ঢাকা, রবিবার   ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪

সিআরপি’র ৪২ বছর ও একজন ভ্যালেরি টেইলর

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১০:২৬, ১১ ডিসেম্বর ২০২১

‘আমি প্রথম বাংলাদেশে আসি ২৫ বছর বয়সে। একটি আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পক্ষ থেকে একজন ফিজিওথেরাপিস্ট হিসেবে আমার আগমন। সালটা ছিল ১৯৬৯। সে-সময় ১৫ মাস এখানে কাজ করেছিলাম। তারপর নিজের দেশ ইংল্যান্ডে ফিরে যাই।

এরপর আবার আসি ১৯৭১ সালে, যখন বাংলাদেশ সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি রাষ্ট্র। সারা দেশে তখন অসংখ্য যুদ্ধাহত মানুষ। যন্ত্রণাক্লিষ্ট এই মানুষদের সেবা দিতে গিয়ে অনুভব করলাম, এদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী উদ্যোগ। সিদ্ধান্ত নিলাম এদেশের অসহায় মানুষের পাশে আমাকে দাঁড়াতে হবে।

সেই সিদ্ধান্তেরই বাস্তব রূপ আজকের সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব প্যারালাইজড (সিআরপি) বা পক্ষাঘাত পুনর্বাসন কেন্দ্র। সিআরপি-র শুরুটা ১৯৭৯ সালে। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিত্যক্ত সিমেন্ট গোডাউনে চার জন রোগী নিয়ে আমরা কাজ শুরু করেছিলাম। বছর কয়েক পরে হাসপাতালের প্রয়োজনে সেই গোডাউনটা ছেড়ে দিতে হয়।

শুরু হয় আমাদের তপস্যার জীবন। কারণ দুস্থ রোগীদের কেউ সহজে জায়গা দিতে চায় না। সিআরপি-কে বেশ কয়েকবার স্থানান্তরিত করতে হয়েছে। হাসপাতালের জিনিসপত্র আর রোগী এসব নিয়ে বার বার জায়গা বদলানো ছিল আমাদের জন্যে দুঃসহ এক অভিজ্ঞতা। কিন্তু আমি এই রোগীদের কখনো ছেড়ে যেতে পারি নি। 

আমি মনে করি, বার বার জায়গাবদল আর এতরকম ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে আমরা একটু একটু করে সিআরপি-কে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে দৃঢ় হয়েছি। অবশেষে ১১ বছর পর ১৯৯০ সালে সাভারে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো সিআরপি-র কেন্দ্রীয় অফিস। বর্তমানে মিরপুর, রাজশাহী, সিলেটসহ দেশের ১২টি জেলা শহরে এর শাখা রয়েছে।

চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে সমমর্মী একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে যাওয়াই সিআরপি-র লক্ষ্য। ঠেলাগাড়ি চালক, রিকশা চালক, রাজমিস্ত্রীদের মতো দরিদ্র মানুষদের অনেকেই স্পাইনাল কর্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়ে এখানে আসে। অর্থাভাবের কারণে তাদেরকে বড় হাসপাতালগুলো ভর্তি নেয় না। অসহায় এই রোগীরা আশ্রয় পায় এ প্রতিষ্ঠানে। আমাদের কর্মীরা ধৈর্য, মমতা, যত্ন নিয়ে এদেরকে সুস্থ করে তোলেন। এরপর স্বাবলম্বী হওয়ার প্রশিক্ষণ দিয়ে ব্যবস্থা করা হয় তাদের পুনর্বাসনের। 

পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীদের চিকিৎসায় যে ধরনের অত্যাধুনিক সরঞ্জামের প্রয়োজন তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। হাতের কাছে যে কাঁচামাল পাওয়া যায়, তা দিয়েই অধিকাংশ চিকিৎসা-সরঞ্জাম তৈরি করা হয় সিআরপি-তে। কারণ এটা সাশ্রয়ী এবং রোগীদেরও প্রতিকূলতা জয় করতে শেখায়। 

যেমন, হুইল চেয়ার বানানোর জন্যে আমরা ব্যবহার করে থাকি সাইকেলের চাকা, রিকশার যন্ত্রাংশ। রোগীরাও এগুলো তৈরি করতে শেখে। ফলে কখনো প্রয়োজন হলে যান্ত্রিক ত্রুটি তারা নিজেরাই মেরামত করতে পারে।

এ ছাড়াও দরিদ্র রোগীদের জন্যে সিআরপি-তে রয়েছে বিদ্যুৎবিহীন মাটির বাড়িতে জীবনযাপনের প্রশিক্ষণ। এখানে নিজের বাড়ির মতো বাঁশ, কাঠ, মাটির ঘরের দেয়াল ধরে তারা হাঁটতে শেখে, কাজ করতে শেখে। ফলে তারা যখন বাড়ি ফিরে যায়, পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে খুব সহজেই।

আমি সবসময় বিশ্বাস করেছি সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণ পেলে পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীরাও স্বাভাবিক কর্মময় জীবনযাপন করতে পারেন। নিজের এই বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গিকে আমি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছি আমার সহকর্মীদের মধ্যেও। সিআরপি-তে এসে যত, শুশ্রষা ও প্রশিক্ষণ পেয়ে সুস্থ হয়েছেন, এমন অনেকেই এখন এ প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। কেউ রিসিপশনিস্ট, কেউ অসুস্থদের থেরাপি দিচ্ছেন, কেউ অন্যদের সাহস জোগাচ্ছেন। নতুন রোগীদের সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দিয়ে তারা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এই কর্মীরা যখন নিজের সুস্থতার কথা রোগীদের বলেন, শারীরিক অনুশীলনে নিয়ে যান, জীবনকে নতুন করে শুরু করতে বলেন, তখন রোগীরা অনেক বেশি উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন। 

সিআরপি-র মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে, পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষদের সুস্থ করে তোলার পর তাদের কর্মক্ষম ও স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে সাহায্য করা। এদের মধ্যে শিক্ষিতদের আমরা বলি এসো, তোমরা শিশুদের লেখাপড়া শিখতে সাহায্য করো। আর অক্ষরজ্ঞানশূন্য হলে তাদের বিভিন্ন জিনিস তৈরির কাজ শেখাই। এতে তারা নিজের এবং পরিবারের দায়িত্ব নিতে সক্ষম হন। সমাজের বোঝা হয়ে তাদের বেঁচে থাকতে হয় না। কাজের মধ্য দিয়ে তারা জীবনের অর্থ নতুন করে খুঁজে পান। আসলে কাজই তো আমাদের বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগায়। 

দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়ে চলাচলে অক্ষম, অসহায়, ব্যথাক্লিষ্ট মানুষেরা যখন সিআরপি-তে আসেন, তখন তারা জীবন্মৃত। আমাদের এখান থেকে সেবা নিয়ে এ রোগীরা স্বাবলম্বী হয়ে বাড়ি ফিরে যান। এই রূপান্তর দেখাটা স্বর্গীয় আনন্দের। বার বার এই আনন্দের দেখা পেতেই আমরা নিরলস কাজ করে যাচ্ছি। ঈশ্বর যদি আবার জন্ম দেন, তাহলে বাংলাদেশের মাটিতেই আমি কাজ করতে চাই।’

পক্ষাঘাতগ্রস্থ কিংবা নানা আঘাতপ্রাপ্ত মানুষজন যারা ঢাকার কাছে সিআরপি নামের দাতব্য প্রতিষ্ঠানটিতে পুনর্বাসনের জন্য যান, তাদের অনেকের কাছেই পরিচিত এবং প্রিয়মুখ ভ্যালেরি অ্যান টেইলর, যিনি সিআরপির প্রতিষ্ঠাতা। তিনি এভাবেই বর্ণনা করেছেন তার বাংলাদেশের প্রেমে পড়ের কথা।

১৯৬৯ সালে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) আসার পরের সময়ের কথা বলতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, “বিমান থেকে নেমেই আমি চন্দ্রঘোনার দারুণ সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে যাই। একদিন নদীতে ঘন কুয়াশা ছিলো। আশেপাশে আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ একটি সাম্পান আমার চোখে পড়ে, মাঝি দাঁড় বাইছে, আর মনে হচ্ছে সাম্পানটি পানির দুই তিন ফুট উপরে ভেসে চলছে। কারণ চারপাশে কুয়াশার মধ্যে শুধু সাম্পানটি দেখা যাচ্ছিলো। সে দৃশ্য এখনো পরিস্কারভাবে আমার মনে ভাসে।”

তার নিজের হাতে গড়া সিআরপি প্রতিষ্ঠার ৪২ বছর হয়ে গেল। আর টেইলরের বাংলাদেশে আগমনের ৫২ বছর অতিক্রম হল। অথচ তিনি মাত্র ১৫ মাসের জন্য স্রেফ অভিজ্ঞতা আহরণে এসেছিলেন চট্টগ্রামের চন্দ্রঘোনায়।

এ নিয়ে তার মন্তব্য এমন যে, তিনি বলেন, “আমি ভাবছিলাম- মনে হয় পূর্ব পাকিস্তান আমার ভালো লাগবে না। ভাবলাম যখন আমি ১৫ মাসের জন্য যেতে পারবো তাহলে কেন দুই বছরের জন্য চুক্তি করবো? সুতরাং আমি ১৫ মাসের জন্যই চুক্তি করেছিলাম। অথচ এতো বছর পর এসে এখন মনে হচ্ছে আমি মনে হয় পরিকল্পনায় খুব একটা ভালো না।’

পঙ্গু মানুষদের পুনর্বাসনে অবদানের জন্য ২০০৪ সালে স্বাধীনতা পদক পান টেইলর। তার আগে ১৯৯৮ সালে তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। বিভিন্ন দেশের দাতাগোষ্ঠি ও সংস্থার অনুদানে পরিচালনা করা হয় সিআরপির কার্যক্রম।

মূলত যারা সিআরপিতে বিভিন্ন সময়ে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতে এসেছিলেন পরবর্তীতে তারাই এটিকে পরিচালনার জন্য অর্থের জোগান দিতে থাকেন।
এসএ/


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি