সাধারণ রোগীদের চিকিৎসার সুযোগ ব্যাপকভাবে সংকুচিত হচ্ছে
প্রকাশিত : ২১:১৫, ১৩ মে ২০২০
বাংলাদেশে গত ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য সরকার প্রথমে একটি মাত্র হাসপাতাল নির্ধারণ করে। সেটি ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল। তারপর রোগীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকলে ঢাকায় আরও আটটি সরকারি ও তিনটি বেসরকারি হাসপাতাল এবং ঢাকার বাইরে ৫টি হাসপাতাল শুধু করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য নির্ধারণ করা হয়। দিন তিনেক আগে ঢাকায় আরও তিনটি বেসরকারি হাসপাতালকে এই তালিকায় যুক্ত করা হয়। কোভিড-১৯ মোকাবিলা নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগসহ পুরো সরকার এমনভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়ে যে সাধারণ রোগীদের নিয়মিত চিকিৎসার দিক থেকে সরকারি প্রশাসনের দৃষ্টি সরে যায়। তাদের কাছে এ বিষয়টির গুরুত্ব দৃশ্যত কমে যায়। এই পরিস্থিতিতে কোভিড-১৯ আক্রান্ত নন এমন রোগীদের চিকিৎসা সেবার কী অবস্থা? অবস্থা যদি খারাপ হয়ে থাকে তাহলে তা থেকে উত্তরণের উপায় কী? এসব বিষয়ে ভালোভাবে খোঁজ-খবর নিয়ে বিশদভাবে পর্যালোচনা করে নীতি নির্ধারণ ও তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
করোনা ভাইরাস সংক্রমণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশই বেশি সংখ্যক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান এই সংকট মোকাবিলার সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে। এ মুহূর্তে দেশের প্রায় ৩৭টি স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান প্রত্যক্ষভাবে করোনা মোকাবিলায় নিয়োজিত আছে। এগুলোতে কোভিড-১৯ রোগী ছাড়া আর কারও চিকিৎসার সুযোগ নেই। এ ছাড়া সরকারি হাসপাতালগুলোর প্রায় ৫০ হাজার শয্যার মধ্যে থেকে ৭ হাজার শয্যাকে কোভিড-১৯ সন্দেহভাজন রোগীদের জন্য আইসোলেশন শয্যা হিসেবে প্রস্তুত করা হয়েছে। এভাবে আমাদের চিকিৎসা-সামর্থ্যের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ শুধু কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য পৃথক হয়ে যাওয়ার ফলে সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার মোট সামর্থ্য উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।
তা ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ও নার্সিং অধিদপ্তরের অধীনে চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী ও সহায়ক জনবলসহ মোট যত সংখ্যক পদ (১ লাখ ৯৩ হাজার,৬৮৭ টি) থাকার কথা, তার প্রায় এক-পঞ্চমাংশের অধিক পদে জনবল ঘাটতি রয়েছে। বৈশ্বিক মানদণ্ড অনুযায়ী প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য ৪৫ জন চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী দরকার, কিন্তু বাংলাদেশে আছে মাত্র ৯ জন। এখন তাঁদের একটা অংশকে কোভিড-১৯ মোকাবিলার কাজে নিয়োজিত থাকতে হচ্ছে; তাঁদের মধ্যে আবার অনেকে এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন, অনেকে হোম কোয়ারেন্টিনে ও আইসোলেশনে আছেন। কোনো হাসপাতালের একটা ইউনিট, আবার কোনো হাসপাতাল পুরোটাই লকডাউন করতে হয়েছে। ফলে সেগুলোতে চিকিৎসা কার্যক্রম সীমিত বা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।
এ দেশের মোট হাসপাতাল শয্যার ৬৪ শতাংশ বেসরকারি হাসপাতালের। কিন্তু করোনা সংকটে বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য নয়। শুধু তাই নয়, কিছু বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও চেম্বার চিকিৎসা সীমিত করেছে, বা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে সাধারণ রোগীরা বেসরকারি খাতের চিকিৎসা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। আর যেসব ধনী লোক চিকিৎসার বিদেশে যায়, এখন তাদের সেই সুযোগ নেই।
সব মিলিয়ে নন-কোভিড বা সাধারণ রোগীদের চিকিৎসার সুযোগ ব্যাপকভাবে সংকুচিত হয়েছে; তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেক বেড়েছে। বিশেষত হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ক্যানসার, পক্ষাঘাত, হাঁপানি-শ্বাসকষ্ট, লিভার ও কিডনির রোগ, ইত্যাদি ইত্যাদি মেয়াদি রোগব্যাধিতে যাঁরা ভুগছেন, তাঁদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি অনেক বেড়েছে। গর্ভবতী নারী, প্রসূতি ও শিশুদের ক্ষেত্রেও ঝুঁকিটা বেশি।
সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানা যাচ্ছে, অনেক অসুস্থ মানুষ চিকিৎসার জন্য এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটে যাচ্ছেন, কিন্তু চিকিৎসা পাচ্ছেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্র চিকিৎসার জন্য কয়েকটি হাসপাতালে ঘুরেও যথা সময়ে চিকিৎসা না পাওয়ায় মারা গেছে। বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীরও দৃষ্টিগোচর হয়েছিল। সমকাল পত্রিকার ২২ এপ্রিলের অনলাইন সংস্করণে একটা খবর ছিল, নারায়ণগঞ্জে নয় মাসের একজন গর্ভবতী নারী বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে আটো রিকশাতেই মারা গেছেন। বাংলাদেশ সরকারের একজন অতিরিক্ত সচিব কিডনির জটিলতায় ভুগছিলেন; তিনি ৯ মে ঢাকার প্রায় সব নামি-দামি হাসপাতালে ঘুরেও যথা সময়ে চিকিৎসা না পাওয়ায় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি পর মারা গেছেন। এ রকম আরও অনেক ঘটনার খবর প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে।
সাধারণ রোগীদের চিকিৎসার জন্য স্বাভাবিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার এই নাজুক পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় কী? করণীয় হচ্ছে সব ধরনের অসুস্থ মানুষের স্বাভাবিক চিকিৎসার নিশ্চিত ব্যবস্থাটি পুনরুদ্ধার করতে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন। প্রথমত স্বাস্থ্যসেবা খাতে জনবল অনেক বাড়াতে হবে। সরকার ইতোমধ্যে প্রায় ৭ হাজার জনবল নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছে। সংখ্যাটি আরও বাড়ানো প্রয়োজন, কারণ স্বাস্থ্য খাতে আমাদের জনবলের ঘাটতি অনেক বেশি। দ্বিতীয়ত, জনবলের দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। টেলিফোন হটলাইনের পাশাপাশি টেলিমেডিসিন ব্যবস্থার প্রসার, ভিডিও কলিং সেবা সহজলভ্য করা দরকার। তৃতীয়ত, করোনা সংকটকালে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে সাধারণ রোগীদের চিকিৎসার জন্য আরও সক্রিয় করতে হবে। এই ক্ষেত্রে সরকারি নজরদারি থাকা উচিত বলে মনে হয়। সাধারণ রোগীদের যেকোনো হাসপাতালে যাওয়ার সময় সর্বোচ্চ সুরক্ষা অবলম্বন করতে হবে; চিকিৎসা নেওয়ার সময় রোগীর কোভিড-১৯-এর উপসর্গ থাকলে তা গোপন করা চলবে না।
বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার মতো রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ এ ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটলে স্বাস্থ্য খাতের সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে এটা নিয়েই নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠতে দেখা যায়। ফলে অন্যান্য রোগীর চিকিৎসা কম গুরুত্ব পায়। তাই যে কোনো মহামারি মোকাবিলার জন্য দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। বিভাগ বা জেলা পর্যায়ে মহামারি হাসপাতাল স্থাপন করা যায় কি না সে বিষয়ে গবেষণানির্ভর সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।
পরিশেষে বলতে চাই, মহামারি মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ, নীতি নির্ধারক, নাগরিক সমাজ ও জনসাধারণ— সবাই নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করলে মহামারি মোকাবিলা করার পাশাপাশি সাধারণ চিকিৎসা ব্যবস্থা সচল ও কার্যকর রাখা সম্ভব।
লেখক: অধ্যাপক নাসরিন সুলতানা পরিচালক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এমএস/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।