সম্প্রীতির মই বেয়ে ওঠো মানবিক-ধর্মের শিরদাঁড়ায়
প্রকাশিত : ১৫:১৬, ৭ জুলাই ২০২৩
শেষ রাতে বিবেক গায় গান; সে গানের মুর্ছনা ছড়ায় বহুদূর। চাদরের খোঁটে চোখের জল মোছেন আতর চাচা। নাকের জলে ঝাপটা মারেন গোপনে। ভক্ত রামপ্রসাদ পালা ছিল অপেরার শেষ রজনী। আতর আলীর সঙ্গী পূর্ণ চন্দ্র। আগের ভোর রাতে তিনিও চোখ মুছেছেন গামছায়। চটের ছালায় পাশাপাশি বসে ভোগ করেছেন বিষাদ সিন্ধু। এ পালার দুঃখ যেনো দুজনেরই বুকে বিদ্ধ। গীতিকবি যেনো তাঁদের জীবনের কথাই তুলে ধরেছেন নিমাই সন্যাসে। সকরুণ জীবনের দুর্ণিবার মিল। সুখের পাশাপাশি দুঃখেও তাদের সম্প্রীতি। সঙ-সংসার কিংবা বেদনাতেও তাঁরা ছিলেন অভিন্ন। তাইতো রামপ্রসাদের কারুণ্য কাঁদায় আতর আলীকে। কিংবা হাসান হুসেনের নির্মমতার বুক ভেঙেছে পূর্ণ চন্দ্র বালার। উপনীত ভোরে স্কুল মাঠের টিউবয়েলে অজু সেরে নামাজ পড়তেন আতর চাচারা। গোপনে প্রার্থণার হাত তুলে সবার জন্য মঙ্গল কামনা করতেন পূর্ণ চন্দ্র! কিন্তু উৎসব আর সম্প্রীতির সে-সব বর্ণিল দিনগুলি কি আর আছে? উধাও-উধাও। উদারতার অভাবে ধর্মীয় হিংসেহিংসি এখন আরেক ধর্মের প্রকট নাম!!
আতর আলীদের সাথে পূর্ণচন্দ্রের মনের ভাব বিনিময়ের মহান এ সংস্কৃতি মাত্র ক’দিন আগেও ছিল। এখন একেবারেই উধাও। এর কারণ অসংখ্য-অগুণতি। এতো বড় ফারাক্কার নৈকট্য আনতে পারে শুধুই সম্প্রীতি আর শ্রদ্ধাপরিপূর্ণ ভালোবাসা। এ দূরত্ব ঘোচাতেই কাজ করে যাচ্ছে সময়ানুকূল সংগঠন সম্প্রীতি বাংলাদেশ। আজ তার বয়স হলো বছর পাঁচ;
পড়শিবাড়ির ওপর দিয়ে এখন কালো মেঘের আউলা। কেউ বলে না কথা—কারও সঙ্গে। ভালোবাসার কপাটগুলোয় সিলগালা পড়েছে। একে অপরের কাঁধে পা রেখে যে যার মতো তথাকথিত বড় হওয়ার লড়াইটাই চলমান। এমন ক্রান্তিকালে ভরসার ভেলা তাই সম্প্রীতি বাংলাদেশ। যার আহ্বায়ক নাট্যজন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় আর সদস্য সচিব দেশবরেণ্য চিকিৎসক মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল। পণ্চবার্ষিকীর মাহেন্দ্রক্ষণে তাঁরা জাহির করেছেন আগামীর পরিকল্পনা। সহিংসতার বিরুদ্ধে সম্প্রীতির আহ্বান এবার মানবিক মানুষ গঠন।
ক’দিন আগেও সব গোত্রের মানুষের সঙ্গে সবার ছিল সদ্ভাব। এখন নেই। সদাচারী প্রতিবেশি কিংবা পাড়ার সংসপ্তক মানুষটিও ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকেন। বৃষ্টিতে ভেজা খাম্বার মতো জুবুথুবু যুবসমাজ। চোখ সবার দেয়াল আর কার্ণিশে। যেখানে অযথাই সাঁটানো পোস্টারে পাড়াপাড়ি। টিউটর দিচ্ছি নিচ্ছি। বিসিএসে চান্স কিংবা ব্যাংক জব মাস্ট। প্রশ্নফাঁসের কোচিং, ফাস্টফুডের নয়া আউটলেট। কালেভদ্রে বাসায় গিয়ে শেখানো হয় রবীন্দ্র-নজরুল। কাজী অফিসের পূর্ণাঙ্গ ঠিকানায় লটকে থাকা পোলগুলো ঝুলে পড়েছে পোড়োবাড়ির পলেস্তরায়। আছে জমি মাপা আমিনের বিজ্ঞাপন। চাবিওয়ালার ফোন নম্বর, স্লিম ফিটের ডাক্তার, এতিমখানায় চামড়া দান কিংবা নামাজি মেস মেটের আবশ্যকতা। হতে পারে সাবলেটে ছোট পরিবার (হিন্দু)। তাহলে সম্প্রীতি কোথায়? মানুষের সঙ্গে মানুষের বিশ্বাসযোগ্য মহব্বত কোথায়? গেল ক’বছর ধরেই সম্প্রীতি বাংলাদেশ মানুষকে পৌঁছে দিতে চাইছে মানুষের কাছে। জাতীয় আহ্বায়ক কমিটির কার্যনির্বাহী সদস্য বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিক আলী হাবিবের অভিমত, সম্প্রীতি বাংলাদেশ বাঙালির যূথবদ্ধ জীবনকে তুলে ধরে। শিল্প-সংস্কৃতি যখন পথ হারানোর শঙ্কায় তখনই এ ঐক্যের আহ্বান। করোনা মহামারিতে আমরা তার প্রমাণ দিয়েছি জনগনের পাশে থেকে। আউলা মেঘের অন্ধকার দূর হলেই মস্ত এক আকাশ উপহার দিতে চাই দেশকে। জন্মের পর সম্প্রীতির যখন কথা বলার সময় তখন করোনা হামলে পড়ল। তবু বাঁধ ভাঙা প্রত্যয় ছিল সম্প্রীতির পাণ্ডবদের মধ্যে। কোভিড উতরাতে অনলাইন প্রচারও ছিল তুঙ্গে। এ প্রক্রিয়া এখনও বিদ্যমান। তবে অন্ধকার কেটেছে, এবার দলবল নিয়ে মাঠে নামবেন আলোর পথের যাত্রী নাট্যজন পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুচিকিৎসক মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল। মহান মুক্তিযুদ্ধ, জাতির জনকের ত্যাগ আর আদর্শ নিয়ে সম্প্রীতি দাঁড়াবে মানবিক ধর্মের শিরদাঁড়ায়।
( লেখক ড. অখিল পোদ্দার, প্রধান বার্তা সম্পাদক- একুশে টেলিভিশন)
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।