সবুজ বাণিজ্যে বাংলাদেশের গ্রামীণ নারীর অবদান বেড়েই চলেছে
প্রকাশিত : ২২:৫১, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ২২:৫৩, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
সত্তরের দশকের শেষ দিকেও আমাদের তৈরি পোশাক খাত সেভাবে যাত্রাই শুরু করতে পারেনি। প্রয়াত নূরুল কাদের খানের হাত ধরে তার চলা শুরু। ‘ব্যাক টু ব্যাক’ এলসির উদ্ভাবন করে সরকারি একটি ব্যাংকই এখাতের এগিয়ে চলার পথকে মসৃণ করে দেয়। পরে অন্যান্য ব্যাংকও এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়। একদল তরুণ উদ্যোক্তা এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত হলে তার অগ্রযাত্রায় গতি আসে। ধীরে ধীরে শুধু ‘টেইলারিং’ হস্তশিল্প থেকে আজ বাংলাদেশের তৈরি পোশাকখাত পৃথিবীতে দ্বিতীয় বৃহৎ রফতানি খাতে রূপান্তরিত হতে সক্ষম হয়েছে।
এই বিস্ময়কর রূপান্তরে সরকার, ব্যাংকিং খাত, উদ্যোক্তা শ্রেণির পাশাপাশি আমাদের নারী শ্রমিকদের অনন্য ভূমিকার কথা না বললেই নয়। গ্রাম থেকে উঠে আসা ৩৫ লাখ নারী শ্রমিকের শ্রমে-ঘামে এ শিল্পের প্রসার ঘটে চলেছে। দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের চেষ্টায় এবং সরকারের নানামুখী প্রণোদনার ফলে এই শিল্প এগিয়ে যাচ্ছে। ব্যাপক স্ব-নিয়োজন ও আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের কারণে এই শিল্পায়ন বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্যে ‘জীবন সঞ্চারি’ (লাইফ-লাইন) হিসেবে স্বীকৃত। তবে বিশ্ব জুড়েই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মানুষের পরিবেশ সচেতনতা বাড়ছে। বাড়ছে সামাজিক ঝুঁকি বিষয়ে সচেতনতাও।
তাই সুষ্ঠু পরিবেশে মানবিক অধিকারসম্মত কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার পক্ষে ক্রেতাদের দাবিও জোরালো হচ্ছে। বিশেষ করে হোম টেক্সটাইল ও বুটিক পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে মানবিক বিষয়গুলো এখন বেশি বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। বড় বড় কারখানায় পরিবেশ ও সামাজিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার মান উন্নত করার ব্যাপক আয়োজনে বাংলাদেশ সম্পৃক্ত রয়েছে। বিদেশি ক্রেতাদের আশ্বস্ত করার জন্যে তাদের সংগঠনগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বড় বড় উদ্যোক্তাদের পরিবেশ ও সামাজিক ঝুঁকি মোকাবিলার প্রয়োজনে নানামুখী সংস্কার কর্মে যুক্ত রাখতে আমাদের সরকার ও রফতানিকারকদের সংগঠনগুলো নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
তবে এসব বড় বড় রফতানিকারকদের পাশাপাশি আমাদের ক্ষুদে ও মাঝারি অনেক উদ্যোক্তাও ন্যায্য বাণিজ্য প্রক্রিয়ায় অংশ নিচ্ছেন। নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করার জন্য বেশ কিছু অ-সরকারি বা এনজিও বিদেশি ভোক্তাদের সবুজ পণ্য সরবরাহের কাজে যুক্ত রয়েছে। এরা নারী শ্রমিকদের গ্রাম থেকে নগরে স্থানান্তর না করে গ্রামেই তাদের স্ব-নিয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে সমাজের ভেতরে কোনো চাপ সৃষ্টি হচ্ছে না। পাশাপাশি পরিবেশসম্মত কাঁচামাল ও রিসাইক্লিং উপাদান দিয়ে মানবিক স্পর্শে এরা তৈরি করছেন এমন সব আকর্ষণীয় বুটিক পণ্য যার কদর বিশ্বের বড় বড় আউটলেটকে বাংলাদেশের তৈরি এসব পণ্যের প্রতি আকৃষ্ট করছে। সবুজ পণ্যের বাণিজ্য প্রসারে নিবেদিত এমনি একটি আশাজাগানিয়া এনজিওর কর্মকাণ্ড দেখতে ক’দিন আগে তাদের সদরদপ্তরে গিয়েছিলাম।
মিরপুর মাজারের কাছেই ‘তরঙ্গ’ নামের এই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটি মূলত অসহায় নারীদের নিয়ে কাজ করে। গৃহস্থালি পর্যায়ে সহিংসতার শিকার নিম্নআয়ের অনেক নারীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়নের জন্য তারা কাজ করেন। ‘তরঙ্গ’ নামের এই সামাজিক উদ্যোগটি এরই মধ্যে সুবিধেবঞ্চিত নারীদের দক্ষতা ও সক্ষমতা প্রদান করে বিশ্ববাণিজ্যের সাপ্লাই চেইনে নিজেকে বেশ ভালোভাবেই যুক্ত করে নিতে সক্ষম হয়েছে। নিজেদের সমাজে নিজেদের বাড়িতে বসেই এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নারীরা কাজ করেন। সমাজ থেকে তুলে এনে শহরাঞ্চলে ছিন্নমূল শ্রমিক হিসেবে স্থানান্তর না করে একেকজন নারীকে স্ব-উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার এক বিরল উদ্যোগের সূচনা করেছে ‘তরঙ্গ’।
ইতোমধ্যে ১৮ হাজারেরও বেশি নারী এমন পরিবেশসম্মত কাজে যুক্ত হয়েছেন। এরা বাংলাদেশের সবুজ পণ্য তৈরি করে ‘তরঙ্গের’ মাধ্যমে বিদেশে রফতানি করছেন। তাদের স্বামী বা পুরুষ আত্মীয়-স্বজনও তাদের কাজের বিরোধিতা না করে বরং সহযোগিতা করছেন। নারীর ক্ষমতায়নের সুফল পরিবারও পাচ্ছে। সামাজিক অশান্তির বদলে সৌহার্দ বাড়ছে। অ্যাডভোকেসির মাধ্যমে পুরুষ সদস্যদের এমন মনের বদল ঘটিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ন্যায্য বাণিজ্যের প্রতিনিধি হিসেবে ‘তরঙ্গ’ সারা বিশ্বের বড় বড় আউটলেটে এখন তাদের পরিবেশসম্মত উপায়ে তৈরি পণ্য বিক্রি করছে। প্রত্যেক নারী যে পরিমাণ বেতন বা পণ্যের মূল্য পান তার ৬ শতাংশ প্রভিডেন্ট ফান্ড হিসেবে তাদের হিসাবে যুক্ত হয়। তরঙ্গ তাতে আরো ৬ শতাংশ যোগ করে। পুরো প্রক্রিয়া স্বচ্ছ। হিসাবনিকাশ ডিজিটাল। কোথাও অস্বচ্ছতা নেই।
সে কারণে বিদেশি ক্রেতারাও খুবই সন্তুষ্ট। দিন দিনই তাই এসব পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। এই মেয়েরা ব্যবসায় পরিকল্পনা বিষয়ে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ পান। কোন পৎপাদন কিভাবে করতে হবে তাও শিখে নেন তরঙ্গের কর্মীদের কাছ থেকে। কচুরিপানা ও পাটের মতো প্রাকৃতিক পণ্যের আঁশ থেকে সূতো, বাঁশ বা গাছের গুঁড়োর অংশবিশেষ থেকে কারুপণ্য, হরিতকি বা নীল গাছের পাতা থেকে প্রাকৃতিক রঙ তৈরি করে আকর্ষণীয় ব্যাগ বা অন্যান্য কারুপণ্য তৈরি করে তারা ঢাকায় পাঠান। ঢাকায় ‘তরঙ্গের’ সদর দফতরের আশ-পাশে কারখানায় এসব পণ্যের মান যাচাই করা হয়। কোনো ত্রুটি থাকলে তা সারানোর ব্যবস্থা করা হয়। ঢাকাতে অনেক নারীকে হাতেকলমে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। সারা দেশে সাত/আটটি কেন্দ্রেও অনুরূপ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। তাদের বাচ্চাদের জন্যে থাকা, খাওয়া ও পড়াশোনার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রশিক্ষণ ছাড়াও তাদের তৈরি পণ্যের নয়াবাজার সন্ধানেও তরঙ্গ কাজ করে। প্রোডাক্ট ডাইভারসিফিকেশন ও অগ্রিম তহবিল শপে দিয়ে এসব নারী উদ্যোক্তাকে সহযোগিতা করছে ‘তরঙ্গ’। বাণিজ্যের সূত্র ধরে অর্থনৈতিক সক্ষমতার মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নে এক সুপরিকল্পিত উদ্যোগ নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। তাদের তৈরি পণ্য এখন লন্ডনের হ্যারডস, ভিকটোরিয়া মিউজিয়াম, বডি অ্যান্ড শপে বিক্রি হচ্ছে। সারা বিশ্বেই তাদের দাপট। সুযোগ পেলেই বিদেশে ‘বাণিজ্য মেলা’তেও তারা অংশগ্রহণ করছেন।
এসব জায়গায় শুধু আমাদের দেশের পণ্যই বিক্রি হচ্ছে না। একটুকরো বাংলাদেশও প্রদর্শিত হচ্ছে। আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, নন্দিত হস্তশিল্পের প্রদর্শনীও ঘটছে। আর প্রদর্শিত হচ্ছে প্রকৃতি সংরক্ষণের এক অসাধারণ সবুজায়নের গল্প। বর্তমানে বছরে প্রায় আট কোটি টাকার মতো রফতানি করছে তরঙ্গ। যদিও অংকের বিচারে এটা খুব বড় নয়, তবে সৃজনশীলতা ও পরিবেশ সুরক্ষার বিচারে এই অভিনব উদ্যোগ চোখে পড়ার মতো। এমন শত শত ‘তরঙ্গ’ হয়তো দেশের আনাচে-কানাচে তরঙ্গায়িত করে চলেছে গ্রাম-বাংলাকে। সবার খবর আমরা রাখি না। সবগুলো তরঙ্গকে সমন্বিত করে একত্রে মেলাতে পারলে সবুজ বাংলাদেশের এক বিরাট ঢেউ নিশ্চয় বিশ্ববাণিজ্যের তীরে তোলা যাবে। এজন্যে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে নানামুখী প্রণোদনা প্যাকেজ নিয়ে।
আমার জানা মতে, ইথিওপিয়ার ক্ষুদে ও মাঝারি এমন অনেক নারী উদ্যোক্তা ফরাসি ও অন্যান্য পাশ্চাত্য দেশীয় ধনী নারীদের ব্যাগ, জুতো ও তৈরি পোশাক সরবরাহ করেন। উঁচু দামের এসব পণ্য প্রাকৃতিক কাঁচামালে প্রধানত হাতে তৈরি হয় বলে ‘বুটিক রফতানি’ পণ্য হিসেবে খুবই কদর পায়। আমাদেরও ক্ষুদে ও মাঝারি উদ্যাক্তাদের এমন পণ্য তৈরিতে উত্সাহ দিতে হবে। আমরা সাধারণত বড় বড় রপ্তানিকারকদের (প্রধানত গার্মেন্টস রপ্তানিকারকদের) ইডিএফসহ নানা প্রণোদনা দিয়ে থাকি। এসব প্রণোদনা ক্ষুদে উদ্যোক্তাদেরও দিলে রফতানি আয়ে ব্যাপক উন্নতি হবে। বর্তমানে ১০ লাখ ডলারের নিচে রফতানি করে প্রায় চার হাজার রপ্তানিকারক।
এদের যদি উপযুক্ত বাজার সংযুক্তি, ইডিএফ ধরনের সস্তা ঋণ ও নগদ প্রণোদনা দিতে পারি তাহলে রফতানি আয়ই শুধু বাড়বে তাই নয়, দারিদ্র্য বিমোচনও ত্বরান্বিত হবে। আর তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়া যদি সবুজ করা যায় তাহলে তারা আমাদের টেকসই উন্নয়নে বড় অবদান রাখবে। আমার বিশ্বাস জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের বাণিজ্যকে সমাজ ও প্রকৃতিনির্ভর করে গড়ে তোলার এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রয়াসই একদিন বড় আকার ধারণ করবে। তখন বিশ্বকে আমরা বলতে পারবো যে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হয়েও বাংলাদেশ কিভাবে ঐ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সবুজ বাণিজ্যকে প্রসারিত করে চলেছে।
সম্প্রতি আর্জেন্টিনায় বাণিজ্য সহায়তায় বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার উদ্যোগে নয়া চুক্তি হয়েছে। এর পূর্ণ সুযোগ আমাদের নিতে হলে ‘তরঙ্গে’র মতো ছোটখাটো সামাজিক ও ব্যক্তি উদ্যোগকে নীতি ও আর্থিক সমর্থন নিশ্চিত করতে হবে। টেকসই উন্নয়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ আমাদের এসব সৃজনশীল উদ্যোগই বাংলাদেশকে মাথা উঁচু করে এগোতে সাহায্য করবে। ‘ইনোভেশন’ তথা ‘উদ্ভাবন ও উন্নয়ন’ (আরএন্ডডি) খাতে মনোযোগ দিয়ে এ ধরনের উদ্যোক্তাদের জন্যে বিশেষ ‘সিএসআর’ বা সহায়ক তহবিল গঠন করে একটু সমর্থন দিলেই তারা এগিয়ে যাবে সামনের দিকে। আমরা যদি মাত্র চার শতাংশ সুদে মশলা উৎপাদনকারীকে ঋণ দিতে পারি তাহলে এসব অগ্রসর ক্ষুদে উদ্যোক্তাদের স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ কেন দিতে পারবো না?
অর্থমন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে বাংলাদেশ ব্যাংক নিশ্চয় এমন ঋণের সুদে ভর্তুকি চালু করতে পারবে বলে আমি বিশ্বাস রাখি। প্রয়োজন উপযুক্ত নীতি উদ্যোগের। যেমন ‘তরঙ্গে’র প্রধান নির্বাহী কোহিনূর আমাকে বলছিলেন যে তিনি যদি কিছু সহায়ক তহবিল পেতেন তাহলে চরের মেয়েদের জন্যে পাট থেকে সূতো তৈরির কারখানা স্থাপন করতেন। সোলার প্যানেলসমৃদ্ধ এই কারখানার মাধ্যমে শত শত নারীর বঞ্চনা তিনি ঘোচাতে পারতেন। তাঁর সবুজ বাণিজ্যেরও প্রসার ঘটতো। বাংলাদেশ ব্যাংক তৈরি পোশাক কারখানার সবুজ রূপান্তরের জন্য দু শ মিলিয়ন ডলারের স্বল্প সুদের তহবিল গঠন করেছে। এর একটা অংশ ক্ষুদে ও মাঝারি সবুজ উদ্যোক্তাকে দেয়া যায় কিনা সে বিষয়ে ভাবা যেতে পারে।
নিশ্চয় এরকম আরো হাজারো উদ্যোক্তা রয়েছেন আমাদের সমাজে। তাদের দিকে একটু হাত বাড়িয়ে দিলেই তারাও ২০২১ সালের মধ্যে ৬০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের জাতীয় রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারতেন। ইপিবি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদফতর, বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআর একযোগে কাজ করে সম্ভাবনাময় এসব পরিবেশসম্মত রপ্তানিকারকদের পথ চলাকে নিশ্চয় সহজতর করতে পারে। আর তা করা গেলে তারাই আগামীর বাংলাদেশের বড় চালক হিসেবে নিজেদের তুলে ধরতে সক্ষম হবেন। সবুজ বাণিজ্যের উৎস হিসেবে বাংলাদেশের নয়া ব্র্যান্ডিং-এর অপেক্ষায় রইলাম। লেখক: বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক।
সূত্র: আওয়ামী লীগের ওয়েবসাইট
আর/টিকে