পর্ব-৩
সাড়ে তিন হাত কবর নিয়েও ব্যবসা
প্রকাশিত : ১৮:২৫, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ১৩:২৮, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের বাসিন্দা ইয়াসিন আলি মৃত্যু বরণ করেন চলতি মাসের ৯ ফেব্রুয়ারি। তার শেষ সৎকারের জন্য তার মরদেহকে নেওয়া হয় আজিমপুর কবরস্থানে। তার সৎকারে খরচ হয়েছে ২ হাজার টাকা। এছাড়া নাম ফলক লাগতে গুনতে হয়েছে আরও ৩০০টাকা। আর করবটি সংরক্ষণ ও সাজসজ্জা করানোর জন্য এককালীন ১ হাজার টাকা চুক্তি হয় কবর সিন্ডিকেটের সদস্যদের সাথে। এমনকি করবটি দেখাশুনার জন্য প্রতিমাসে ৫০০ টাকা দেওয়া প্রতিশ্রুতি দিতে হয় ইয়াসিন আলির পরিবারকে। যদিও সিটি করপোরেশনের বেঁধে দেওয়া নিয়ম অনুযায়ী কোনো মরদেহের দাফন খরচ বাবদ তার পরিবারকে ৭০০ টাকা দেওয়ার বিধান রয়েছে।
শুনতে খারাপ লাগলেও এটা সত্যি যে মাসিক চাঁদা দেওয়া বন্ধ হলেই ইয়াসিন আলী কবরে বসবে নতুন করব। শুধু ইয়াসিন আলির পরিবার না রাজধানী প্রতিটি পরিবারকে তার স্বজনের মৃতদেহ সৎকারের জন্য গুনতে হয় অতিরিক্ত টাকা।
রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী এই দুই সিটি করপোরেশনের অধীনে মোট ৮টি কবরস্থানে ২ লাখ ৩৩ হাজার ৫৭৮ জনের মরদেহ সৎকারের ব্যবস্থা রয়েছে।
আর এ চিত্র শুধু আজিমপুরের করস্থানেই নয়; রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের মোট ৮ একবরস্থানের চিত্র প্রায় একই। নানা কৌশলে মৃতদেহের সৎকারের জন্য আসা পরিবারের কাছ থেকে শুধু অতিরিক্ত টাকা আদায়ই নয়; বরং পুরানো কবরের কঙ্কাল নিয়েও চলে রমরমা ব্যবসা। এই ব্যবসার সাথে সিটি করপোরেশনের নিয়োগ করা কর্মীরা ছাড়াও জড়িত বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট।
সরেজমিনে রাজধানীর জুরাইন, আজিজপুর ও মিরপুর কবরস্থান ঘুরে কবর বাণিজ্যের একই চিত্র দেখা গেছে।
গত কয়েক দিন রাজধানীর আজিমপুর ও মিরপুর কবরস্থান ঘুরে কবর বাণিজ্যের এমন চিত্র পাওয়া গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিটি কবরস্থানে সিটি করপোরেশনের ১৫ থেকে ২০ জন কর্মী নিয়োগ দেওয়া থাকলেও কবরস্থানে সিন্ডিকেটের সদস্য রয়েছে ১০০ থেকে ১৫০ জন। সিটি করপোরেশন থেকে কোনো প্রকার নিয়োগ না দিলেও তারা নিজেদেরকে সিটি করপোরেশনের সহায়ক কর্মী বলেও দাবি করে।
মিরপুর কবরস্থানের নিয়ে কথা হয় কবর সিন্ডিকেটের এক সদস্য ওয়াহ আলী সঙ্গে। তিনি একুশে টিভি অনলাইনকে জানান, তিনি মিরপুর কবরস্থানের ১৭ বছর ধরে কাজ করছেন। একটি কবর বেড়া দিতে ২ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা নিয়ে থাকেন তিনি। এছাড়া কবর বাধানোর জন্য ১ হাজার টাকা, কবরের সাজসজ্জা-ঘাসের উপরে পানি দিতে এবং কবরটি সংরক্ষণের জন্য প্রতিমাসে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা নেন। তিনি বলেন, তারা কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে জোর করে টাকা নেন না। মৃত ব্যক্তির পরিবার খুশি হয়ে যা দেয় তাই নেন তারা। তবে কবর সিন্ডিকেটের বাইরের কোনো লোকের এসব কাজ করার সুযোগ নেই। তিনি বলেন এই টাকা থেকে নির্ধারিত অংশ কবরস্থানের সিটি করপোরেশনের কর্মীদের দিতে হয়।
তবে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছে ভিন্ন কথা। তারা বলছেন, কবর খনন রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচ্চন্নতার জন্য রয়েছে নির্ধারিত জনবল রয়েছে সিটি করপোরেশনের। কবরস্থানে সিটি করপোরেশনের জনবলরাই সবকিছু তদারকি করে থাকেন। বাইরের লোকের লোক কাজ করার কথা নয়। তবে মৃত ব্যক্তির স্বজনরা চাইলে কবর দেখভাল ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারেন।
সিটি করপোরেশনের নিয়ম অনুযায়ী, বর্তমানে স্থানীভাবে কবর বরাদ্দ দেওয়া বন্ধ আছে। আর অস্থায়ীভাবে অন্তত দুই বছর কবর রাখার নিয়ম থাকলেও কোনো কবর ৬মাস পার করার পর ওই কবরের ওপর নতুন কবরের ব্যবস্থা করে। তবে মাসিক ফি আর কবরের বেড়ার জন্য নিয়মিত চাঁদা পরিশোধ করলে আজীবন সংরক্ষণ করে রাখে এসব কবর সিন্ডিকেটের সদস্যরা।
তবে ভুক্তভুগীরা বলছেন, কবর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সঠিকভাবে সিটি করপোরেশনের লোক পালন করলে সাধারণ মানুষের বাড়তি টাকা গুনতে হতো না।
এ ব্যাপারে আজিজপুর কবরস্থানে দায়িত্বে থাকা সিটি করপোরেশনের মৌলভি মিজানুর রহমান একুশে টিভি অনলাইনকে জানান, সিটি করপোরেশনে লোকবল কম থাকায় মৃত ব্যক্তির স্বজনরাই কবর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ওই সব লোকদের নিয়োগ করেন। সিটি করপোরেশন থেকে তাদের কোনো বেতন দেওয়া হয় না। মৃত ব্যক্তির স্বজনেরা খুশি হয়ে যা দেন তা দিয়েই তাদের সংসার চলে।
কবরস্থান দেখভালের দায়িত্বে থাকা উত্তর দক্ষিণ সিটি করপোরশনের সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা এনায়েত হোসেন জানান, নীতিমালার বাইরে কবরস্থানে দাফন করার সুযোগ নেই। কবরস্থানে দায়িত্বরত সিটি করপোরেশনের কোনো কর্মীর বিরুদ্ধে অতিরিক্ত টাকা আদায়সহ কোনো ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর আগেও কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
টিকে