সেবার মাধ্যমেই মানুষকে ভালোবেসেছি: ভ্যালেরি টেইলর
প্রকাশিত : ১৭:৪৮, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ১৯:১৮, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
ভ্যালেরি টেইলর। একজন মানবতাবাদী। বাংলাদেশে পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষের চিকিত্সায় পথিকৃত এক নাম। এদেশের দরিদ্র ও অবহেলিত মানুষের চিকিৎসা সেবায় কয়েক দশক ধরে অসামান্য অবদান রেখে চলেছেন। যাকে দ্বিতীয় মাদার তেরেসা হিসেবেও অনেকে সম্মান দেখান। যার জন্ম, শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ইংল্যান্ডের বাকিংহামশায়ারে। ইংল্যান্ডের সব ধরনের উন্নত নাগরিক সেবা পিছনে ফেলে তিনি বাংলাদেশে পড়ে আছেন, এদেশের মানুষকে ভালোবেসে।
ব্রিটিশ নাগরিক হয়েও বাংলাদেশে তিনিই প্রথম পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীদের সেবায় এগিয়ে আসেন। বিদেশি হয়েও তিনি গভীর ভালোবাসা, মানবতাবোধ ও স্বদেশি প্রেম নিয়ে এ দেশের মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছেন দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ থেকেই। সেবার ব্যাপ্তি বাড়াতে গিয়ে তিনি ঢাকার অদূরে সাভারে গড়ে তুলেছেন অত্যাধুনিক এক সেবাকেন্দ্র। যার নাম দিয়েছেন পক্ষাঘাতগ্রস্তদের জন্য চিকিত্সা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র ‘সিআরপি’ (Centre for the Rehabilitation of the Paralysed)। হাসপাতালটিতে সহযোগী ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে নিরলস চিকিত্সাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন ভ্যালেরি টেইলর।
দীর্ঘ ৪৭ বছর ধরে ক্লান্তিহীনভাবে তিনি বাংলাদেশের মানুষকে এ সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এটা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র মানুষের প্রতি তার ভালোবাসা থেকেই। আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে তার সঙ্গে খোলামেলা কথা হয় একুশে টেলিভিশন অনলাইনের। তিনি বলেন, আমি বাংলাদেশের মানুষকে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছি। আমি সেবার মাধ্যমেই তাদের মাঝে আমার ভালোবাসা বিলিয়েছি। আমি সিআরপিকে ভালোবেসেছি। তাকে জীবন সঙ্গী করে নিয়েছি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছে একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক রিজাউল করিম।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: বাংলাদেশের পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষকে দীর্ঘ সময় ধরে চিকিত্সাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। মানুষকে সেবা করার এ প্রেরণা কোথা থেকে পেলেন?
ভ্যালেরি টেইলর: আপনি হয়তো জানেন আমার জন্ম ১৯৪৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাজ্যের ব্রুসলিতে। আমি তরুণ বয়সেই ১৯৬৯ সালে ভলান্টারি সার্ভিস ওভারসিজ (ভিএসও) নামে একটি স্বেচ্চাসেবী সংগঠনে কাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলাম। মাত্র ১৫ মাসের জন্য আমি এখানে এসেছিলাম। তখন এখানে পক্ষাঘাতগ্রস্তদের নিয়ে কোনো ধরণের চিকিৎসা কেন্দ্র ছিল না। তখন বাংলাদেশে (পূর্ব পাকিস্তানে) চলছিল গণঅভ্যুত্থানের জোয়ার। পূর্ব পাকিস্তানে দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ যারা আইয়ূব খানের দমনে নির্যাতনে পিষ্ট, সেসব মানুষের সেবার জন্য এসেছিলাম।স্বেচ্চাসেবক দলের সঙ্গে ফিজিওথেরাপিস্ট হিসেবে চট্টগ্রামের চন্দ্রঘোনা হাসপাতালে যোগ দিয়েছিলাম তখন। এরপর যু্দ্ধ শুরু হলে আমি আমার সেবার ব্যাপ্তি ঘটাতে প্রয়োজনীয় অর্থের সন্ধ্যানে নিজ দেশ ইংল্যান্ডে চলে যাই। প্রায় ১০টি দাতা সংস্থার সঙ্গে কথা বলি। তাদের আশানুরূপ সাড়া পেয়ে আবার ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অর্থাৎ বিজয়ের তিন মাস আগে বাংলাদেশে আসি।
এরপর বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটি দেশে পঙ্গুত্ব ও শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত, অক্ষম রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকল।আমি তখন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে কাজ করি। এ সময়ের বিপুল সংখ্যক পঙ্গু রোগীকে দেখে আমার মনে তাদের জন্য মায়া তৈরি হলো। ভালোবাসা আরও বেড়ে গেল। আমি ভাবতে থাকলাম সঠিক চিকিৎসা ও সেবার মাধ্যমে এসব লোকগুলোকে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব। আর সেটাই হবে প্রকৃত ভালোবাসা ও মানবতাবাদের পরিচয়। মূলত এ ভাবনা থেকেই আমার পথচলা শুরু। আমার মানবতাবাদী ভাবনাই ছিল আমার প্রেরণা।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: পুনর্বাসনকেন্দ্র স্থাপনের জন্য প্রথম পর্যায়ে অর্থের সংস্থানটা কোথা থেকে এসেছিল?
ভ্যালেরি টেইলর: আমি পুনর্বাসনকেন্দ্র স্থাপনের ভাবনা থেকে ১৯৭৩ সালে ইংল্যান্ডে ফিরে যায়। সিআরপি স্থাপনে প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করে তহবিল প্রতিষ্ঠা করার কাজ শুরু করি। প্রায় ২ বছর ধরে আমার এ কাজ চলতে থাকে। এরপর ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে ফিরে আসি। আবারো কাজ শুরু করি শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। ওই সময় আমি অর্থ প্রাপ্তির বিষয়ে একটি দাতা সংস্থার কাছে আশ্বস্ত হয়েছিলাম।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: কবে থেকে সিআরপি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করলো?
ভ্যালেরি টেইলর: সর্বশেষ ১৯৭৯ সালের ১১ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী হাসাপাতালের একটি পরিত্যক্ত গোডাউনে মাত্র চারজন রোগী নিয়ে সিআরপির কাজ শুরু করি। এ সময় প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে মানুষকে বুঝিয়েছি ফিজিওথেরাপির কথা। এরপর একে একে ধানমন্ডি ও ফার্মগেটে ভাড়া বাসায় আমাদের চিকিৎসাহ কেন্দ্র হয়। কিন্তু সেখানেও আমরা স্থায়ী হতে পারিনি। বিভিন্ন চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সবশেষ ১৯৯০ সালে সাভারে ১৪ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠা করি সিআরপির প্রধান কার্যালয়।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: জীবনের ৭৪টি বছর পেরিয়ে গেছে। যার বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে বাংলাদেশের পক্ষাঘাতগ্রস্তদের সেবা ও ভালোবাসায়। বিনিময়ে কী পেলেন?
ভ্যালেরি টেইলর: জীবনের এ দীর্ঘ সময় সেবার মাধ্যমে মানুষকে ভালোবাসা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। কতটুকু পেরেছি তা ঠিক বলতে পারবো না। তবে এতটুকু বলতে পারি বাংলাদেশের মানুষ আমাকে ভালোবাসার বিনিময়ে শিখিয়েছে অতিথেয়তা। শিখিয়েছে আস্থা, বিশ্বাস ও অভিভাক হওয়ার ব্রত। আমি যেন বাংলাদেশের প্রক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীদের একজন অভিভাবক। তারা আমার মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাস খুঁজে পায়। এটিই আমার প্রাপ্তি, এতেই আমার আনন্দ। ইংল্যান্ডে থাকা বাংলাদেশি নাগরিকরা তার নিজ দেশের প্যারালাইজড রোগীদের সেবায় আমার কাছে অর্থ দিতে চায়। এটা আমার নি:স্বার্থ ভালোবাসারই প্রতিদান। আমি বাংলাদেশের মানুষজনকে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে অতিথি পরায়নতায় প্রথম সারিতে রাখবো।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: বাংলাদেশের মানুষ কী আপনার জীবনের শেষ পর্যন্ত এ সেবা ও ভালোবাসা পাবে?
ভ্যালেরি টেইলর: আমি জীবনের শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে থাকতে চাই। আর আমি বাংলাদেশে থাকলে এবং এ প্রতিষ্ঠানে থাকলে মানুষ আমার মৃত্যুর আগ শেষ পর্যন্ত এ সেবা পাবেন। তবে মাঝে মধ্যে সেবা ও কাজের প্রয়োজনে ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে যেতে পারি।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আপনার ব্যাক্তিগত জীবন সম্পর্কে যদি বলতেন?
ভ্যালেরি টেইলর: সত্যি কথা বলতে আমি বিয়ে করিনি। তবে আমার দুই পালিত কন্যা আছে। আমি তাদের একজনকে এ কেন্দ্রে চাকরি দিয়েছি। ওরা আমার খোঁজ খবর নেন। ভালোমন্দ দেখাশোনা করেন। আমি রান্না করতে পরি না, তাই বাসায় একজন কাজের মেয়েও আছে। রান্না-বান্নার কাজ সেই করে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: জীবনের এতটা সময় পেরিয়ে গেলেও বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হলেন না, কেন?
ভ্যালেরি টেইলর: কারণ আই লাভ সিআরপি। আমি সিআরপিকে ভালোবেসেই বিয়ে করে ফেলেছি। সিআরপিকেই জীবনের বড় সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছি।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। ভালোবাসা নিয়ে আপনার অনুভূতি কি?
ভ্যালেরি টেইলর: আসলে ভালোবাসার ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো দিবসে আমি বিশ্বাস করি না। ভালোবাসা চিরন্তন ও সার্বক্ষণিক। এই যে আমি মানুষকে সেবা দিচ্ছি। সার্বক্ষণিক সেবাই দিচ্ছি। কারণ এখানে সার্বক্ষণিক সেবা না দিলে রোগী সুস্থ্য হওয়া সম্ভব না। সার্বক্ষণিক সেবার মাধ্যমেই আমি বাংলাদেশের মানুষের মাঝে ভালোবাসা বিলাচ্ছি। মানুষকে ভালোবেসে ফেলেছি।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন : আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ভ্যালেরি টেইলর : একুশে পরিবারের প্রতি শুভ কামনা।
আরকে//
আরও পড়ুন