সায়িকের প্রতিবাদের ভাষা ঐতিহ্যবাহী পালা
প্রকাশিত : ১৫:৫৮, ১৩ অক্টোবর ২০১৭ | আপডেট: ১৬:০৩, ১৩ অক্টোবর ২০১৭
বাংলাদেশের আবহমান নাট্যধারা ‘পালা’। সাধারণত বন্দনা, বর্ণনা, নাচ, গান ও অভিনয়ের মাধ্যমে পালা উপস্থাপিত হয়ে থাকে। আরও সহজ করে বলতে গেলে, গ্রামে পরিবেশনযোগ্য কাহিনী নির্ভর নাট্য পরিবেশনাকে ‘পালা’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এখনও গ্রামগঞ্জে প্রতিনিয়ত শত-শত পালা, জারি, যাত্রা মঞ্চস্থ হয়ে চলেছে।
যদিও আধুনিকতার দোহাই দিয়ে এসব পরিবেশনাকে ‘ফোক’ স্টাডিজে আবদ্ধ করে দূরে ঠেলে রাখা হচ্ছে। তবে আজও গ্রামীণ বাংলাদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় পরিবেশনা ‘পালা’। কাহিনীর প্রাধান্য বা নির্ভরতা বিদ্যমান থাকে বলেই এ-শ্রেণির নাট্যকে ‘পালা’ বলা হয়। সেই পালা যখন হয় প্রতিবাদের ভাষা তখন শিল্পীর সঙ্গে দর্শকের রসায়ন ঘটতে বাধ্য।
বিলুপ্ত প্রায় এই শিল্পটিকে নিজের মত করে পরিবেশন করে চলেছেন তরুণ শিল্পী সায়িক সিদ্দিকী। তিনি ঐতিহ্যবাহী ‘পালা’কে নিয়েছেন প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে। সমসাময়িক ঘটনার অবলম্বনে নিজেই ‘পালা’ রচনা করেন। সেই পালাগুলোতে নিজেই একক অভিনয় করেন।
শিল্পী সায়িক সিদ্দিকী একাধারে একজন অভিনয় শিল্পী, নির্দেশক, লেখক ও সংগঠক। যখনই সমাজে কোনো অন্যায়, অবক্ষয় ও ইস্যু এসে উপস্থিত হয় ঠিক তখনই লেখক হিসেবে কলম ধরেন সায়িক। রচনা করেন সমসাময়িক ওই ইস্যু বা ঘটনার উপর পালা। এরপর তা মঞ্চে দর্শকদের সামনে প্রদর্শন করেন একক অভিনয়ের মধ্যমে।
বিষয়েটি নিয়ে সায়িক একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে বলেন, বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শিল্পগুলোর মধ্যে পালা অন্যতম। এই শিল্পটিকে আমি নিয়েছি প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে। আমি সাধারণত সমসাময়িক বিষয়ের উপর ‘পালা’ রচনা করি। যেমন ধরুন- রোহিঙ্গা ইস্যু, ফেসবুক, ভারতীয় সিরিয়ালের মত বিষয়। এখানে আমি পালার মাধ্যমে দর্শকদের সামনে একটা ম্যাসেজ দেওয়ার চেষ্টা করি।
থিয়েটার, নৃত্য, গান শিল্পের বিভিন্ন শাখার মধ্যে সায়িক কেন পালাকে বেছে নিয়েছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি পালা ছাড়া আর কিছুই পারিনা। নিজে যা ভেবেছি, যা দেখেছি তাই পালার মাধ্যমে মঞ্চে আনার চেষ্টা করেছি। আমি এ শিল্পটি নিয়েই কাজ করতে চাই। কারণ এখানেই আমি আমাকে খুঁজে পাই।’
সায়িক ইতিমধ্যে বেশকিছু পালা মঞ্চে এনেছেন। এরমধ্যে- জয়গুন বিবির পালা, রুপচাঁন সুন্দরীর পালা, ভানুচন্দ্রের পালা, গুনজান বিবির পালা অন্যতম।
তিনি আরও বলেন, আমি উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের অমর প্রেমাখ্যান রোমিও-জুলিয়েট অবলম্বণে রচনা করেছি ‘ভানু-চন্দ্রের পালা’। এটি একটি ভিন্ন ধরণের পালা। শেক্সপিয়ারের গল্প আমাদের লোকজ আঙ্গিকে নিয়ে আসার এই কাজটি অসাধারণ হয়েছে। যেমন ধরুন :
‘আসর জুড়ে রসের ভানু পাল তুলিয়া যায়/আইসো গো মা স্বরস্বত্তি আমার বন্দনায় …’
এমন বন্দনা গীতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ভানু-চন্দ্রের পালা। এখানে তৎকালীন শেক্সপিয়ারের রোমিও-জুলিয়েটকে সম্পূর্ণ লোকজ আঙ্গিকে ভানুমতি ও চন্দ্রকুমার রূপে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছি।
গীত-বাদ্য ও নৃত্যের তালে অভিনয়ের মাধ্যমে পালার কাহিনী বর্ণনা করেন সায়িক। সাধারণত কিশোরগঞ্জের ভাষায় পালা রচনা করেন তিনি।
সায়িকের অন্যতম পালার মধ্যে রয়েছে ‘রুপচাঁন সুন্দরীর পালা’। ১৬ বছরের যুবতী কন্যা রুপচাঁন সুন্দরী। যার প্রণয় হয় মজলিসপুর গ্রামের যুবক সুজনের সাথে। মা হারা এই মেয়ের ঘরে রয়েছে সৎ মা। রুপচাঁন আর সুজনের প্রেমের শেষ পরিনতি হিসেবে তাদের বিয়ে হয়। রুপচাঁনের সৎ মায়ের ভাই-এর ছেলে সেফা মিয়ার পরামর্শে রুপচাঁনের সৎ মা বিয়ের দিন রুপচাঁন আর সুজনকে বাড়িতে রেখে দেন। বাসর রাতে সুজনকে খাওয়ানোর জন্য রুপচাঁনের মা রুপচাঁনের হাতে তুলে দেন বিষ মিশানো শরবতের গ্লাস। বাসর রাতেই সেই বিষ মিশানো শরবত খেয়ে সুজন মারা যায়। ওই রাতেই রুপচাঁনের বাবাকে মেরে কন্যাকে তুলে নিয়ে যায় দুর্বৃত্ত সেফা মিয়া। তার নিজের বাড়িতে নিয়ে রুপচাঁনকে ধর্ষণ করে ফেলে রেখে যায়। রূপচাঁন এই লজ্জা সইতে না পেরে আত্মহত্যা করে। এমনই কাহিনি উঠে আসে সায়িকের ‘রুপচাঁন সুন্দরী’র পালায়।
সায়িক তার পালার আকর্ষণীয় স্থানের কোনো একটি অংশে সচেতনতামূলক ম্যাসেজ দেন দর্শকদের সামনে। এখানে উঠে আসে সমস্যার সমাধান। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। তার এমনই একটি পালার মধ্যে রয়েছে ‘গুলেজান গুলেজা’। ফেসবুকের অপব্যবহার ও ভারতীয় সিরিয়ালে আসক্তির প্রভাবে পরিবার ও সমাজের যে অবক্ষয় ঘটছে তা উঠে এসেছে এ পালার মধ্যে।
‘গুলেজান গুলেজা’ কাহিনী সম্পর্কে সায়িক একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে বলেন, একটি মেয়ের নাম গুলেজান আক্তার গুলেজা। সে ফেসবুক ব্যবহার করতে এসে নিজের নাম বদলে রাখে গুলেজান গুলেজা। মেয়েটি ফেসবুকের প্রতি এতো বেশি আসক্ত হয়ে ওঠে যে মায়ের সঙ্গে কথা বলতে গেলেও বিরক্তি বোধ করে। মায়ের সঙ্গে মেয়ের দূরত্বের চিত্র ফুটে উঠেছে এই পালার মধ্যে।
মেয়ের ফেসবুক আসক্তি দেখে মা যখন তাকে মোবাইল ব্যবহার করতে নিষেধ করেন তখন মেয়েটি প্রতিবাদ করে। সে বলে ওঠে- তুমি তো তোমার সিরিয়াল বাদ দিয়ে আমাকে সময় দিতে পারো না। তাহলে আমি কেনো ফেসবুক ব্যবহার বন্ধ করে দিবো!
সমসাময়িক বিষয় নিয়ে সায়িকের এই যে প্রচেষ্টা তা ইতিমধ্যে প্রশংসা লাভ করেছে। দেশের গণ্ডি পাড়ি দিয়ে ঐতিহ্যবাহী পালা প্রদর্শিত হয়েছে বিশ্ব দরবারে। সম্প্রতি স্পেনের সেগোভিয়ায় সায়িক তার পালা প্রদর্শন করেন।
গত ১৪ থেকে ২২ জুলাই হয়ে গেল স্পেনের সেগোভিয়া শহরে ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের (আইটিআই) ৩৫তম কংগ্রেস। সেখানেই তরুণ নাট্যকর্মী (ইয়াং প্র্যাকটিশনার্স) হিসেবে আমন্ত্রণ পান সায়িক সিদ্দিকী। সেই বিশ্ব মঞ্চ জয় করে সায়িকের পালা।
সায়িক এ বিষয়ে জানান, আমাদের পালাগুলো এতো বেশি শক্তিশালী যে ভিন্ন ভাষার মানুষগুলোও এই পালার অভিনয় ও গাথুনি দেখে আকৃষ্ট হয়েছেন। তারা আমার প্রদর্শনীর সময় আমাকে সহযোগিতা করতে নিজে থেকেই মঞ্চে উঠে আসে। সেদিনেই বুঝতে পেরেছি আমাদের পালার ঐতিহ্য ও মান কতটা উর্বর ও সমৃদ্ধ।
উল্লেখ্য, ‘পালা’ আঙ্গিকটি বাঙালি জীবনের মধ্যযুগের অত্যন্ত জনপ্রিয় শিল্প। বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যযুগে মঙ্গলকাব্য ধারার উপস্থাপনরীতি ছিল প্রধানত পাঁচালি কিংবা পালাকেন্দ্রিক। বৈশিষ্ট্য ও বিষয় অনুসারে ‘পালা’ ভিন্ন-ভিন্ন নামেও পরিচিত। মধ্যযুগে মঙ্গলকাব্য দিনে পরিবেশিত হলে বলা হতো দিবাপালা আর রাত্রিকালে উপস্থাপিত হলে বলা হতো নিশাপালা। সমকালীন বাংলাদেশে মানবীয় প্রেমাখ্যান নিয়ে নানা নামকরণে ‘পালা’ পরিবেশিত হয়ে থাকে।
এসএ/ডব্লিউএন
আরও পড়ুন