি নোটিশ করি। এর পরে ত্রাণমন্ত্রী ১০টি সাইক্লোন সেন্টার প্রদানের আশ্বাস দেন। ইতোমধ্যে ২টির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। বাকিগুলো ধারাবাহিকভাবে নির্মিত হবে।
ইটিভি অনলাইন : সন্দ্বীপ ভাঙ্গনপ্রবণ এলাকা হলেও এখানকার মানুষ সংস্কৃতিবান্ধব। সন্দ্বীপের শিল্প সাহিত্য-সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিতে আপনার কি কি উদ্যোগ রয়েছে?
মিতা এমপি: সন্দ্বীপে শিল্পকলা একাডেমি ভবনের জন্য সংসদে দাবি পেশ করেছি। তবে এ জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। আপনি খেয়াল করলে দেখবেন, বৈষয়িক পরিবর্তনের প্রভাবে সংস্কৃতি বদলে যাচ্ছে। মানুষ এক সময় পাবলিক লাইব্রেরিতে আনন্দমুখর পরিবেশ পেত। এখন সবাই ফেসবুক নির্ভর হয়ে পড়েছে। তথ্য প্রযুক্তির প্রভাবে মানুষ বই থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে।
ইটিভি অনলাইন : তরুণদের উদ্দেশে একজন তরুণ জনপ্রতিনিধি হিসেবে কী বলবেন?
মিতা এমপি : রাজনীতি যার যার, সন্দ্বীপ আমাদের সবার- আমি এ স্লোগান বুকে ধারণ করি। তরুণরা যেন স্বউদ্যেগে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ে। মুক্তিযুদ্বের ইতিহাস জানা থাকলে তারা পথ হারাবে না। সেই সঙ্গে শেকড়ের সঙ্গে তারা যেন সম্পর্ক রাখে। তাহলে সন্দ্বীপ আর অবহেলিত থাকবে না। তরুণদের প্রতি আমার করজোর অনুরোধ, তারা যেন মাদক থেকে দূরে থাকে। যদি মাদকাসক্ত কেউ থেকে থাকে, তাদের বলছি, তোমরা মাদক ছেড়ে সঠিক পথে এসো। মাদকাসক্ত বেকারদের জন্য আমি একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তারা মাদক ছেড়ে দিলে আমি কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেবো।
ইটিভি অনলাইন : সম্প্রতি সংসদ অধিবেশন শেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সন্দ্বীপের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আপনার কথোপকথন হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাই?
মিতা এমপি : আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। এর মধ্যে অন্যতম নেমস্থি/ভাসানচর ইস্যু। ভাসানচরের মালিকানা নিয়ে সৃষ্ট সমস্যাগুলো সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী ওয়াকিবহাল রয়েছেন বলে আমাকে জানিয়েছেন। নোয়াখালির সঙ্গে সন্দ্বীপের সীমানা বিরোধ রয়েছে। জরিপের মাধ্যমেও তা মীমাংসা হয়নি। এটি ৬৩ বছরের আইনি সমস্যা। তবে বৈধতার ভিত্তিতে আমরা ভাসানচরের মালিকানা দাবি করছি। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী সন্দ্বীপের রাজনীতি নিয়েও খোঁজ-খবর নিয়েছেন।
ইটিভি অনলাইন : সন্দ্বীপের মাটি ও মানুষের নেতা ছিলেন আপনার বাবা দ্বীপবন্ধু মুস্তাফিজুর রহমান। তারই ধারাবাহিতায় আপনি রাজনীতিতে এসে সংসদ সদস্য হয়েছেন। তার স্মৃতি রক্ষার্থে আপনার কী কী পদক্ষেপ রয়েছে?
মিতা এমপি: আপনি জানেন, ২০০১ সালে আমার বাবা ইন্তেকাল করেন। তখন সারাদেশে বিএনপি-জামায়াতের নারকীয় তান্ডব ছিলো। ওই মুহূর্তে আমাদের সন্দ্বীপে যাওয়াটা নিরাপদ ছিল না। এ কারণে ওনার সব ব্যবহৃত জিনিসপত্র সংরক্ষণ করা যায়নি। তবে ওনার প্রতি শ্রদ্ধাপ্রদর্শন স্বরূপ প্রতি বছর স্মৃতিবৃত্তি, ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করছি। ২০১৮ সালে ওনাকে নিয়ে একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশিত হবে। এর মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম দ্বীপবন্ধুর সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবে।
ইটিভি অনলাইন : ইতোমধ্যে জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে মাঠ পর্যায়ে নির্বাচনী হাওয়া লেগেছে। দ্বিতীয় দফায় মনোনয়নের ব্যাপারে আপনি কতটুকু আশাবাদী?
মিতা এমপি: আমার দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। দলের পক্ষ থেকে যখন দরখাস্ত আহ্বান করবে, তখন মনোনয়নপত্র দাখিল করবো। মনোনয়ন দেয়ার মালিক জননেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি যদি যোগ্য মনে করেন, তাহলে আবারও আমাকে মনোনীত করবেন।
ইটিভি অনলাইন : আপনি ছাড়াও মনোনয়নের দৌড়ে একাধিক নেতা রয়েছেন। সেই সঙ্গে উপজেলা আওয়ামী লীগে কোন্দল রয়েছে। নির্বাচনের আগে কোন্দল নিরসন করতে পারবেন কি না?
মিতা এমপি: আপনি খুব শক্ত প্রশ্ন করেছেন। আমি প্রতিহিংসার রাজনীতি করি না। আমি মনে করি, সন্দ্বীপ উপজেলায় আওয়ামী লীগে কোনো বিরোধ নেই, আছে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা। রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা থাকবে- এটাতো স্বাভাবিক। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অনেক বড় রাজনৈতিক সংগঠন। এই দলে মাঠ জরিপ করে মনোনয়ন দেওয়া হয়। আর যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচন করেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। সন্দ্বীপকে এগিয়ে নিতে জননেত্রী যাকে যোগ্য মনে করবেন, তিনিই নৌকার টিকেট পাবেন।
ইটিভি অনলাইন : ইটিভি অনলাইনকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মিতা এমপি : ইটিভিকেও ধন্যবাদ। ব্যতিক্রমী সাংবাদিকতায় আপনাদের যাত্রা অব্যাহত থাকুক।
/ডিডি/ এআর
আরও পড়ুন