সুদের হার: ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে বৈকি
প্রকাশিত : ১৬:০৪, ১৮ জুন ২০২২
ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা এবং বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে সরকার গ্রাহক পর্যায়ে ঋণের সুদের হার এক ডিজিটে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সাথে আলোচনা করে ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ এবং আমানতের সুদের হার ৬ শতাংশ নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
প্রথমে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন নিয়ে কিছুটা সন্দেহ থাকলেও সকলের সহযোগিতায় সরকার সফলভাবে তা বাস্তবায়ন করতে সমর্থ হয়। ৬-৯ নীতি বাস্তবায়নের সমসাময়িক সময়ে হানা দেয় মাহামারি করোনা, যা প্রতিষ্ঠিত সকল অর্থনৈতিক নিয়মনীতিকে অকার্যকর করে দেয়। অর্থনীতি, জীবন-জীবিকাকে টিকিয়ে রাখতে সরকারকে ব্যাপক মাত্রায় হস্তক্ষেপ করতে হয়। উৎপাদন কার্যক্রম বজায় রাখার জন্য প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় বিপুল অংকের অর্থ অর্থনীতিতে পুশ করা হয়। ঋণের চাহিদা তলানিতে নেমে আসে। বৈদেশিক বাণিজ্য, অভ্যন্তরীণ চাহিদা সবকিছু তলানিতে থাকায় ব্যবসায়ীরাও নতুন করে বিনিয়োগ করেনি। বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধির হার ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে। চাহিদা না থাকায় ঋণের সুদহার ৭ শতাংশ পর্যন্ত নেমে আসলেও প্রতিকূল পরিস্থিতি বিবেচনায় তেমন বিনিয়োগ হয়নি দেশে। অর্থাৎ সরকারের ঋণের সুদ এক ডিজিটে নামিয়ে নিয়ে আসার যে প্রকৃত উদ্দেশ্য, তা বৈশ্বিক মহামারীর কারণে বাস্তব হয়নি।
এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে একটি পক্ষ প্রচারণা চালাচ্ছে যে, সুদহার কমানোর পরও বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়নি, যেখানে সুদহার ১২-১৩ শতাংশ থাকাকালীন বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ১৭-১৮ শতাংশ পর্যন্ত ছিল, সুতরাং সুদহারের সঙ্গে বিনিয়োগ বৃদ্ধির তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু তারা যে বিষয়টিকে ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষা করছেন, তা হলো করোনার কারণে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা।
বিশ্ব অর্থনীতির সাথে তাল মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি ও যখন করোনার ভয়াবহতা কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে। আমদানি, রপ্তানি, অভ্যন্তরীণ চাহিদা সবকিছুতে গতিসঞ্চার হতে শুরু করেছে ঠিক তখনি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দামামা সবকিছুকে একদম ওলট-পালট করে দিয়েছে। বিশ্ব বাজারে আমদানিপণ্যের দাম রেকর্ডের পর রেকর্ড ভাঙছে। যার প্রভাব অভ্যন্তরীণ বাজারে পড়তে বাধ্য এবং তাই হয়েছে। দেশের মূল্যস্ফীতির পরিমাণ বিশ্ব বাজারের ন্যায় লক্ষ্যমাত্রার থেকে অনেকখানি ছাড়িয়ে গিয়েছে। অর্থনীতির স্বাভাবিক সূত্র অনুযায়ী, আমানতের সুদের হার গড় মূল্যস্ফীতির ওপরে থাকা বাঞ্ছনীয়।
সুতরাং আমানতের সুদের হার আর ৬ শতাংশে বেঁধে রাখা যাচ্ছে না, আর এই বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুস্পষ্ট নির্দেশনা তো আছেই যে, মেয়াদি আমানতের সুদের হার গড় মূল্যস্ফীতি পর্যায়ের নিচে নামানো যাবেনা। যেহেতু আমানতের সুদহার ৬ শতাংশে বেঁধে রাখা যাচ্ছেনা তাই ঋণের সুদহারও আর ৯ শতাংশে বেঁধে রাখা যাবেনা। এ জন্য দুটোকেই (৬-৯ হার) ছেড়ে দিতে হবে। ইতোমধ্যে আমানত ও ঋণের সুদহারের সীমা তুলে দেওয়া নিয়ে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো বেঁধে রাখা যাচ্ছে না বলেই কি পুরোপুরি ছেড়ে দিতে হবে? পশ্চিমা ঘরানার অর্থনীতিবিদদের তরফ থেকে দাবি এসেছে, ঋণের সুদের হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার। তারা প্রথম থেকে ঋণের সুদহার বেঁধে দেয়ার বিপক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছিলেন, যদিও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সরকারের দৃঢ়তার কাছে তাদের এই অবস্থান তেমন সুবিধা করতে পারেনি।
কিন্তু এবার তাদের অবস্থান পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী এবং সরকারও সম্ভবত কিছুটা নমনীয় তাদের কথা শুনতে। সবাই প্রশ্ন করছেন, আমানতের সুদহার নিয়ে, কিন্তু কেউ এই প্রশ্ন করছেন না ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় কেন এত বেশি? আমানত ও ঋণের সুদহারের পার্থক্য কেন ৩ শতাংশ, কেন ১.৫ বা ২ শতাংশ নয়? আর ব্যাংক ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে কি শুধুমাত্র ঋণের সুদ আদায় করে? ঋণের সুদ ছাড়াও সার্ভিজ চার্জ, প্রসেসিং ফি, স্টেটমেন্টর জন্য ফি বিভিন্ন নামে যে অর্থ আদায় করে তাতে ঋণের প্রকৃত সুদহার আরও দুই শতাংশ বেশি হয়। ব্যাংকগুলোতে পরিচালন ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনা গেলে, এই প্রতিকূল সময়ে আমানতের সুদহার গড় মূল্যস্ফীতির ওপর রেখেও ব্যাংকের পক্ষে মুনাফা অর্জন সম্ভব।
একটি বিষয় আমাদের মাথায় রাখা প্রয়োজন, বিদ্যমান যে সংকট, তা দ্রুতই কেটে যাবে আশা করা যায়। মূল্যস্ফীতিও লক্ষ্যমাত্রার নীচে নেমে আসবে। কিন্তু এত দেন-দরবার করে এক ডিজিটের সুদের হার বাস্তবায়ন করা হলো, তা পুনরায় আর করা যাবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বিনিয়োগ বাড়ানোর যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সরকার এই নীতি বাস্তবায়ন করেছিল তা প্রমাণের সুযোগ পাওয়ার আগেই যদি উঠিয়ে দেওয়া হয় তবে ভবিষ্যতে ঋণের সুদ বিষয়টি নিয়ে কোনো বড় রকমের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরকারের অবস্থান অনেক দুর্বল হয়ে যেতে পারে। একবার ছেড়ে দিলে আমানতের সুদহার মূল্যস্ফীতির থেকে সর্বোচ্চ এক-দুই শতাংশ বেশি হবে কিন্তু ঋণের সুদহার কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তার কোনো সীমানা থাকবে না।
গত কয়েক মাসে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধিতে অগ্রগতি অর্জিত হয়েছিল তা আবার নেমে যেতে পারে। তাছাড়া আমানতের সুদহার ১ শতাংশ বাড়ালেই বিদ্যমান মূদ্রাস্ফীতিকে কভার করা সম্ভব। সুতরাং সুদের হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার যে আলোচনা চলছে তাতে কর্ণপাত না করে বিদ্যমান নীতির মধ্যে থেকে যতটুকু আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা করা যায় তা করতে হবে।
কারণ কেবল ব্যাংক ব্যবসা সফল হলেই অর্থনীতি ভালো হবে, তা ভাবার কারণ নেই। বিনিয়োগ বান্ধব না হলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না, যেটি হবে সরকারের জন্য আরেক চ্যালেঞ্জ। ব্যবসা এবং ব্যাংকিং ব্যবসার মধ্যে সমন্বয় এবং ভারসাম্য থাকা মঙ্গলজনক।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক
এএইচএস//এনএস//
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।