ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

সায়গন থেকে বাগরাম

নাসিম হোসেন

প্রকাশিত : ১২:১৩, ১০ জুলাই ২০২১

মার্কিনীদের হয়ে যুদ্ধ করা দক্ষিণ ভিয়েতনামী সৈনিক দোভাষীদের পরিত্যাগ করার সেই ঐতিহাসিক দৃশ্য- এপি

মার্কিনীদের হয়ে যুদ্ধ করা দক্ষিণ ভিয়েতনামী সৈনিক দোভাষীদের পরিত্যাগ করার সেই ঐতিহাসিক দৃশ্য- এপি

"Taliban will pay for it"- ৭ অক্টোবর ২০০১ সালে এ রকম একটি প্রত্যয় ব্যক্ত করে আফগানিস্তানে হামলার সূচনা করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ জুনিয়র। বি-৫২ বিমান ২৭ হাজার ফুট উচু থেকে তোরা বোরা পাহাড়ে কার্পেট বোমা বর্ষণের মাধ্যমে আমেরিকানরা জানান দিয়েছিলো তারা আসছেন ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয়দাতা মোল্লা ওমরের সরকারকে উৎখাত করতে।

কুড়ি বছর পর, ২০২১ সালের ২৮ জুন রাতের আধারে বিশ বছর ধরে চলতে থাকা সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু বাগরাম এয়ার বেস থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যাওয়ার মাধ্যমে আমেরিকা তার অহংবোধের আপাতত সমাপ্তি ঘটিয়েছে।

নাইন এলিভেন হামলার প্রতিশোধ নিতে তড়িঘড়ি এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলো মার্কিন জনগণের তাৎক্ষণিক ক্ষোভের উঁচু তরঙ্গের ওপর ভর করে। কিন্তু ইতিহাসের পুরনো পাতা যেমন কেউ উল্টিয়ে দেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না তেমনটাই জর্জ বুশ-ভিয়েতনামের হিস্টরি বুকটা পড়ে দেখার যে অনুরোধ ওয়াশিংটনে নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত পেন্টাগণকে দিয়েছিলেন, তা কেউ কানেই তুলেননি।

মূলত ‘আফগানিস্তানে প্রবেশ করা সহজ, বের হওয়াটা কঠিন’। এই বিরান ভূমি যুগে যুগে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির গোরস্তান হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, ব্রিটিশ রাজশক্তি ১৮৩০ সালে, রাশিয়া ১৯৭৯ সালে ঢিলা ঢালা আলখেল্লা আর পাগড়িতে এসব মানুষের প্রতিরোধ শক্তিকে অবমূল্যায়ন করে চরম শিক্ষা পেয়েছিলো। 

তবে আমেরিকানদের ক্ষেত্রে এরকম অভিজ্ঞতা প্রথম নয়। কম্যুনিজম ঠেকাতে ১৯৬২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত ভিয়েতনামকে নাপাম বোমায় ঝলসে দিয়ে ৩০ এপ্রিল ১৯৭৫ এ দূতাবাসের হেলিপ্যাড ধরে পালিয়ে বেঁচেছিলো।

দশকের বেশি সময় ধরা চলা সে সংঘাতে ৬৪ হাজারের বেশি মার্কিন সেনা প্রাণ হারিয়েছিলো। আর আফগানিস্তানে বিশ বছর ধরে চলা সংঘাতের মূল্য ছিলো ২ হাজার ৪৪২ জন মার্কিন সেনার মৃত্যু, ২.২৫ ট্রিলিয়ন অর্থের নাশ এবং একটি নিরীহ দেশের লক্ষাধিক লোকের মৃত্যু। বিশ্বে আমেরিকার দর্প চূর্ণ হওয়ার মাধ্যমে আমেরিকাই আজ তালিবান থেকে "America will pay for it" এই দীক্ষাই নিলো।

রাগ-দর্প আর ইতিহাসবোধহীনতা থেকে যে স্ট্রাটেজি তৈরী হয় এবং তা যে কেবল ধ্বংসই ডেকে আনে, সাম্প্রতিক "আফগান যুদ্ধ মার্কিন পরাজয়" তা আবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখালো। আধুনিক কালে যুদ্ধে জয় করা ভূমি যদি দখলেই না রাখা গেল, তবে তাকে তো পরাজয়ই বলতে হবে।

যুদ্ধের যদি কোনও স্ট্রাটেজি না থাকে, যদি ঘোষিত লক্ষ্য বা অবজেক্টিভ যদি অর্জিত না হয়, তবে কি তাকে জয় লাভ বলে? শুরুতে মার্কিন এবং তাদের ন্যাটো দোসরদের ঘোষিত লক্ষ্য ছিলো- আল-কায়দা নেতা ওসামা বিন লাদেনসহ সকল নেতৃত্বকে নির্মূল করা, সকল প্রশিক্ষণ স্থাপনাসহ অস্ত্রের উৎস ধ্বংস করা, কাবুল থেকে তালিবানদের উচ্ছেদ করা।

সংঘাতের দশ বছরের মাথায় (২ মে, ২০১১) পাকিস্তানের মাটিতে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার মাধ্যমে ঘোষিত সে লক্ষের আংশিক পূরণ হলেও "Clear Strategy" না থাকায় আমেরিকা আফগানিস্তানে "Nation Building"-এর মতো ভ্রান্ত স্ট্রাটেজি নিয়ে কাজ শুরু করে। সুনির্দিষ্ট স্ট্রাটেজি না থাকার দরুন আফগানিস্তানের জন্য স্থিরকৃত লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হাসিল না করেই ইরাকে হামলা করে পুরো মধ্যপ্রাচ্যকেই অস্থিতিশীল করে তোলে। ইরাকের মধ্যে শিয়া-সুন্নী বিরোধকে উসকে দিয়ে শুধু দেশের মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজনই তৈরী হয়নি, ধ্বংস হয়েছে অর্থনীতি, সামাজিক সম্প্রীতি। উগ্র মৌলবাদী আইএসএস’র উত্থানের মাধ্যমে নতুন মেরুকরণ।

আমেরিকা শুরুতে "জেনারেল আব্দুর রশীদ দোস্তাম"র মতো ভাড়াটে যুদ্ধবাজ নর্দান এলায়েন্স-এর ওপর ভর করে তালিবানদের হটিয়েছে। উত্তরের মাজার-ই-শরীফের আহমেদ শাহ মাসুদের পশতুন ভিত্তিক তালিবানবিরোধী গোত্রগুলোকে কব্জা করে কাবুলে একটি জাতীয় সরকার গঠনের মাধ্যমে তালিবানের বিকল্প একটি মডারেট সরকার ব্যবস্থা চালু করতে গিয়ে বিশটি বছর কাটিয়ে দিয়েছে।

আজ তাদের হতে প্রশিক্ষণ নেওয়া আফগান সেনাবাহিনী তাদেরই ফাঁস হওয়া গোয়েন্দা তথ্য অনুসারে কাবুলে অধিষ্ঠিত সরকারকে ছয় মাসের বেশি টিকিয়ে রাখতে অক্ষম।

আফগানিস্তানের অবকাঠামো উন্নয়নে আমেরিকা সেদেশের ট্যাক্স পেয়ারদের বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে জনগণের মন জয় করার জন্য। স্কুল গড়েছে, হাসপাতাল করেছে, চওড়া মসৃণ হাইওয়ে হয়েছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে, রাস্তায় মেয়েদের চলাফেরা বেড়েছে, শিক্ষার হার বেড়েছে। এতো সব চোখে পড়ার মতো অগ্রগতি থাকা সত্ত্বেও আমেরিকানরা চলে যাচ্ছে এ ঘোষণার সাথে সাথে তাসের ঘরের মতো আফগান ন্যাশানাল আর্মির জওয়ানরা তালিবানদের হাতে অস্ত্র সমর্পণ করে জনপ্রতি ৬০ ডলার পথ খরচ নিয়ে কোলাকুলি করে বাড়ি ফিরছে।

আদতে আমেরিকানদের মনে কাউন্টার ইনসার্জেন্সী অপারেশনের কোনও ইচ্ছেই ছিলো না, কিন্তু সেই যে বললাম "Lack of clear and difinitive straregular" আমেরিকা নতুন নতুন কাজ খুঁজে নিয়েছে। তার একটি হলো- তালেবান নেতাদের হত্যা মিশন "Kill and Capture Operation".

স্থানীয়ভাবে রাজাকার তৈরীর মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ এবং তার ভিত্তিতে "নাইট অপারেশন"। আমেরিকার সকল অর্জন বৃথা গেছে এসব নাইট অপারেশনের "Counter Productive Effect-র কারণে।

কুকুর দিয়ে রাতের আধারে বাড়ি-ঘর তল্লাশী করা, নারীদের হেনস্তা করা, বেরকা উঁচিয়ে দেখা কতটা ক্ষোভের- এসব বোঝার মতো Cultural sensitivity আমেরিকার গরীব ঘরের সন্তান National Guard সৈনিকদের অনেকেরই ছিলো না। Joint Special Operation Command-এর দ্বারা তৈরী এসব নাইট অপারেশন পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিলো- এর মাধ্যমে যে স্পেস তৈরী হবে সেখানে Conventional force কাজ করবে। কিন্তু স্থানীয় জনসাধারণের মন-মানসিকতা ও স্পর্শকাতরতা সম্পর্কে উদাসীন এসব ট্রিগার হ্যাপি সৈনিকদের অপকর্ম মার্কিন হাই-কমান্ড কখনও স্বীকার করতে চায়নি।

ড্রোন অপারেশন- বিমান হমালায় হাজার হাজার নারী-শিশুর মৃত্যুর অসংখ্য ঘটনাকে পিছনে রেখে তাই রাতের আধারে বাগরাম বিমান ঘাঁটি ছেড়ে গেছে। তবে ১৯৭৫ সালে সায়গন পতনের সময় মার্কিনীরা তাদের হয়ে যুদ্ধ করা দক্ষিণ ভিয়েতনামী সৈনিক দোভাষীদের পরিত্যাগ করার সে দৃশ্যটি এপির সেই ছবিতে ইতিহাস হয়ে আছে- দূতাবাসের ছাদে একটি বেল হেলিকপ্টারে ওঠার জন্য কয়েকশ মানুষের কি প্রাণান্তকর চেষ্টা!

আজ কাবুলেও মার্কিন দূতাবাসের চত্বরে হাজার হাজার দোভাষীদের (স্থানীয়দের চোখে রাজাকার, যাদের হাতে নাইট অপারেশনে নিহতদের রক্ত লেগে আছে) ভীড় সেই সায়গনের মার্কিন দূতাবাসের সামনের ভীড়কেই মনে করিয়ে দেয়- মার্কিনীরা কথা রাখেনি, ওর কথা রাখেনা।

লেখক- সাবেক সেনা কর্মকর্তা।

এনএস/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি