গত বছরে নিহত ১৪২ জন
সীতাকুন্ড সড়কে মৃত্যুর ফাঁদ
প্রকাশিত : ২২:৫৮, ৬ এপ্রিল ২০১৮ | আপডেট: ১১:০৩, ৮ এপ্রিল ২০১৮
বন্দর নগরী চট্টগ্রামের প্রবেশদ্বার সীতাকুণ্ড মহাসড়কে প্রতিদিন দুর্ঘটনায় ঝরে যাচ্ছে অগণিত তাজা প্রাণ। গত এক মাসেই এই সড়কে অন্তত ৩৮টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে নিহত হয়েছে ১৬ জন। এক হিসেবে দেখা গেছে, গত এক বছরে ২১৯টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ১৪২ জন। এছাড়া আহত হয়েছেন হাজারো যাত্রী।
সীতাকুণ্ডে দুর্ঘটনা মুক্ত ও নিরাপদ মহাসড়কের দাবীতে আগামীকাল (৭ এপ্রিলের) সীতাকুণ্ডের সর্বস্তরের জনগণের পক্ষ থেকে মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। আজ শুক্রবার এই উপলক্ষে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করছেন মানববন্ধন বাস্তবায়ন পরিষদ।
আগামীকাল শনিবার সকাল ১০টায় চট্টগ্রামের সিটি গেট থেকে সীতাকুণ্ডে বড়দারোগাহাট পর্যন্ত (দীর্ঘ ৪০কিলোমিটার) ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পশ্চিমপাশে এ মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হবে। এই মানববন্ধনে সীতাকুণ্ডের প্রায় দুই শতাধিক সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ক্রীড়া, সেবামূলক সংগঠন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ৯টি ইউনিয়ন পরিষদ, ১টি পৌরসভার প্রতিনিধিসহ সকল শ্রেণি পেশার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিয়েছেন।
প্রতিদিন এই সড়কে দুর্ঘটনা যেন নিত্য দিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ২৪ মার্চ মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় দশ বছরের আরিফা নামের এক শিশু। সে আর কোন দিনই ফিরবে না তার মায়ের কোলে। মাকে সে আর কখনওই মা বলে ডাকবে না! এ কথা এখনো মেনে নিতে পারছেন না হতভাগ্য মা কোহিনুর আক্তার (৩৮)। তাইতো মেয়ের মৃত্যুর এক সপ্তাহ পরও হাসপাতালের বেডে শুয়ে অবুঝ শিশুর মত আরিফার নাম ধরে কাঁদেন তিনি। কাঁদতে কাঁদতে মেয়েকে কাছে ডাকেন। তাকে দেখতে চান। কিন্তু তাঁর এ চাওয়া পূরণ হয় না। হবেই বা কি করে? সড়ক দুর্ঘটনা তার ফুটফুটে শিশু আরিফাকে মা–বাবার কোল থেকে চিরদিনের মত কেড়ে নিয়েছে। সেদিন এ অঘটনটি ঘটেছিলো সীতাকুণ্ডের ছোটকুমিরা বাজারে। শিশু আরিফা স্থানীয় রোজ গার্ডেন একাডেমি নামক কিন্ডার গার্টেন স্কুলের ৫ম শ্রেণীর ছাত্রী। একই স্কুলের শিক্ষিকা তার মা কোহিনুর।
জানা যায়, একই উপজেলার কুমিরা ইউনিয়নের মগপুকুর গ্রামের মো. জসীম উদ্দিনের মেয়ে আরিফা অন্যান্য দিনের মতই সেদিন সকালে মায়ের সাথে স্কুলে গিয়েছিলো। সারাদিন স্কুলে পড়াশুনা করে বিকালে সেইফ লাইন নামক হিউম্যান হলার যোগে মায়ের সাথে আবারো নিজ বাড়ি মগপুকুরে ফিরছিলো। তাদের বহনকারী গাড়িটি অনেকটা পথ পেরিয়ে বাড়ির কাছাকাছি ছোটকুমিরা বাজারে যখন পৌঁছায় ঠিক তখনই গাড়ি চালকের মুহূর্তের অসতর্কতায় সেখানে ট্রাক, হিউম্যান ও অপর একটি লোকাল মিনিবাসের ত্রিমুখী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে যায়। ঐ দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন আরিফার মা কোহিনুর আক্তারসহ আরো ১০ যাত্রী। সেই থেকে মা কোহিনুর আক্তার এখনো চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। কোহিনুরের কোমরের তিনটি হাড় ভেঙে গেছে। ঘটনার পর নিহত মেয়ের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে তাকে চমেকে চিকিৎসা দেওয়া হলেও গুরুতর আহত কোহিনুরের জ্ঞান ফিরলেই শুধু মেয়ের কথা বলছেন।
এসব তথ্য জানিয়ে আরিফার মামা ও কুমিরা ইউনিয়ন পরিষদের ৭নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. আলাউদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, দুর্ঘটনায় আরিফা ঘটনাস্থলেই মারা যায়। একই সাথে গুরুতর আহত হয়েছে তার মা কোহিনুর। তার কোমরের তিনটি হাড় ভেঙে গেছে। ফলে গত রবিবার দীর্ঘ তিন ঘণ্টা ধরে জটিল অপারেশন হয়েছে তার। ঐ দিন দীর্ঘ সময় পর তার জ্ঞান ফেরে। তবে এতদিন পরেও শুধু মেয়ের জন্যই কেঁদে ওঠছে সে।
আলাউদ্দিন আরও বলেন, ঘটনার পর প্রথম দিকে আরিফার মৃত্যুর কথা তার মা জানতো না। সে ভেবেছিল তার মতই মেয়েও চিকিৎসাধীন রয়েছে। কিছুক্ষণ পর পর মেয়ে কোথায় জানতে চাচ্ছিলো। কিন্তু তার অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় কেউ কিছু জানায়নি। এমনকি মেয়ের দাফনও দেখতে পারেনি হতভাগ্য মা। পরে আত্মীয় স্বজন ও অন্যদের আচার আচরণে বুঝতে পারলেও এখনো যেন মেয়ের মৃত্যুর কথা মানতে পারছেন না সে।
কুমিরা হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. মাসুদুল আলম ও ঘটনাস্থলে উপস্থিত কুমিরা ইউপির চেয়ারম্যান মো. মোর্শেদুল আলম চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, সেদিন তাদের বহনকারী হিউম্যান হলারটির চালক অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে মহাসড়কের পূর্ব দিক থেকে পশ্চিমের সড়কে আসছিলো। এসময় উত্তর দিক থেকে আসা চট্টগ্রামমুখী একটি পিকআপ ভ্যান গাড়িটিকে সজোরে ধাক্কা দিলে সেটি ছিটকে গিয়ে ঢাকামুখী একটি ৭নং লোকাল বাসের সাথে ধাক্কা খায়। এতে ঘটনাস্থলেই আরিফার মৃত্যু ছাড়াও আরো বেশ কয়েকজন যাত্রী আহত হন।
এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, শুধু আরিফার মৃত্যু–ই নয়, বন্দর নগরী চট্টগ্রামের প্রবেশদ্বার সীতাকুণ্ড উপজেলাধীন ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটছে নিয়মিতই। এতে আরিফার মত বহু সম্ভাবনা অকালে ঝরে যাচ্ছে। কোনো কোনো পরিবার একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটিকে হারিয়ে পথে বসছে বহু পরিবার। অভিভাবক হারিয়ে এতিম হয়ে যাচ্ছে অনেকে। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। এসব দুর্ঘটনা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজছে তারা।
দুর্ঘটনার পরিসংখ্যাণ:
সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সূত্রে জানা গেছে সীতাকুণ্ড উপজেলাধীন ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কে গত এক বছরে ২১৯টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ১৪২ জনের প্রাণহানি হয়েছে। এছাড়া আহত হয়েছে হাজারো মানুষ। শুধু গত একমাসেই (মার্চ) এখানে অন্তত ৩৮টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছে অন্তত ১৬ জন। এছাড়া আহত হয়েছেন অর্ধ শতাধিক যাত্রী। এর মধ্যে শুধু বার আউলিয়া থানা এলাকায় মারা গেছেন ৬ জন। কুমিরা হাইওয়ে ফাঁড়ি এলাকায় ৪ জন, ফৌজদারহাট ফাঁড়ি এলাকায় ২জন ও সীতাকুণ্ড থানা এলাকায় ৪জন।
দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা
সীতাকুণ্ড উপজেলার প্রায় সর্বত্র কমবেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। তবে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে এমন জায়গাগুলো হলো- ফৌজদারহাট বন্দর সংযোগ সড়ক, মাদামবিবিরহাট, জোড়আমতল ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় গেট, কুমিরা রয়েল সিমেন্ট ফ্যাক্টরি গেট, ছোটকুমিরা বাজার সংযোগ সড়ক, বাঁশবাড়িয়া বাজার ক্রসিং, বাড়বকুণ্ড, সীতাকুণ্ড পৌর সদরের উত্তর ও দক্ষিণ বাইপাস, নুনাছরা, পন্থিছিলা ইত্যাদি।
দুর্ঘটনার কারণ
মহাসড়কে দায়িত্বরত হাইওয়ে পুলিশ, গাড়ির ভুক্তভোগি যাত্রী ও দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বলে দুর্ঘটনার নেপথ্যে বেশ কিছু কারণের কথা জানা গেছে। এসব কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ট্রাফিক আইন অমান্য করে গাড়ি চালনা। এছাড়া ঘুম চোখে গাড়ি চালানো, চালকদের নিজেদের মধ্যে আগে যাবার প্রতিযোগিতা, ঝুঁকিপূর্ণ ড্রাইভিং, উল্টো পথে গাড়ি চালানো, সংযোগ সড়ক থেকে দ্রুত গতিতে মহাসড়কে উঠা, অদক্ষ চালক (অধিকাংশ ক্ষেত্রে হেল্পারের হাতে গাড়ি থাকা) কর্তৃক গাড়ি চালনায় বারবার দুর্ঘটনা ঘটছে।
অসতর্কতায়ও প্রচুর প্রাণহানি ঘটছে
দুর্ঘটনার নেপথ্য কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, মহাসড়কে অধিকাংশ দুর্ঘটনার জন্য চালকরা যেমন দায়ী তেমনি অনেক ক্ষেত্রে দায়ী সাধারণ মানুষও। দুয়েক মিনিট সময় বাঁচাতে ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার না করা কিংবা ঝুঁকি নিয়ে দ্রুত মহাসড়ক পার হতে গিয়ে অনেকেই দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রাণ হারাচ্ছেন। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, মহাসড়কে যানবাহন দুর্ঘটনা কবলিত হয়ে যত মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে তার ৬০ শতাংশই মারা যাচ্ছে ঝুঁকিতে সড়ক পারাপার হতে গিয়ে। তাই সাধারণ নিজের জীবন বাঁচাতে একটু সর্তক হলেই অনেক প্রাণ রক্ষা পাবে এটি নিশ্চিতভাবেই বলা চলে।
সচেতন মহলের প্রতিক্রিয়া
সীতাকুণ্ডে বারবার দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনায় সর্বমহলে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। সমাজের বিভিন্নস্তরের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গও এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি সচেতনা সৃষ্টিতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছেন। সীতাকুণ্ড প্রেসক্লাবের সভাপতি এম, সেকান্দার হোসাইন বলেন, এখানে প্রচুর দুর্ঘটনা ঘটছে। অনেকগুলো দুর্ঘটনা–ই ঘটছে গাড়ি চালক ও সাধারণ মানুষের সচেতনতার অভাবে। তাই চালক ও সাধারণ মানুষ সচেতন হলেই দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে আসবে। এ কারণে তাদেরকে সচেতন করতে আমরা এলাকার সচেতন ব্যক্তিবর্গের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মহাসড়কে কিছু কর্মসূচি পালনের উদ্যোগ নিচ্ছি।
সীতাকুণ্ড পৌরসদর ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. নাছির উদ্দিন ভূঁইয়া ও উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রঞ্জিত সাহাও প্রায় অভিন্ন বক্তব্য রেখে বলেন, এখানে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে হাইওয়ে পুলিশকে যেমন তাদের আইনগুলো কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে তেমনিভাবে সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে। এ বিষয়ে আমরাও প্রেসক্লাবসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে সচেনতা সৃষ্টিতে শীঘ্রই মাঠে নামব।
হাইওয়ে পুলিশের বক্তব্য
সীতাকুণ্ডের বারআউলিয়া হাইওয়ে থানার ইনচার্জ মো. আহসান হাবীব বলেন, এখানে দুর্ঘটনার জন্য গাড়ি চালকের ট্রাফিক আইন অমান্যই যেমন দায়ী কারণ তেমনি পথচারীদের অসচেতনতায়ও প্রচুর দুর্ঘটনা ঘটে।
তিনি আরও বলেন, আমার এলাকায় যেসব দুর্ঘটনা ঘটছে তারমধ্যে ৬০ শতাংশ প্রাণহাণি হচ্ছে ঝুঁকি নিয়ে তড়িঘড়ি মহাসড়ক পারাপার হতে গিয়ে। কোন কোন ক্ষেত্রে মোবাইলে কথা বলতে বলতে সড়ক পারাপারেও প্রানহাণি হচ্ছে। তবে ট্রাফিক আইন অমান্যকারী যানবাহন ও গাড়ি চালকের বিরুদ্ধে নিয়মিতই অভিযান হচ্ছে। গত মার্চ মাসেও ৪২০টি মামলা দায়ের করেছি আমরা। তবুও দুর্ঘটনা ঘটছে। আসলে সংশ্লিষ্ট সবাই সচেতন হলে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি অনেকাংশে কমতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
কেআই/টিকে