সমুদ্র অর্থনীতি ও বাংলাদেশ
প্রকাশিত : ১৯:৫৬, ৮ জুলাই ২০২৩ | আপডেট: ১৯:৫৯, ৮ জুলাই ২০২৩
সমুদ্র অর্থনীতির কথা যখন বলা হয়, নতুন কিছু বলা হয় না। মূল্যবান ধাতু, সামুদ্রিক প্রাণী ও মৎস্য সম্পদ আহরণের দিক থেকে সমুদ্র অর্থনীতি প্রাচীনতম এক ভাণ্ডার। সামুদ্রিক বাণিজ্য সভ্যতার অগ্রগতির পথ রচনা করেছে। এই সমুদ্র অর্থনীতি বদলে দিতে পারে বাংলাদেশকে। সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে জিডিপিতে ৩ শতাংশ অবদান রাখতে পারে ব্লু-ইকোনমি। প্রবৃদ্ধি ছাড়াতে পারে ১০ শতাংশ। জ্বালানিসম্পদ, মাছ ও লবণে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পাশাপাশি পর্যটন ঘিরে হতে পারে বহু কর্মসংস্থান।
তবে সমুদ্র অর্থনীতির ব্যাপারে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত কোনো সমন্বিত নীতি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারেনি। উপকূলীয় এলাকায় সমুদ্রকেন্দ্রিক পর্যটন চলমান রয়েছে। তবে সম্ভাবনা কাজে লাগানো হচ্ছে কম। ফলে এ খাতে দেশের আয়ের পরিমাণও কম। তাই পর্যটন স্পটগুলোর উন্নয়ন দরকার। পর্যটন এলাকায় আমাদের ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক সুকৃতির প্রতিফলন থাকা উচিত। যেহেতু বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সমুদ্রের পানি ব্যবহার করেও লবণ উৎপাদন বাড়ানো যায়। পাশাপাশি পর্যটন এলাকায় আমাদের ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক সুকৃতির প্রতিফলন থাকা উচিত।
আমাদের বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় রয়েছে বিপুল পরিমাণে ভারী খনিজ, ২২০ প্রজাতির সাগর-উদ্ভিদ, ৩৪৭ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৪৯৮ প্রজাতির ঝিনুক, ৫২ প্রজাতির চিংড়ি, ৫ প্রজাতির লবস্টার, ৬ প্রজাতির কাঁকড়া এবং ৬১ প্রজাতির সি-গ্রাস। এসব জৈব-অজৈব সম্পদ সাগর- অর্থনীতিতে তরঙ্গ তৈরি করতে পারবে।
সমুদ্রতলের গ্যাস, মৎস্যসহ অন্যান্য সম্পদ আহরণ, বন্দরের সুবিধা সম্প্রসারণ ও পর্যটনের ক্ষেত্রে যথোচিত কার্যক্রম সম্পন্ন হলে ২০৩০ সাল নাগাদ সমুদ্র থেকে প্রতি বছর আড়াই লাখ কোটি ডলার আয় করা সম্ভব। কিন্তু এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে রয়েছে বহু প্রতিবন্ধকতা। এখানে অভাব আছে পর্যাপ্ত নীতিমালা ও সঠিক কর্মপরিকল্পনার।
২০১২ সালের ১৪ মার্চ আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের রায়ে মিয়ানমারের সঙ্গে মামলায় বাংলাদেশ ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি সমুদ্র এলাকার অধিকার পায়। ২০১৪ সালের ৮ জুলাই ভারতের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ সমুদ্রসীমার প্রায় ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটারের অধিকার পায় বাংলাদেশ।
এর পরই সমুদ্রসম্পদ আহরণ ও গবেষণায় সরকার নানা উদ্যোগ নেয়। সমুদ্রসীমা অর্জনের পরের বছরই ২০১৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। সমুদ্রসম্পদ আহরণ এবং এর যথাযথ ব্যবস্থাপনায় ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবকে আহ্বায়ক করে কমিটি গঠন করা হয়। ২০১৫ সালে সমুদ্রসম্পদ গবেষণায় প্রতিষ্ঠা করা হয় বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট। ২০১৭ সালে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠন করা হয় ‘ব্লু ইকোনমি সেল’।
২০১৮ সালে নৌবাহিনী সদর দপ্তরের সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব মেরিটাইম রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিমরাড) নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। বদ্বীপ পরিকল্পনা বা ডেল্টা প্ল্যানে সমুদ্র অর্থনীতিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এ পরিকল্পনায় নীল অর্থনীতির সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পাঁচ ধরনের কৌশল ঠিক করা হয়েছে, যার অন্যতম হলো সমুদ্রসম্পদের বহুমাত্রিক জরিপ দ্রুত সম্পন্ন করা। গত ১০ বছরে সমুদ্রসম্পদ নিয়ে কিছু গবেষণা হয়েছে। এর বাইরে সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ছাড়া সম্পদ আহরণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় তেল ও গ্যাস রয়েছে। এখানে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হলে তা দেশের জন্য ব্লু ইকোনমির একটি বড় শক্তি হয়ে উঠবে। তেল-গ্যাস ছাড়াও বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ অংশে সালফার, মেটালিক মডিউল, কোবাল্ট পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দেশের সমুদ্রসীমায় অনুসন্ধান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ গ্যাস হাইড্রেট বা মিথেন গ্যাসের জমাট স্তরের উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার একান্ত অর্থনৈতিক এলাকায় ০.১১ থেকে ০.৬৩ ট্রিলিয়ন কিউসিক ফুট সম্ভাব্য প্রাকৃতিক গ্যাস হাইড্রেট থাকার বিষয়টি অনুমিত হয়েছে, যা ১৭ থেকে ১০৪ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট প্রাকৃতিক গ্যাসের সমপরিমাণ। দেশের স্থলভাগে মজুত প্রাকৃতিক গ্যাস শেষ হওয়ার পথে। সাগরে গ্যাস পেলে দেশের অগ্রগতির চাকা আরও বেগবান হবে। ব্লু ইকোনমির কল্যাণে বাংলাদেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে, এমনটি আশা করা হচ্ছে ব্যাপকভাবে। বাংলাদেশকে এ খাতে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে এক্ষেত্রে সফল দেশগুলোকে অনুসরণ করতে হবে।
আরও পড়ুন