সুস্বাস্থ্যের জন্য জরুরি সাহস ও সহমর্মিতা
প্রকাশিত : ১৪:০৬, ৬ জুলাই ২০২০
ডা. জহিরউদ্দিন আহমেদ
করোনাকাল কেটে যাচ্ছে। কেটে যাবে। কেউ আশা করুক বা না করুক, কারো ভাল লাগুক বা না লাগুক এই দুর্যোগকাল কেটে যেতে দিতে হবে। ঝড়ে বা জলোচ্ছ্বাসে বিধ্বস্ত জনপদের মত আবার ঘুরে দাঁড়াতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব ঘুরে দাঁড়াতে হবে। আতঙ্ক, হতাশা নিয়ে থাকলে আর আমাদের চলবে না। আমাদের এখন সাহস আর উদ্যম খুব জরুরি। স্বার্থপরতা ও অমানবিকতা নিয়ে থাকলে আমাদের পোষাবে না। প্রয়োজন পরার্থপরতা, সহমর্মিতা ও সমমর্মিতা।
শুধু মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা নন সচেতন মানুষ মাত্রই এখন জানেন যে, চিন্তার প্রভাব পড়ে মনের ওপর। সেই প্রভাব গিয়ে পড়ে শরীরেও। সুচিন্তা করলে শরীর মন ভাল থাকে, সুস্থ থাকে। আর কুচিন্তা ও দুশ্চিন্তা করলে শরীর মন খারাপ হয়ে যায়, অসুস্থ হয়ে যায়। তাই চিন্তাকে সকল ভয়, আশঙ্কা, আতঙ্ক, স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে মুক্ত করে সাহস, আশাবাদ, বিশ্বাস ও সহমর্মিতায় পূর্ণ করতে পারলে শারীরিক মানসিকভাবে সুস্থ থাকা সহজ হয়ে যাবে।
ইতিবাচক চিন্তা মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেয়। চাঙা রাখে মনকে। ফলে মনোদৈহিক নানা রোগ থেকে মানুষ বেঁচে যায়। ভয় আতঙ্ক রাগ ক্ষোভসহ সকল নেতিবাচক চিন্তা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে নষ্ট করে। এর উল্টোটা হল সাহস, বিশ্বাস, মমতা ও ইতিবচাকতা। কাজেই সাহসী, সহমর্মী ও ইতিবাচক থাকতে পারলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাল থাকবে। ভাল থাকবে স্বাস্থ্য। এখন তাই সবার জন্যই আতঙ্কমুক্ত হয়ে সাহসী হয়ে ওঠা দরকার। দরকার অন্যের জন্য মমতা অনুভব করা অর্থাৎ সহমর্মী হওয়া।
ইয়োগাজার্নাল-এর ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ এর একটি নিবন্ধে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ‘মমতা (নিজের প্রতি ও অন্যের প্রতি)’ মানুষের স্বাস্থ্য ভাল রাখার পিছে দারুণ ভূমিকা রাখে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন তাই গড়ে উঠছে মানসিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। মেডিটেশন, যোগ ব্যায়াম, ইতিবাচক কথা কাজ ইত্যাদির সমন্বয়ে মানুষকে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী করা সম্ভব- এই ধারণা এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে দেশে দেশে।
সাহস ও সহমর্মিতার এক বড় প্রকাশ হল স্বেচ্ছাসেবা, স্বেচ্ছাশ্রম। করোনাকালে আমরা অনেক সংগঠন ও মানুষকে দেখেছি স্বেচ্ছায় নিঃস্বার্থভাবে অন্যকে সেবা দিতে। অসহায় দরিদ্র মানুষকে ত্রাণ বিতরণ, করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তির দাফন বা সৎকার, চিকিৎসা সেবাসহ নানা জরুরি সেবার মাধ্যমে সহমর্মিতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন তারা। এই হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক ও নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা যথেষ্ট সাহসীও বটে। কারণ সাহস না থাকলে এই কাজে তারা না নেমে ঘরে বসে থাকতেন। তাদের জন্য সুখবর হল তারা নিজের অজান্তেই নিজের স্বাস্থ্যের অনেক উন্নতি করে ফেলেছেন।
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক সাময়িকী ‘সাইকোলজি টুডে’র এক নিবন্ধে ড. সারা কনরাথ টেনে এনেছেন ইউনিভার্সিটি অব এক্সেটার মেডিকেল স্কুল প্রকাশিত একটি গবেষণা পত্রের প্রসঙ্গ। যে গবেষণাটি করা হয়েছে ২০ বছর ধরে। সেখানে বলা হয়েছে, স্বেচ্ছাসেবার ফলে বিষণ্ণতা কমে। বাড়ে ভাল থাকার অনুভূতি। ড. সারা কনরাথ এর পিছে প্রধানত তিনটি কারণ রয়েছে বলে মনে করেন। প্রথমত, স্বেচ্ছাসেবা দেওয়া মানে কোন না কোন ভাল কাজে নিজের শরীর মনকে ব্যস্ত রাখা। সক্রিয় ও সচল রাখা। দেহ মনের এই সক্রিয়তা স্বাস্থ্যের জন্য ভাল।
দ্বিতীয়ত, স্বেচ্ছাসেবার মাধ্যমে প্রত্যক্ষ সামাজিক যোগাযোগ সম্পন্ন হয়। মানুষের সাথে মানুষের মানবিক মিথস্ক্রিয়া তৈরি হয়। যা শরীরে অক্সিটোসিন নামক হরমোন নিঃসরণ করে। এই হরমোনটি স্ট্রেস বা চাপ মোকাবেলা করতে সাহায্য করে।
তৃতীয়ত, অন্যকে সেবা দেয়ার ফলে সেবকের মনে গভীর সুখানুভূতি তৈরি হয়। এই অনুভূতিই তাকে সুস্থ ও দীর্ঘ জীবনের দিকে নিয়ে যায়।
সাইকোলজি টুডের আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্যের কল্যাণে কাজ করলে যে নির্মল সুখানুভূতি আমরা পাই তাতে এন্ডোরফিন, সেরোটনিনের মত নিউরো-ট্রান্সমিটার ও হরমোনের প্রবাহ বাড়ে। যা বিষন্নতা দুশ্চিন্তার মত নেতিবাচক আবেগের ঝুঁকি কমায়। বাড়ায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা।
যুক্তরাষ্ট্রের কার্নেগি মেলন ইউনিভার্সিটিতে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা বছরে অন্তত দুইশ ঘণ্টা স্বেচ্ছাশ্রম দেন তাদের রক্তচাপ অন্যদের তুলনায় কমেছে। উচ্চ রক্তচাপের পিছে দায়ী যে স্ট্রেস সেই স্ট্রেসকে কমিয়ে দেয় স্বেচ্ছাশ্রম।
কানাডায় ১৬০ জন শিক্ষার্থীর ওপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, স্বেচ্ছাশ্রমে যুক্ত হওয়ার পর তাদের কোলেস্টেরল এবং অতিরিক্ত ওজন কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। সারা বিশ্ব জুড়েই এরকম বহু সমীক্ষা, গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে। যা ধীরে ধীরে উন্মোচিত করছে সাহস, আশাবাদ, বিশ্বাস, সহমর্মিতা, পরার্থপরতা ইত্যাদি ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যের প্রভাব। সুস্বাস্থ্যের ওপর, দীর্ঘ জীবনের ওপর।
আমরা সবাই চাই সুস্থ ও দীর্ঘ জীবন। কিন্তু করোনাকালে আমরা হারিয়েছি আমাদের অনেক স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য, যা সুস্থতার জন্য জরুরি ছিল। আমরা গত প্রায় তিন মাস দেখেছি মানুষের আতঙ্কিত হওয়ার পরিণাম। আমরা হারিয়েছি আমাদের সহজাত মানবিকতা বোধ, হয়েছি মানসিকভাবে অসুস্থও। পারিবারিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পিছেও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়ী এই আতঙ্ক ও অন্যান্য নেতিবাচক আবেগ। তাই কিছু ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য দিয়ে নিজের এই ক্ষতিকে পুষিয়ে নিতে হবে এখন। আর এক্ষেত্রে সাহস ও সহমর্মিতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। স্বেচ্ছাসেবার ভেতরে রয়েছে সাহসী ও সহমর্মী হওয়ার সুযোগ। আমাদের সবাইকে, বিশেষত তরুণ প্রজন্মকে, এখন এগিয়ে আসতে হবে স্বেচ্ছাসেবামূলক নানা কাজে। দাফন, চিকিৎসা, ত্রাণ বিতরণ ইত্যাদি স্বেচ্ছাসেবায় আমরা এগিয়ে আসলেই পুরো সমাজ জুড়ে দেখবো মানবিকতার জোয়ার। করোনা পরবর্তী সমাজে এই জোয়ার দেখতে খুব উদগ্রীব হয়ে আছি।
লেখক: কনসালটেন্ট, সাইকিয়াট্রি ডিপার্টমেন্ট, ইউনাইটেড হাসপাতাল
এমবি//
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।