ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা : সময়ের দাবি

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৭:৫৪, ২২ ডিসেম্বর ২০১৮ | আপডেট: ১৪:৫১, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৮

Ekushey Television Ltd.

বিংশ শতাব্দীর চরম উৎকর্ষের যুগে আজও পৃথিবীর ১ বিলিয়ন লোক কোনো দিন চিকিৎসকের দেখা পাননি বা চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত। বিশ্বের লাখ লাখ লোকের ন্যূনতম চিকিৎসা গ্রহণের আর্থিক সামর্থ্য নেই, এমনকি সুচিকিৎসা পেতে অনেককে সম্পদ বিক্রি কিংবা লোন গ্রহণ করতে হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুয়ায়ী, চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে দেশে প্রতি বছর ৩.৪ শতাংশ মানুষ দরিদ্র হচ্ছে, ১৫ শতাংশ পরিবার অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে।

অথচ ধনী-গরিবনির্বিশেষে সবার মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতভাবে পাওয়ার অধিকার রয়েছে এবং সেই সেবাপ্রাপ্তির জন্য যেন কারও আর্থিক দৈন্যের মধ্য পড়তে না হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্বব্যাংকের এক যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের মাথাপিছু আয় দৈনিক ১.৯০ ও ৩.১০ ডলার, স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে তাদের যথাক্রমে ৪.৫১% ও ৪.০৮% চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। অনেকেই আর্থিক বিপর্যয়ে পড়ছে অতিরিক্ত স্বাস্থ্যব্যয়ে। ২০১৫ সালে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টের’ তথ্যমতে, স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে জনপ্রতি ১০০ টাকার ৬৭ টাকাই মানুষের পকেট থেকে ব্যয় হচ্ছে, ২০১২ সালে যা ছিল ৬৩ টাকা। সরকার জনপ্রতি ২৩ টাকা, দাতা সংস্থাগুলো ৭ টাকা ও অন্যান্য সংস্থা ৩ টাকা ব্যয় করছে।

আমাদের দেশে জনসংখ্যা বেশি, তাই রোগীও বেশি। গ্রামেগঞ্জে, উপজেলা, জেলা ও বিভাগসমূহেও প্রয়োজনের তুলনায় ডাক্তার, চিকিৎসার সরঞ্জাম, ওষুধপত্র, জনবল এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ সুযোগ-সুবিধা সীমিত। প্রতি ২০৩৯ জনের জন্য মাত্র একজন রেজিস্টার্ড ডাক্তার। ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে স্বাস্থ্যসেবা মৌলিক অধিকার নয়, বরং একটি সুযোগ, যা কেউ পাচ্ছে, কেউ পাচ্ছে না। এ অসমতা এতটাই তীব্র যে, তা দেশের অগ্রগতির অন্তরায়।

রোগীর অভিযোগ ও বাস্তবতা : যদি জানতে চাওয়া হয়, কেমন চলছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা, ডাক্তার-রোগীর সম্পর্কই বা কেমন? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উত্তর হবে নেতিবাচক। উচ্চবিত্ত, নিম্নবিত্ত, উচ্চশিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত সবার মধ্যেই ডাক্তার সম্পর্কে বিরূপ বা নেতিবাচক ধারণাই বিরাজ করে বেশি। রোগী ও জনগণের বিরাট অংশই ডাক্তারের প্রতি ক্ষুব্ধ, বীতশ্রদ্ধ। অনেকেরই অভিযোগ, ডাক্তাররা রোগীকে ভালোভাবে সময় দিয়ে দেখেন না, ভালো করে কথা বলেন না, মনোযোগ দিয়ে শোনেন না, যত্ন সহকারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন না, কথা না শুনেই ওষুধ লিখে দেন। রোগ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে বুঝিয়ে বলেন না, দুর্ব্যবহার করেন, একগাদা দামি দামি ওষুধ লেখেন, অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে বলেন। হাসপাতালের বহির্বিভাগের রোগীদের অবস্থা আরও করুণ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও চিকিৎসা পেতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের অভিযোগ, অনেকদিন ধরে ভর্তি আছি, কিন্তু ডাক্তার-নার্স ঠিকমতো আসে না, ভালো করে দেখে না, ওষুধপত্র ঠিকমতো দেয় না, বিছানাপত্র ঠিক নেই, পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেই, খাবারের মান ভালো না, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব। এমনকি যে অধ্যাপকের তত্ত্বাবধানে ভর্তি তারও দেখা মেলে না, জুনিয়র চিকিৎসকরাই চিকিৎসা করেন। ডাক্তারদের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ, তাদের উচ্চ ফি, বিভিন্ন ল্যাবরেটরি বা ক্লিনিক থেকে কমিশন খাওয়া, বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধির কাছ থেকে উপঢৌকনের বিনিময়ে ওষুধ লেখা ইত্যাদি। অভিযোগগুলো অসত্য নয়, কিন্তু ঢালাওভাবে সব ডাক্তারের ক্ষেত্রে সত্যও নয়।

বাস্তবায়নের উপায়: আমাদের দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় অস্বস্তিকর ও বিশৃঙ্খল অবস্থা চলছে, জনগণের মধ্যেও ভয়-ভীতি-ক্ষোভ আর চিকিৎসক ও চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা বেড়েই চলেছে। এর কারণ উদ্ঘাটন ও সমাধানকল্পে পর্যালোচনা প্রয়োজন। তবে একক প্রচেষ্টা বা কোনো গোষ্ঠীর পক্ষে এর সমাধান অনেকটাই অসম্ভব। স্বাস্থ্যব্যবস্থার এ ভগ্নদশা থেকে উত্তরণের জন্য রোগী, ডাক্তার, প্রশাসন, চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও সর্বোপরি মিডিয়ার সমন্বিত ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সবার সমন্বয়ে বাস্তব ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং নিজ নিজ দায়িত্ব সততার সঙ্গে পালন করলে

‘সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা : সবার জন্য, সর্বত্র’ বাস্তবায়ন অসম্ভব নয়।

ডাক্তারের করণীয় : রোগীর আস্থা অর্জনই ডাক্তারের জন্য সবচেয়ে জরুরি। দক্ষতা ও পেশাগত আচরণে রোগীর চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হলে অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটতেই থাকবে। রোগীর সংশয় ও অভিযোগগুলো দূর করার দায়িত্ব ডাক্তারেরই। মনে রাখতে হবে, ভালো ডাক্তার হওয়ার পাশাপাশি ভালো মানুষ হওয়া জরুরি। রোগীর কথা ধৈর্যসহকারে শোনা, তাকে ভালোভাবে দেখা, অসুখের ধরন ও চিকিৎসা সম্পর্কে জানানো, অনিরাময়যোগ্য বা জটিল রোগ সম্পর্কে রোগী বা তার স্বজনকে ভালোভাবে বুঝিয়ে বলতে হবে। রোগীর আর্থিক সঙ্গতি বিবেচনাপূর্বক তার সামর্থ্যরে বাইরে অতিরিক্ত বা দামি দামি পরীক্ষা-নিরীক্ষা না দেওয়া, গাদা গাদা ওষুধ কিংবা অযথা বেশি দামি ওষুধ না লেখা উচিত। ডাক্তারের উপলব্ধি করতে হবে, কথায় কথায় তুচ্ছ ঘটনার জেরে এমনকি শত উসকানির মুখেও ধর্মঘট করা অনুচিত। নিরীহ মানুষকে জিম্মি করে দাবি আদায়ের নামে ধর্মঘটের মতো ধ্বংসাত্মক কাজ করলে ডাক্তারকে মানুষ শ্রদ্ধা করবে কেন? দু-এক জন রোগী বা তার স্বজনের অপকর্মের জন্য অন্যান্য রোগীকে অসহায় অবস্থায় ফেলে ধর্মঘট অযৌক্তিক। মনে রাখতে হবে, চিকিৎসাসেবা অন্যান্য পেশার মতো নয়, এর সঙ্গে জীবন-মৃত্যু জড়িত।

রোগীর করণীয় : রোগী বা তার স্বজনের মনে রাখা দরকার, অনেক জটিল রোগ যেমন স্ট্রোক, হৃদরোগ, কিডনি বা লিভার নষ্ট হলে, ব্লাড ক্যান্সার বা অনেক ক্যান্সার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিরাময়যোগ্য নয়। আইসিইউতে মুমূর্ষু রোগীকে ভর্তি করা হয় এবং সেখানে মৃত্যুর হার বেশি। শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে চিকিৎসা অসম্ভব। মৃত্যু অমোঘ, চিরন্তন, চিকিৎসক শুধু রোগ নিরাময় আর রোগীকে রোগের উপশম দেওয়ার চেষ্টা করেন। রোগীর মৃত্যু হলেই তার স্বজন উত্তেজিত হয়ে ডাক্তার-নার্সের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ, শারীরিক নির্যাতন বা হাসপাতালে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও প্রচুর ক্ষতিসাধন করেন। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার আগেই এসব অন্যায়, দায়িত্বহীন এবং আবেগতাড়িত কর্মকাণ্ড পরে যে কোনো রোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে ডাক্তারকে দায়িত্ব নিতে নিরুৎসাহিত করে। কোনো অভিযোগ যথাযথ কর্তৃপক্ষ যেমন বিএমডিসি, স্বাস্থ্য অধিদফতর বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পেশ করে প্রয়োজনে আইনি সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। একতরফা শুধু ডাক্তারকে দোষ দেওয়াটাও অযৌক্তিক। হাসপাতালে ওষুধ নেই, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নেই, বিছানাপত্র ভালো নেই, খাওয়া-দাওয়ার মান নিম্নমুখী এর দায় সম্পূর্ণ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। অথচ এসবের জন্যও দোষ দেওয়া হয় ডাক্তারকেই। ফলে ভুল বোঝাবুঝি আরও বাড়ে।

 

সরকারের কর্তব্য : স্বাস্থ্যব্যবস্থার সুষ্ঠু বাস্তবায়নের দায়িত্ব বর্তায় সরকার তথা প্রশাসনের ওপর। সেজন্য বাস্তব পরিকল্পনা, বাস্তবায়নের যথাযথ ব্যবস্থা ও সমন্বয়ের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ১. মানসম্মত মেডিকেল কলেজ ও দক্ষ ডাক্তার : অদক্ষ চিকিৎসক দিয়ে ভালো সেবা আশা করা বাতুলতা। মানসম্মত মেডিকেল কলেজ দক্ষ ডাক্তার তৈরির পূর্বশর্ত। যত্রতত্র মেডিকেল কলেজের ছড়াছড়ি, মানসম্মত মেডিকেল কলেজের অভাব, শিক্ষক সংকট, দক্ষ-প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অপ্রতুলতা, ন্যূনতমসংখ্যক শিক্ষকের পদ না থাকা বা শূন্য থাকা ও সহযোগী লোকবলের অভাব, কিছু কিছু প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে মেধার চেয়ে ব্যবসায়ী মনোবৃত্তিকেই প্রাধান্য দেওয়া, মেডিকেল কলেজ স্থাপনের শর্ত পূরণ না করেই শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা, হাসপাতালে পর্যাপ্ত রোগীর অভাবে হাতে-কলমে বাস্তব ব্যবহারিক দক্ষতা অর্জন ব্যাহত, সবকিছুই যোগ্য চিকিৎসক তৈরির অন্তরায়। দলীয় অথবা রাজনৈতিক প্রভাবও অনেকাংশেই এর জন্য দায়ী। তাই প্রশাসনকে মেডিকেল কলেজের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় না নেমে বরং ভালো চিকিৎসক তৈরির অন্তরায়গুলো দূর করার যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।

 ২. চিকিৎসা ব্যয় কমানো : অসংক্রামক রোগ বৃদ্ধি, বেসরকারি খাতে চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধি, ওষুধের আকাশচুম্বী দাম, রোগ নির্ণয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার উচ্চ খরচ, বেড চার্জ, অ্যাডমিশন ফি, মাত্রাতিরিক্ত অপারেশন চার্জ, সিসিউ, আইসিইউ ও ডায়ালাইসিস ফি, দালালদের দৌরাত্ম্য, চিকিৎসাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন স্তরের পেশাজীবীর অনৈতিক কার্যক্রমসহ বিভিন্ন কারণে চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে। তাই অপারেশন ও আইসিইউ চার্জ একটি সহনীয় মাত্রায় রাখা, অতিপ্রয়োজনীয় ওষুধের দাম সাধারণ মানুষের নাগালে আনা, রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ কমানো উচিত। চিকিৎসা ব্যয়কে সহনীয় পর্যায়ে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে এবং এর জন্য ডাক্তার, প্রাইভেট হাসপাতাল এবং ক্লিনিকের মালিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিসহ চিকিৎসাসংশ্লিষ্ট প্রত্যেক পেশাজীবীর সদিচ্ছা জরুরি। বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অহেতুক ব্যয় বাড়িয়ে যারা সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়াচ্ছে, তাদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে চিকিৎসা-ব্যবস্থাকে আরও রোগীবান্ধব করা যায়। বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসাসেবার খরচ সাধারণের নাগালের মধ্যে নির্ধারণ, বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোয় ৩০% ফ্রি বেডের যে নিয়ম আছে, তা কঠোরভাবে মনিটরিংয়ের মাধ্যমে চিকিৎসা ব্যয়ে ব্যাপক পরিবর্তন করা সম্ভব। আয় অনুসারে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের জন্য স্বাস্থ্যবীমা নিশ্চিত করতে হবে। গরিব রোগীদের সর্বাবস্থায় ফ্রি চিকিৎসার ব্যবস্থা করা উচিত। ৩. চিকিৎসক এবং চিকিৎসাসংশ্লিষ্টদের কর্মস্থলের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা : গ্রামে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য ডাক্তারদের থাকা আবশ্যক। তাই গ্রামে ডাক্তারদের আবাসন, যাতায়াত ও অনান্য সুযোগ-সুবিধা, নিরাপত্তা এবং নির্দিষ্ট সময় গ্রামে থাকার পর নিজের উচ্চশিক্ষার পরিবেশে ফিরে আসার নিশ্চয়তা থাকলে ডাক্তার অবশ্যই গ্রামে যেতে আগ্রহী হবেন। তা ছাড়া যাদের পোস্টিং গ্রামে হবে তাদের অতিরিক্ত প্রণোদনা প্রদান করে আগ্রহী করা যেতে পারে। চিকিৎসক ও চিকিৎসাসেবা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্মীর নিরাপত্তা ও নিরাপদ কর্মস্থলের ব্যবস্থা এবং যথাযথ আইন প্রণয়ন ও তার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

 

গণমাধ্যমের ভূমিকা : চিকিৎসাব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়নকল্পে প্রিন্ট মিডিয়া, অনলাইন ও অন্যান্য গণমাধ্যমকর্মীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসাসেবার অন্যতম উপাদান জনসচেতনতা তৈরি, যা গণমাধ্যমের সহযোগিতা ছাড়া বাস্তবায়ন অসম্ভব। বর্তমান প্রেক্ষাপটে চিকিৎসক-সাংবাদিক সম্পর্কের বিষয়টিও আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে। গণমাধ্যমের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, চিকিৎসা ক্ষেত্রের সাফল্যগুলো উপেক্ষা করে শুধু গুটিকয় অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ফলাও করে প্রচার করার চর্চা থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। আমাদের দেশেই অনেক জটিল রোগের চিকিৎসাসহ শত শত অপারেশন সফলভাবে করা হচ্ছে। কিডনি, লিভার ও বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট, হৃদরোগের বাইপাস, রিং পরানো, নিউরো সার্জারি ইত্যাদি আধুনিক চিকিৎসা উন্নত দেশের মতোই হচ্ছে। এসব বিষয়েও জনগণকে অবহিত করা দরকার। আমাদের দেশেও আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসক আছেন, চিকিৎসায় সফলতাও আছে। কিন্তু সর্বদা যদি দোষত্রুটিগুলো প্রচার করা হয়, ভালো কাজের স্বীকৃতি না দেওয়া হয়, তবে অনেকেই উৎসাহ হারিয়ে ভয়-ভীতির মধ্যে কাজ চালাতে বাধ্য হবেন। কর্মক্ষেত্রে ডাক্তাররা যে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন সেগুলো সঠিকভাবে প্রচার করা দরকার। কিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটলেই ভুল চিকিৎসা বলে প্রচার করে জনগণের আস্থা নষ্ট করা অনুচিত। এতে জনগণের মধ্যে ভীতি সঞ্চার হবে। অনেক জটিল রোগ যেমন স্ট্রোক, হৃদরোগ, কিডনি বা লিভার নষ্ট, ব্লাড ক্যান্সার বা অন্যান্য অনেক ক্যান্সার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিরাময়যোগ্য নয়। মুমূর্ষু রোগীদের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়, সেখানেও মৃত্যুর হার বেশি। মৃত্যুপথযাত্রী রোগীকে কেউই বাঁচাতে পারবে না। তাই স্বাভাবিক বা রোগজনিত মৃত্যু হলেই ভুল চিকিৎসা হলো, এভাবে প্রচার করাটা অন্যায়, অযৌক্তিক। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগীর অভিযোগের সত্যতা যাচাই না করে তৎক্ষণাৎ খবর প্রকাশ করা হয়, জনগণ সেটাই ঘটেছে বলে বিশ্বাস করে এবং চিকিৎসকের প্রতি অনাস্থা আরও বেড়ে যায়। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা মেলে না। কিন্তু তা আর পুনরায় প্রকাশ করা হয় না কিংবা স্বল্প পরিসরে প্রকাশিত হলেও তা জনগণের মনে সৃষ্ট আগের ভ্রান্ত ধারণার পরিবর্তন করতে পারে না। মনে রাখা দরকার, সমগ্র চিকিৎসাব্যবস্থায় একজন চিকিৎসক উপাদান মাত্র, কখনই মূল নিয়ামক বা নিয়ন্ত্রক নন। এর সঙ্গে যুক্ত থাকেন নার্স, টেকনোলজিস্ট, ওয়ার্ডবয়, সুইপার, কর্তৃপক্ষ। অন্যদের ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটিবিচ্যুতির জন্য ডাক্তারকে দায়ী করে সংবাদ প্রকাশ করলে ডাক্তার-রোগীর ভুল বোঝাবুঝি ও দূরত্ব বাড়ে। তাই আপনাদের প্রতি বিনীত অনুরোধ, ডাক্তার ও রোগীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়, এমন নেতিবাচক খবর প্রচারে সতর্ক থাকা উচিত। সমাজের অন্য মানুষের মতো ডাক্তারেরও ভুলত্রুটি হতে পারে, তা সারা বিশ্বেই হয়। কিন্তু নেতিবাচক খবর বেশি প্রচার করলে ডাক্তারের আন্তরিকতার খবরটুকু অপ্রকাশিত থেকে যায়। ভুল বোঝাবুঝি আরও বাড়ে, যা কারও জন্যই মঙ্গলজনক নয়। এসব সংবাদে জনগণ শুধু ডাক্তারের ওপর আস্থা হারায় না, হারায় মূলত রাষ্ট্রপ্রদত্ত স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর যার খেসারত দিতে হয় আপনার, আমার, আমাদের সবার এবং সরকারের। তাই এমন খবর প্রচারে মুখরোচক জনপ্রিয়তার চেয়ে দেশ ও দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতি সংবাদকর্মীদের দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেওয়া উচিত। চিকিৎসাসংক্রান্ত রিপোর্টিং সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও দেশের চিকিৎসা-ব্যবস্থার উন্নয়নের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। এভাবে দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল পেশার সদস্য হিসেবে আপনিও দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারেন। সুচিকিৎসা যেমন সবার মৌলিক অধিকার, তেমন তা সুনিশ্চিতকরণে সংশ্লিষ্ট প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্বশীল হওয়া একান্ত জরুরি। সেজন্য এখনই সময় সম্মিলিত পদক্ষেপের, প্রয়োজন সঠিক বাস্তবায়নের। নিম্নোক্ত কিছু প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য বিবেচনা করা যেতে পারে

 

♦  গরিব ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য ফ্রি চিকিৎসা, উচ্চবিত্তের জন্য স্বাস্থ্যবীমার ব্যবস্থা। দেশের সব নাগরিকের আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী হেলথ কার্ড ও স্বাস্থ্যবীমার আওতায় আনা উচিত।

 

♦  সরকারি ও প্রাইভেট মেডিকেল কলেজগুলোর মান নিয়ন্ত্রণ ও ভালো ডাক্তার তৈরির যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া এবং অন্তরায়গুলো দূর করতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ।

 

♦ চিকিৎসা ব্যয় কমানোর পদক্ষেপ গ্রহণ। ওষুধপত্র, পরীক্ষার খরচ, অপারেশন চার্জ, আইসিইউ, সিসিইউসহ প্রাইভেট বা করপোরেট হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসার অতিমুনাফা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা।

 ♦ বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে যৌক্তিক বরাদ্দ বাড়ানো ও বিনিয়োগ বাড়াতে উৎসাহ প্রদান।

 ♦ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা, নিরাপত্তাসহ গ্রামপর্যায়ে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ।

♦প্রতিকার থেকে প্রতিরোধ উত্তম। তাই অসংক্রামক রোগ যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক, ক্যান্সার প্রতিরোধে জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে।

 ♦রোগীবান্ধব পরিবেশ, চিকিৎসক ও সাধারণ মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক বাস্তবায়নে গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সম্পৃক্তকরণ।

 ♦ শুধু ডাক্তার নয়, চিকিৎসাসেবাসংশ্লিষ্ট সব কর্মীকে ধর্মঘটের মতো ধ্বংসাত্মক কাজ পরিহার করতে হবে।

 ♦ হাসপাতালের গণ্ডিতে যে কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকা উচিত।

 লেখক : ডিন, মেডিসিন অনুষদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি