ঢাকা, শুক্রবার   ২১ মার্চ ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

‘সব বাধা ডিঙ্গিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে নারী’

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৭:৪২, ৮ মার্চ ২০১৮ | আপডেট: ১৪:১৬, ১১ মার্চ ২০১৮

অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম

অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম

Ekushey Television Ltd.

দেশের সারা জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারী। শ্রমবাজারে প্রায় ৬৫ শতাংশ নারী কাজ করছে যা কিনা ভারতের চেয়ে অনেক অংশে বেশি। নারীর ক্ষমতায় বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। নারী মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে ধাপে ধাপে এগিয়ে চলেছে। কর্মক্ষেত্রে তারা নিজেদের দক্ষতা ও কৃতিত্বের প্রমাণ দিচ্ছে। রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে শুরু করে পর্বত আরোহণ, খেলাধুলা সর্বক্ষেত্রে নারী তার দক্ষতা-যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে যখন অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে যাচ্ছে, কিন্তু দু:খজনক হলেও এটা সত্যি রাজনৈতিক পেশীশক্তি, সম্পদহীনতা, গৃহাস্থলি কাজের বোঝা আর অনৈতিক-সহিংস নির্যাতনের কারণে নারীর ক্ষমতায়নে কিছুটা হলেও বাধাগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান  অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম

৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে একুশে টিভি অনলাইনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাতকারে এসব কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী ডিন সাদেকা হালিম। সাক্ষাতাকার নিয়েছেন একুশে টিভি অনলাইন প্রতিবেদক তবিবুর রহমান

তার কথায় উঠে আসে, নারী ক্ষমতায়, নারী শিক্ষা বিকাশ, নারী আগ্রগতি, অর্থনীতি সিদ্ধান্ত গ্রহণে পিছিয়ে থাকার কারণসহ বিভিন্ন বিষয়। সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো

একুশে টিভি অনলাইন : নারী ক্ষমতায়নে মূল বাধা কোথায় ?

অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম: বর্তমানে অনেক বড় বড় ক্ষমতায়নের জায়গায় নারী নিজেদের অবস্থান তৈরি করছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নারী, স্পীকার নারী, বুয়েট ভিসি নারী। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নারী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রো-ভিসি হচ্ছেন নারী। র‌্যাবের বড় পদে নারী। সেনাবাহিনীর বড় পদে নারী স্থান দখল করে আছে। কিন্তু বাংলাদেশে সার্বিক বিষয় বিবেচনা করলে নারী ক্ষমতায়ন পুরুষের তুলনায় অনেক কম।

কিছু কারণে নারী ক্ষমতায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সারা বছর নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার মতো বিষয়গুলো দেখে পরিবারগুলো শঙ্কিত। এসবের ভয়ে অনেক অভিভাবক তার উচ্চশিক্ষিত মেয়েটিকে কর্মক্ষেত্রে দেওয়ার আগেই বিয়ের জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। এসবই সমাজের অস্থিরতার প্রতিফলন। এদিকে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ নারীকে উপাজর্নের জন্যে বাইরে যেতে দিলেও তার উপর ঘরের অমূল্যায়িত কাজ চাপিয়ে রাখছে। ফলে নারী তার সাফল্যের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারছে না। আর নারীদের সস্পত্তিতে অধিকার না থাকায় পরিবারে তাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার হতে হচ্ছে।

একুশে টিভি অনলাইন: বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অগ্রগতি হলেও মানসম্মত ও নিরাপদ কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে সমাজ ব্যর্থ। এর মূল কারণ কি ?

অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম: মানসম্মত ও নিরাপদ কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে সমাজে আমাদের নারীর কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে হবে। উচ্চমানের কর্মসংস্থানে নারীরা পিছিয়ে আছে। কিন্তু মধ্যম মানের কর্মসংস্থানে নারীর অনেক অগ্রগতি হয়েছে। উচ্চ মানের কর্মসংস্থানে যেতে হলে নারী প্রচেষ্টার পাশাপাশি পুরুষের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। সমাজের সব পেশায় নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। তথ্য প্রযুক্তি, কৃষি শিক্ষকতায় নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজের মানুষ মনে করে নারী অনেক পিছিয়ে আছে। ঢালাওভাবে এমন মন্তব্য করা ঠিক না। নারীর মেধা ও কর্ম প্রচেষ্টাকে মূলনায় করে মানসম্মত ও নিরাপদ কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে।

একুশে টিভি অনলাইন: আপনি সমাজের বড় একটি অবস্থানে থেকে নারীর প্রতিনিধিত্ব করছেন। এপর্যন্ত আসতে কী ধরনের বাধা ডিঙিয়ে আসতে হয়েছে আপনাকে ?

অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম: আমার বাবা ফজলুল হালিম চৌধুরী ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। বাবার স্বপ্ন ছিল মেয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে। বাবার স্বপ্ন সত্যি করে পড়াশোনা শেষে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। দেশের প্রথম নারী তথ্য কমিশনার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছি সফলভাবে। ১৯৭০সালে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ প্রতিষ্ঠার পর ৪৭ বছরের ইতিহাসে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের প্রথম নারী ডিন হচ্ছে আমি। আমার স্বপ্নগুলো যেন  খুব সহজে পূরণ হয়েছে এমনটি নয়। আমার পেছনে আমার পরিবার ও সঠিক পরিবেশ ছিল বলেই এতটা পথ আসা সম্ভব হয়েছে।

সমাজ নারীদের এখনও সেকেন্ড পারসন হিসেবে দেখে। নারীরা যোগ্য হলেও উচ্চতর পদে যেতে তাঁদের পেরোতে হয় পাহাড়সম বাধা। নানা অন্তরায়, প্রতিবন্ধকতা পেরিয়েই এ পর্যায়ে এসেছি। আমি আমার অর্জনকে দেখি নারীর ক্ষমতায়নে ইতিবাচক দিক হিসেবে।

একুশে টিভি অনলাইন: নারী শিক্ষায় হার দ্রুত বাড়াতে কি কি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?

অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম: নারী শিক্ষা দ্রুত বৃদ্ধির জন্য আর বাড়তি পদক্ষেপ নিতে হবে বলে আমি মনে করি না। বর্তমান সরকার প্রধান শেখ হাসিনা নারী শিক্ষায় আলোর দিশারী হয়ে কাজ করছেন। শিক্ষাখাতে নারীর অগ্রগতি হয়েছে। প্রাথমিক থেকে শুরু করে অনার্স পযর্ন্ত নারী শিক্ষার হার আশানুরূপ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

একুশে টিভি অনলাইন: স্বাধীনতা চার যুগ পরে নারীর অগ্রগতি কতটা হয়েছে বলে মনে করেন?

অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম: সহস্র সহস্র নারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, শিক্ষা,অফিস-আদালত সর্বত্র মেধা, দক্ষতা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে পেশাজীবী এক নারীগোষ্ঠী তৈরি করেছেন বাংলাদেশে। ব্যাংক, কলকারখানায় আজ ৬২ শতাংশ নারী কাজ করছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আরও বেশি। কূটনৈতিক মিশনে এর মধ্যেই বেশ কয়েকজন নারী নিযুক্ত হয়েছেন। এসব পেশায় আরও নারী নিয়োগের সুযোগ রয়েছে। জাতিসংঘের বিভিন্ন মিশনেও বাংলাদেশের নারীরা কাজ করছেন। আমি মনে করি নারীর অনেকটায় এগিয়েছে।

একুশে টিভি অনলাইন: অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীরা এখনও অনেক পিছিয়ে।  এর কারণ কি?

অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম: অর্থনীতি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এখনও নারী অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে নারীর ক্ষমতায় ও অর্থনীতি সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা বলা হলেও এগিয়ে নিতে ব্যর্থ হচ্ছে সমাজ। এখনও  কোন জমি ক্রয় বিক্রয় থেকে শুরু করে বড় বড় অর্থনীতি সিদ্ধান্ত পুরুষ গ্রহণ করে। কিছু নারীও মনে করছে এ বিষয়গুলো অনেক জটিল বিষয়। এদিনে আমাদের না যাওয়াই ভাল। এই মানসিকতা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।

একুশে টিভি অনলাইন : নারীরা এখন মজুরি বৈষমের শিকার এর কারণ কি?

অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম: নারীরা নিজেদের প্রচেষ্টায় অনেকটা এগিয়েছে। সরকার নারী ও পুরুষের মজুরি বৈষম্য নিরসনে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। যার মাধ্যমে পোষাক শিল্পসহ কিছুটা হলেও মজুরি বৈষম্য নিরসন হয়েছে। তবে গ্রাম এলাকায় এখনও কিছু বৈষম্য রয়েছে। একজন নারী রোজ প্রায় ৮ ঘন্টা গৃহাস্থলির সেবামূলক কাজে ব্যয় করেন। যেখানে পুরুষের ব্যয় হয় মাত্র দেড় ঘন্টা। যার পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক মূল্যায়ন নেই। ফলে নারীরা অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়ছে। নারীর ঘরের কাজের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন খুবই দরকার।

একুশে টিভি অনলাইন : আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম : একুশে পরিবারের প্রতি শুভ কামনা রইল।

‘‘অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ৪৭ বছরের ইতিহাসে প্রথম নারী ডিন। বাংলাদেশের প্রথম নারী তথ্য কমিশনার। মা-বাবা দুজনই শিক্ষক। বাবা অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরী ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত প্রায় সাত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। মা ছিলেন স্কুলশিক্ষক। সাদেকা হালিমের তিন বোন, সবাই আছেন শিক্ষকতা পেশায়। একমাত্র ছোট ভাই ব্যাংকার হলেও তাঁর স্ত্রী শিক্ষক। তাঁর পৈতৃক নিবাস কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার গুণবতী ইউনিয়নে। সাদেকা হালিম ১৯৭৮ সালে ঢাকার উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেছেন প্রথম বিভাগ পেয়ে। ১৯৮০ সালে হলিক্রস স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসিতেও প্রথম বিভাগ পেয়েছেন। পরে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। স্নাতক পর্যায়ে প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় হন। ১৯৮৩-৮৪ শিক্ষাবর্ষে স্নাতকোত্তর করেন প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে। ১৯৮৮ সালে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন নিজ বিভাগে। পরবর্তী সময় কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে পড়তে যান কানাডার ম্যাকগিল ইউনিভার্সিতে। সেখান থেকে মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রি নেন তিনি। এরপর কমনওয়েলথ স্টাফ ফেলোশিপ নিয়ে পোস্ট-ডক্টরেট করেন যুক্তরাজ্যের বাথ ইউনিভার্সিটি থেকে।

২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত তথ্য কমিশনে প্রথম নারী তথ্য কমিশনার পদে প্রেষণে দায়িত্ব পালন করেন। প্রথম নাজমুল করিম গোল্ড মেডেলিস্ট সাদেকা হালিম ২০০৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিন মেয়াদে শিক্ষক সমিতির কার্যকরী পরিষদের সদস্য ও তিনবার সিনেট সদস্য ছিলেন। এবারও শিক্ষক সমিতির সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চ ইন সোশ্যাল সায়েন্সের পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। অধ্যাপক সাদেকা হালিম জাতীয় শিক্ষানীতি কমিটি ২০০৯-এর ১৮ জন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদের কমিটিতে অন্যতম সদস্য ছিলেন। পেশাগত জীবনে সাদেকা হালিম অতিথি অধ্যাপক হিসেবে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনার বকু বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করেছেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে তাঁর লেখা প্রায় ৫০টি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।’’

/ এআর /

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি