সাবাস বাংলা, জয় বাংলা!
প্রকাশিত : ১৭:৪৯, ৫ অক্টোবর ২০২২
‘এই দেশ হিন্দুর না, এই দেশ মুসলমানের না। এই দেশকে যে নিজের বলে ভাববে, এই দেশ তার। এই দেশের কল্যাণ দেখে যার মন খুশিতে ভরে উঠবে এই দেশ তার। এবং এই দেশ তাদের যারা এই দেশের স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও দিবে।’
বঙ্গবন্ধুর এই কথাগুলি মনে পড়ে গেল এবার দুর্গাপূজোয় ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির প্রাঙ্গনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণের কিছু অংশ শুনে। তিনি বলেছেন, ‘এ দেশে কেউ কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিতে পারবে না। কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে এমন কিছু কেউ বলতে পারবে না। এটা যে কোনও ধর্মের জন্যই প্রযোজ্য।’
পিতা ও কন্যার এই ভাষণের মধ্যে শব্দের, বাক্যের মিল নেই বটে, তবে আছে ভাবনার গভীরতায় সাদৃশ্য। দু’জনই ধর্মীয় ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে বাংলাদেশের কল্যাণ কামনার কথা বলেছেন।
এবারের পূজো নিয়ে আশঙ্কার মেঘ জমেছিল আগের বছরই। ওপারে এবার কী কী হয়, এমন দুশ্চিন্তা তাই গ্রাস করেছিল এপারের মানুষকেও।
বিগত কয়েক বছরে দুর্গাপূজোকে কেন্দ্র করে অশান্তির ঘটনায় দুশ্চিন্তার মেঘ জমেছিল পশ্চিমবঙ্গেও। পূজো মণ্ডপ ঘিরে গোলমালে সাম্প্রদায়িক অশান্তি ছড়িয়ে পড়েছিল এপারের বেশ কিছু জায়গায়, বাংলাদেশে সীমান্ত লাগোয়া বসিরহাট তার অন্যতম।
আনন্দের কথা হল, দু’পারেই ধর্মান্ধ অসুরেরা বধ হয়েছে সাধারণ, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ মানুষের কাছে। তাদের উদারবাদী চেতনার সামনে ফণা তুলতে পারেনি সাম্প্রদায়িক শক্তির কাল কেউটে। পরম তৃপ্তির সঙ্গে তাই বলি, সাবাস বাংলা, জয় বাংলা!
সাম্প্রদায়িক, বিভেদকামী, উগ্র মৌলবাদী শক্তির মাথা তোলার আদর্শ সময় উৎসব। যুগে যুগে কূট, ধর্মান্ধ শক্তি বেছে নিয়েছে মিলনের উৎসবকে বিভেদের বেড়াজালে আবদ্ধ করতে। এই উপমহাদেশ তাদের জন্য আদর্শ ভূমি বলা চলে। যেখানে দারিদ্র্য আছে, আছে অশিক্ষা, আছে অসাম্য। বিভেদ উসকে দেওয়ার যা উর্বর ভূমি।
সত্যি কথা বলতে কী, গত বছর কুমিল্লার ঘটনার প্রেক্ষিতে পূজোর আগে এপারেও নানা আলোচনায় উঠে এসেছে এই প্রসঙ্গ, এবার পূজো কেমন কাটবে সীমান্তের ওপারে? বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকার খবরে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার ছাপ লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। সপ্তমীর দুপুরে বন্ধুদের আড্ডায় অনেকবারই এল কুমিল্লার গতবারের ঘটনার কথা। একজন আশ্বস্ত করে জানালেন, কুমিল্লাবাসী তার আত্মীয়েরা জানিয়েছে, দুশ্চিন্তা আছে। তবে প্রশাসন বেশ সক্রিয়।
গতবার পূজোর মধ্যেই বাংলাদেশ থেকে একের পর এক দুঃসংবাদ আসতে থাকে। প্রথমে সে দেশে দুর্গাপূজোর কয়েকটি অস্থায়ী মণ্ডপে, পরে একাধিক মন্দির এবং হিন্দু মহল্লায় আক্রমণ হয়। মন্দির, ঘরবাড়ি ভাঙচুরের পাশাপাশি বেশ কিছু হতাহতের ঘটনা ঘটে।
আর সেই ঘটনাগুলিকে হাতিয়ার করে এপারেও চেষ্টা হয় দুর্গাপূজো ও শারদোৎসবের আনন্দকে মাটি করে দেওয়ার। সুযোগসন্ধানী একটি রাজনৈতিক দল দ্রুত পথে নেমে পড়েছিল সেবার।
তবে সেই চেষ্টা অচিরেই ব্যর্থ হয় তিনটি কারণে। এক. পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষ কুমিল্লার ঘটনার নিন্দা ও উদ্বেগ প্রকাশ করলেও প্রতিবাদের নামে এপারের মানুষের উৎসবকে ভেস্তে দিতে দেয়নি। দুই. পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ-প্রশাসন অত্যন্ত সতর্কতা ও দক্ষতার সঙ্গে কুমিল্লার ঘটনার জেরে অশান্তির চেষ্টা, সম্ভাবনাকে নির্মূল করেছে। তিন. বাংলাদেশ সরকারের নেওয়া কঠোর পদক্ষেপ।
শেখ হাসিনার সরকার সেবার জনমনের সংশয় দূর করার মতো উপযুক্ত, বিশ্বাসযোগ্য কিছু পদক্ষেপ করেছিল বলে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ উপলব্ধি করে। মৌলবাদীরা অশান্তির আগুনে ঘি ঢালার সুযোগ তেমন একটা পায়নি বাংলাদেশ প্রশাসনের তৎপরতার কারণেই। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী কড়া ভাষায় হামলাকারীদের হুঁশিয়ারি দেন, অভয় দেন আক্রান্তদের। সাফ বলেন, ‘কেউ সংখ্যালঘু নয়, সবাই বাংলাদেশের নাগরিক এবং সকলের অধিকার সমান।’ বলেন, ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।’ যেকোনও প্রশাসকের মুখে কাঙ্ক্ষিত এই কথা এবং পদক্ষেপ রাজধর্ম পালনের দৃষ্টান্ত বলে বিবেচিত হয়ে থাকে।
এবার এপারের মানুষ খুবই আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ্য করছিলেন, দুর্গাপূজোকে নিয়ে বাংলাদেশ প্রশাসনের পদক্ষেপগুলি। নিরাপত্তা বাহিনীর বাড়তি নজরদারির পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবক মোতায়েনের সিদ্ধান্তটি ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়। কোনও উৎসবই শুধুমাত্র প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পুরোপুরি সফল করে তোলা যায় না। চাই স্থানীয় মানুষ, পূজোকর্তা প্রমুখের সহযোগিতা। আর উৎসব সফল হয় পাঁচজনের যোগদানের মধ্য দিয়ে। এবারে বাংলাদেশে দুর্গাপূজো নির্বিঘ্নে উদযাপনের কৃতিত্ব তাই সে দেশের সাধারণ দেশবাসীরও প্রাপ্য।
শেখ হাসিনা তার দলকেও এবার নির্দেশ দিয়েছিলেন, দুর্গাপূজোর দিনগুলি সজাগ থাকতে। যেকোনও ধরনের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। আওয়ামী লিগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়েদুল কাদের খোলাখুলি আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন এই বলে, ‘হিন্দুদের উৎসবে বিঘ্ন ঘটিয়ে শাসক দলকে বেইজ্জত করার চেষ্টা হতে পারে।’ তেমন চেষ্টা কেউ করে থাকলেও তা শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। এটা খুবই আনন্দের।
দুর্গাপূজো এপারেও ভালোই কেটেছে। অশান্তি সৃষ্টির একটি চেষ্টা হয়েছিল খানিক ভিন্ন কৌশলে। কলকাতার পূর্ব-প্রান্তের একটি পূজোয় উদ্যোক্তাবা অসুরের মুখ বানিয়েছিল জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীর মুখের আদলে। তা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে জোরালো প্রতিবাদের মুখে পুলিশ এক মৃৎশিল্পীকে ডেকে অসুরের মুখ বদলে দেয়। পূজো উদ্যোক্তারা প্রতিবাদ করলেও অশান্তি হয়নি।
অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের হল, গোটা পৃথিবী যাকে শান্তির দূত বলে শ্রদ্ধা করে, সেই মহাত্মা গান্ধীকে তার নিজের দেশেই কিছু মানুষ অসুর মনে করেন। আর দেবজ্ঞানে পূজো করেন তার হত্যাকারী নাথুরাম গডসেকে। সেই ধর্মান্ধ মানুষগুলি গান্ধীর প্রতি ঘৃণা, বিদ্বেষ জাগিয়ে দিতে এবার দুর্গা প্রতিমার মূর্তিকে কলুষিত করতে চেয়েছিল গান্ধীর মুখের আদলে অসুরের মুখ বানিয়ে। কিন্তু শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ আর প্রশাসনের বিচক্ষণতায় সে চেষ্টা ভেস্তে যায়। প্রসঙ্গত বলে রাখি, এ বছর হল গান্ধীর ঐতিহাসিক নোয়াখালি সফরের ৭৫তম বর্ষপূর্তি।
গতবার বাংলাদেশের কুমিল্লার ঘটনা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন পুরোপুরি নীরব। মুখ্যমন্ত্রীর নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টির কম চেষ্টা হয়নি। কিন্তু কিছু পরিস্থিতি এমন যখন একটিও বাক্য ব্যয় না করা কোটি কোটি শব্দ ব্যবহারের সমান। মমতা ও তার দল সেবার এই ব্যাপারে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন সন্দেহ নেই।
এবারও গান্ধীর মুখের আদলে অসুরের মুখ নিয়ে কোমর বেঁধে বিতর্কে জড়ায়নি পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক দলগুলি। সকলেই মনে করেছেন, উৎসবের গুরুত্ব এইসব বিক্ষিপ্ত ঘটনার চাইতে অনেক বেশি। এবারও তাই এপার বাংলা উৎসবে শান্তি-সম্প্রীতি রক্ষার ক্ষেত্রে সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছে। এবারও শারদোৎসব পশ্চিমবঙ্গের জন্য তাই এক বিশেষ অর্জন।
ফলে দিনের শেষে দুর্গাপূজা এবার অন্যমাত্রা পেল সীমান্তের দুপারেই। দুই রাষ্ট্রেই বাঙালি তার মনোজগতে আসীন সম্প্রীতির মহাসড়কের খানাখন্দগুলি এই সুযোগে ভরাট করে নিয়েছে।
তাই বলে আত্মতুষ্টির কোনও অবকাশ নেই। সাম্প্রদায়িকতা এখন অপ্রতিরোধ্য গতিতে নিত্য-নতুন রূপ ধারণ করে গোটা বিশ্বকে গ্রাস করতে চাইছে। মৌলবাদী শক্তিগুলি প্রকাশ্যে লড়াই করে, তলে তলে যে যার এলাকা ভাগ করে নিয়ে চূড়ান্ত আধিপত্য স্থাপন করতে চায়। সেই সাম্প্রদায়িক শক্তি যখন সংখ্যাগুরুর স্বার্থ রক্ষার কথা বলে এগোয়, সংখ্যালঘুর জন্য তা কত ভয়ঙ্কর হতে পারে, ভারতে তার অসংখ্য নজির আছে। সীমান্তের এপারে বসে আমরা তাই ওপারের সংখ্যালঘুদের যন্ত্রণা, আতঙ্ক, নিরাপত্তাহীনতা অনুভব করতে পারি।
গতবার বাংলাদেশের ঘটনাবলীকে সেদেশের সরকার অতীতের মতো বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেনি। বলেছে গভীর ষড়যন্ত্র। যেভাবে দেশের নানা প্রান্তে মুহূর্তের মধ্যে সংখ্যালঘুদের উপর হামলার ঘটনাগুলি সংগঠিত হয়, তাতে গোড়াতেই বোঝা গিয়েছিল, ধর্ম অবমাননার (কুমিল্লার পূজো মণ্ডপে হনুমান মূর্তির পায়ের কাছে কোরান রাখা) কারণে হিন্দুদের উপর প্রতিহিংসামূলক হামলার ঘটনাগুলি ঘটেনি। বরং, সংখ্যালঘুর প্রধান উৎসবটি মাটি করে দিয়ে তাদের মনে আরও একবার ভয় ধরিয়ে দিতে ধর্ম অবমাননার ঘটনার চিত্রনাট্য সাজানো হয়েছিল। ষড়যন্ত্রের এই চিত্রনাট্যটি রূপায়ণের আসল লক্ষ্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াই ঘিরে গড়ে ওঠা অসাম্প্রদায়িক চেতনার নির্মাণটিকে ধূলিসাৎ করা।
এই ষড়যন্ত্র শুধু বাংলাদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ধরে নিলে মস্ত ভুল হবে। লক্ষ্য ভিন্ন হলেও অভিন্ন কৌশল বাস্তবায়নের চেষ্টা সীমান্তের এপারেও থেমে নেই। দুর্গাপূজোর মতোই ঈদ, বড়দিনের মতো যাবতীয় উৎসবে সম্প্রীতি রক্ষার নজির, অর্জনকে অক্ষত রাখা এখন তাই প্রশাসন এবং নাগরিক সমাজের আরও বড় কর্তব্য।
লেখক: ভারতীয় সাংবাদিক এবং বাংলাদেশ বিষয়ে স্বাধীন গবেষক।
এএইচএস
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।