সেই হাসিটি ভুলবার নয়
প্রকাশিত : ১৩:৩৩, ১৭ অক্টোবর ২০১৭
না,ভুলবার কোনো উপায় নেই, ভোলা সম্ভাবও নয় । সামাদ সাহেবের সঙ্গে আমর খুব যে দেখা-সাক্ষাৎ হতো তা নয়; ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল এমনও বলা যাবে না । কিন্তু তিনি যে আছেন সেটা জানতাম,তাঁর উষ্ণ পরিস্থিতির বিষয়ে নিশ্চিত ছিলাম । অসুস্থ ছিলেন সেটা শুনেছি। তাঁর চলে যাবার ক’দিন আগে টেলিফোনে কথা হয়েছে,বলেছেন বাসাতেই থাকেন, আমি গেলে খুশি হবেন। যাওয়া হয়নি । গেলে অনেক কিছু নিয়ে আদান-প্রদান ঘটতো আমি জানি, সে সুযোগটা নিতে পারিনি। এভাবে যে চলে যাবেন কে জানতো।
শেষ দেখা ‘মিনার সমগ্র’প্রকাশনা অনুষ্ঠানে। তাঁর অসুখের কথা তখনই শুনলাম । নিজেই বললেন,মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে। কিন্তু ভীষণ অসুস্থ তাঁর কথা থেকে এমনটা আমার মোটেই মনে হয়নি। বোধ করি নিজেকে নিয়ে খুব বেশি ভাবতেন না তিনি ।
নানা বিষয়ে যে ভাবতেন,সেটা জানি । তাঁকে আমার প্রথম জানা ওই ওই ‘মিনার’পত্রিকার ভেতর দিয়েই ১৯৪৯ সালে মিনার যখন বের হয় তখনও আমি স্কুলের ছাত্র, কিন্তু মনোযোগী পড়ুয়া,নিজেরাও হাতে লেখা পত্রিকা বের করতাম:মিরার’র অত্মপ্রকাশ ছিল একটা সুসংবাদ,আমি তখন ওই কাগজের প্রত্যেকটি সংখ্যা পড়েছি । দ্বিতীয় বার পড়লাম যখন‘মিনার সমগ্র’ পেলাম ,মনে হলো এসব লেখা তো আমার পূর্ব পরিচিত । ওই একটা অসম্ভব কাজ করেছেন ওঁরা দু’জন মিলে । স্ত্রী ফওজিয়া সামাদ সম্পাদক, স্বামী এম এ সামাদ সার্বিক ব্যবস্থাপক। প্রতিষ্ঠানিক নয় , একেবারেই পারিবারিক উদ্যোগ । কে বলেছিল তাঁদেরকে ওপথে যেতে? কেউ বলেনি,গেছেন ভেতরের তাগিদে । ১৯৪৯’র ঢাকার পত্রিকা প্রকাশ ছিল দু:সাধ্য কর্ম ,তাও বিনোদনের কাগজ নয়; কিশোরদের পত্রিকা । ছাপানোর অভাব, ছবি ছাপবার ব্যবস্থা প্রাগৈতিহাসিক বিজ্ঞাপনের আশা দুরাশ বৈনয়, বিতরণ ব্যবস্থা গড়েই । তার ওই কাজটি করেছেন তাঁরা, ধরে রেখেছেন দু’বছরের বেশি ।
‘মিনার’ এর পুরে তাৎপর্যটা তখন চোখে পড়েনি ,২০০৫ সালে পড়লো,‘মিনার সমগ্র’ হাতে নিয়ে। এ ছিল ‘প্রগতিশীল কিশোর মাসিক’। ওই কথাটা যে পত্রিকার নামের সঙ্গে উল্লেখ করা হতো তখন খেয়াল করিনি,এবার করলাম । কিন্তু ওটা বলার দরকার ছিল না । তখনকার মানে তো অবশ্যই ,এখনকার মানেও ‘মিনার’ছিল অত্যন্ত অগ্রসর ।নতুন পৃথিবীর খবর থাকতো,থাকতো রাজনীতির প্রসঙ্গ,ছিল বঞ্চিত কিশোরদের কথা,উৎসাহ দেওয়া হয়েছে ‘চাঁদের হাট’ নামে কিশোর সংগঠন গঠনে । তখনকার দিনে প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির লালন-পালন পত্রিকা প্রকাশের চেয়েও বিস্ময়ের ব্যাপর ছিল।
পরে সামাদ সাহেবের সম্পর্কে শুনেছি । বীমার সঙ্গে যুক্তদরে কাছ থেকে তো বটেই,অন্যদের কাছ থেকেও । একদিন তিনি নিজে আমাদরে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসে এসেছিলেন, দু’টি বই দিতে,একটি বীমা সম্পর্কে,নোম ‘যে ব্যবসা সম্মানের ,যে ব্যবসার মূলধন লাগে না ‘। অন্যটি সৃষ্টিশীল রচনা,‘ শবিরারের ছুটি’। সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর এক সহকর্মীকে,যিনি আমার আত্মীয়। লেখক হিসেবে তার পরিচয়টি আগে জানা ছিল না।
আমরা যারা পত্রিকা প্রকাশের রোগে আক্রান্ত ,ব্যতিকগ্রস্থিই বলা চলে –তাঁদের সঙ্গে জনাব সামাদের যোগাযোগ আরেকটি সুত্র ছিল-পত্রিকার জন্য বিজ্ঞাপন । বহুবার তাঁর দ্বারস্থ হয়েছি কখনো বিফল হইনি । পত্রবাহকের হাসিহাসিমুখ করে ফিরে আসতো,বলতো সাফল্যের কথা । বিজ্ঞাপনের ব্যাপারটা সম্পর্কে তাঁর নিজেরই অভিজ্ঞতা ছিল,পত্রিকা চালানোর জন্য তা যে কেমন জরুরী তা তিনি জানতেন ।‘মিনার সমগ্র’র শেষ পাতাতে যারা বিজ্ঞাপনের দিতো তাদের একটি তালিকা আছে,ওই সব প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলোই আমাদরে পরিচিত । পত্রিকা প্রকাশের আগ্রহীদের সহায়ক হিসেবে । তালিকাটি কিন্তু দীর্ঘ নয় । বীমার ক্ষেত্রে তাঁর যে সাফল্য সেটা নিশ্চয়ই এমনি এমনি,কঠোর পরিশ্রম যে করতে হয়েছে তা বলবার অপেক্ষা রাখেনা । কিন্তু কখনোই ওই মুখের হাসিটি মিলিয়ে যায়নি । ভেতর প্রসন্ন ছিলেন ।
ওই প্রসন্ন হাসি দিয়েই তাকে চেনা যেত । ভন্ডামভর বিরক্তিকর এই জগতে অমনভাবে প্রসন্ন থাকতে খুব কম মানুষকেই আমি দেখেছি । ভেতরে নিশ্চয়ই অত্যন্ত প্রবল একটি কৌতুকবোধ ছিল । নইলে ১৯৪৭ এর শেষে রেডিও পাকিস্তানের সংবাদ বিভাগে কর্মরত অবস্থায় অমন কাজটি ঘটালেন কী করে । রেডিও পাকিস্তান তখন বাংলা ভাষায় পাকিস্তানীকরণে মনোযোগ দিয়েছিল । করাচী থেকে যে জাতীয় সংবাদ প্রচার করা হতো তাতে বাংলার সঙ্গে প্রচুর অরবী-ফার্সী শব্দ মেশানো হতো ।
রেডিওর প্রধান কর্মকর্তা জেড এ বোখারী ঢাকায় এসে সামাদ সাহেবকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সংবাদর ভাষাকে উন্নত করতে অর্থাৎ তার পাকিস্তানীকরণ ঘটাতে । সামাদ সাহেব তা৭র নিজের মতো করে ব্যাপারটার অযৌক্তিকতা ও অসঙ্গতির দিকটি তুলে ধরতে চেয়েছিলেন । কাজ হয়নি । বোখারী কোনো যুক্তি শুনতে প্রস্তুত ছিলেন না । পরে সামাদ সাহেব জবাব দিয়েছিলেন ভিন্নভাবে, এবং কৌতুকের সাথে । ঢাকা কেন্দ্রের একটি খবরকে তিনি প্রচার করেছিলেন এভাবে,‘সরকারের এক এলানে জাহির করা হয়েছে যে, আগলে রোজ সুবাহ থেকে শমতক কারফিউ জারি থাকবে ।’
প্রতিক্রিয়া ঘটেছিল সঙ্গে সঙ্গে ,প্রতিবাদ এসেছিল চতুর্দিকে থেকে এবং মূলত তাঁর ওই দু:সাহসিক ও কৌতুকপ্রদ কাজের ফলেই রেডিওতে বাংলাভাষর বিকৃতি ঘটারোর প্রচেষ্টার অবসান ঘটে, সময়টার কথা সম্মরণ রাখতে হবে। তখন সবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং শামন কার্তাদের মধ্যে পাকিস্তান জোশ রীতিমত টগবগ করছে ।
এরপর রেডিওতে তিনি আর থাকেননি । বেরিয়ে এস তিনি বীমা কোম্পানীতে যোগ দেন । বীমা ক্ষেত্রে অমামান্য সাফল্য অর্জন করেন । সামাদ সাহেবের সময়ে আরো একজন অসাধারণ বাঙালী রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রের সংবাদ বিভাগে যোগ দিয়েছিলেন । তিনি হলেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,ডিনি তাঁর ‘লালসালু’ উপন্যারে শুরতেই বাইরে আধুনিকক কিন্তু ভেতরে মুসলমান,‘ কেবল নতুন খোলসপরা নব্যশিতি মুসলমান’ পাশি শিকারী এক সরকারী কর্মচারীর কথা উল্লেখ করেছেন । আমাদরে এই বান্ধব,মোহাম্মদ আজিজুস সামাদ,ভেতরে বাইর সমান বাঙালী ছিলেন,যেমন ছিলেন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ । এঁরা দু’জনের কেউই ঢাকা রেডিওর ওই ছোট জায়গাটিতে আবদ্ধ থাকেননি, বড় কর্মকর্তা চলে গেছেন । দু’জনের ভেতরকার মিলটা স্মরণীয় । পাকিস্তানওয়ালাদের সাধ্য ছিল না তাদরেকে গ্রাস করে এই স্বৈরাচারীদেরকে তাঁরা কেবল প্রত্যাখানই নয় উন্মোচিত করেও দিয়ে গেছেন নিজ নিজ ক্ষেত্রে ।
আমরা কয়েকজন সমমনা মানুষ মিলে একবার একটি দু:সাহসিক উদ্যোগ নিয়েছিলাম,একটি সাপ্তাহিক প্রত্রিকা প্রকাশের,নাম ছিল ‘সাপ্তাহিক সময়’। যথারীতি সামাদ সাহেবের সাহায্য পাওয়া গেছে । কিন্তু আমাদের ছিল পুঁজির অভাব যে জন্য পত্রিকাতিট দু’বছরের মতো টিকে থেকে বন্ধ হয়ে গেলো । আমাদের শুভানুধ্যায়ী অনেকেই এই ব্যর্থতার দু:খ পেয়েছিলেন । তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন বিদ্যোৎসাহী জনাব দেলোয়ার হোসেন,যিনি সামাদ সাহেবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু । পত্রিকাটির টিকিয়ে রাখা যায় কি না এই চেষ্টর ব্রতী হয়ে তিনি একদিন পত্রিকার সম্পাদক অধ্যাপক জাহেদা আহমদসহ আমাকে সামাদ সাহেবের অফিসে নিয়ে গিয়েছিলেন । সামাদ সাহেব যথাসাধ্য সাহায্য করবার প্রতিশ্রুতি দিলেন ।কিন্তু ইতিমধ্যেই রণে ভঙ্গ দিয়েছি,তাই ব্যাপারটা আর এগোয়নি। তবে সেই সাক্ষাৎকারের কথা মনে আছে।
কিছুদনি পরে ‘নতুন দিগন্ত’ নামে একটি ত্রৈমাসিক বের করবার সিদ্ধান্ত নিলে আমরা যারা উদ্যোক্তা তাঁদের তিনজন গিয়ে আবার সামাদ সাহেবের শরণাপন্ন হলাম, এবং তার সেই প্রসন্ন অভ্যর্থনা ও প্রতিশ্রুতি নিয়ে ফিরে এলাম । ত্রৈমাসিকটি অষ্টম বছর পার হয়ে নবম বর্ষে পদার্পণ করতে যাচ্ছে। এর পেছনেও সামাদ সাহেবের সমর্থন ও সহয়োগিতা কার্যকর ছিল এবং এমন একটা ব্যবস্থা করে রেখে গেছেন যাতে তাঁর অনুপস্থিতিতেও সমর্থন-সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে । কোনো দিক দিয়েই তিনি সাধারণ ছিলেন না ।
পেশাগত জীবনে তাঁর সাফল্য সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয়বহ্ । স্ত্রী ফওজিয়া সামাদের সঙ্গে তাঁর যে সহধর্মিতা তার খবরও আমরা জানি । যতবার দেখা হয়েছে তাঁর প্রসন্নতা দেখেছি । হাসতেন বড় মিষ্টি করে, প্রসন্নতার সঙ্গে তাতে এক ধরনের দুষ্টুমিও থাকতো । দুষ্টমি তো অবশ্যই ছিল,নইলে চারপাশের পশ্চাদপদতা ও আত্মস্বার্থসর্বস্বতার ভেতর তিনি অমন ভিন্নধর্মী হলেন কি করে ।
ওই প্রসন্নতা,ওই দুষ্টমি এবং দু’য়ের সংমিশ্রণ-এ খুবই বিরল। একেবারেই অপ্রস্তুত ছিলাম এবং বড়ই মর্মাহত হয়েছি তাঁর চলে যাবার খবর শুনে । বেদনাটা উষ্ণহৃদয় স্বজন হারানোর,কিন্তু আমি তাঁকে আজও দেখতে পাই, সবসময়েই পাবো,স্বজন হিসেবে ,যার হাসিটি কখনো ভুলবার নয় ।
লেখক:ইমেরিটাস প্রফেসর,ইংরেজি বিভাগ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ।
//এআর