সেমাইয়ের আদ্যোপান্ত
প্রকাশিত : ১১:০৯, ৩ মে ২০২২ | আপডেট: ১২:২১, ৩ মে ২০২২
ঈদ হবে আর সেমাই হবেনা এ যেনো ভাবাই যায়না। দীর্ঘদিন ধরেই বাঙালীর রীতি, ঈদের সকালে সেমাই খাওয়া। ঘণ দুধ, এর সঙ্গে চিনি, বাদাম, এলাচ দিয়ে রান্না করা লাচ্ছা ও বাংলা সেমাই বাংলাদেশে ঈদ খাবারের আইকন। ঈদের দিন সকালে খাবার টেবিলে সুস্বাদু সেমাই পরিবেশন করা বাঙালির ঐতিহ্য। অতিথি আপ্যায়নেও এর জুড়ি মেলা ভার।
বাংলা অভিধানে ‘সেমাই’ শব্দকে কোথাও বলা হয়েছে হিন্দি, কোথাও দেশি। ভাষা পণ্ডিত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, গ্রিক শব্দ ‘সেমিদালিস’ থেকে সেমাই শব্দের উৎপত্তি।
সেমিদালিস অর্থ ময়দা। সেমিদালিস শব্দ সংস্কৃত ভাষায় ‘সমিদা’ রূপ ধারণ করে। সমিদা থেকে সেমাই, সেমিয়া, সেমাইয়া ইত্যাদি শব্দের উদ্ভব। সেমাইয়ের ইংরেজি নাম ‘ভারমিসেলি’। এটি ইতালীয় শব্দ ‘ভারমিয়েল্লি’র ইংরেজি রূপ।
লাচ্ছা সেমাইয়ের উৎপত্তি
ঈদের অন্যতম অনুষঙ্গ লাচ্ছা সেমাই। এর উৎপত্তি কোথায় এবং এই নাম কেন সেসব নিয়ে মতভেদ আছে। আরবি শব্দ ‘লম্বুতদার’ ঢাকার আদি বাসিন্দাদের মুখে উচ্চারিত হতো ‘লাচ্ছাদার’। দুটি শব্দেরই অর্থ সুস্বাদু। তাই ধারণা করা হয়, লাচ্ছাদার থেকেই লাচ্ছা নামটি এসেছে। জনশ্রুতি আছে, ঢাকায় আগত অবাঙালি কিংবা আদি ঢাকাইয়ারা প্রথম লাচ্ছা সেমাই তৈরি করে।
লম্বা বাংলা সেমাই
ঈদে লাচ্ছা সেমাই জনপ্রিয় হওয়ার আগে লম্বা সেমাই বেচাকেনা হতো বেশি। এর আরেক নাম ‘বাংলা সেমাই’। একসময় অতিথি আপ্যায়নে এর কদর ছিল বেশি। দাম কম হওয়ায় খোলা লম্বা সেমাই ছিল ঈদ খাবারের অন্যতম উপকরণ। তবে এখন লম্বা সেমাইয়ের চাহিদা তুনামূলক কম।
ঢাকায় একেকটি পাইকারি দোকানে প্রতিদিন ১০-২০ মণ সেমাই বিক্রি হয়। একেকটি টুকরিতে ৩৭ কেজি লম্বা সেমাই থাকে। এর মূল্য ১ হাজার ৮৫০ টাকা থেকে ১৯০০ টাকা। প্রতি টুকরিতে ২০ কেজি লাচ্ছা সেমাই থাকে। বর্তমানে এক টুকরি লাচ্ছা সেমাই ৩ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়া সুদৃশ্য বাক্সেও সেমাই বিক্রি হয়। পুরান ঢাকার চকবাজারের আলাউদ্দিন সুইটমিটে প্রতিদিন কারখানা থেকে পাঁচ থেকে আট মণ সেমাই আসে। ৫০০ গ্রাম লাচ্ছা সেমাই ১৪০ টাকা, ২০০ গ্রাম বাংলা সেমাই ৪০ টাকা। লাচ্ছা স্পেশাল ৫০০ গ্রাম ২৮০ টাকা এবং ১ কেজির দাম ৫০০ টাকা।
জাফরান, কাঠবাদাম, চেরি ফল, খেজুর, কিশমিশ দিয়ে বানানো আনন্দ বেকারির ভিআইপি লাচ্ছা সেমাই ৫০০ গ্রামের দাম ৮০০ টাকা।
ঢাকাসহ সারাদেশে প্যাকেটজাত লম্বা সেমাই এবং লাচ্ছা সেমাই পাওয়া যায়। বনফুল, অ্যারাবিয়ান, কুলসম, অলিম্পিয়া, বোম্বে, প্রাণ, কিষোয়ান, ওয়েল ফুড, ফুলকলি ব্র্যান্ডের লাচ্ছা সেমাই বেশি চোখে পড়ে। প্রতি কেজি খোলা বাংলা সেমাই ৬৫ থেকে ৭০ টাকা এবং খোলা লাচ্ছা সেমাই ১৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সেমাইয়ের ১৮০ থেকে ২০০ গ্রামের প্যাকেট পাওয়া যায় ৪০ থেকে ৪৫ টাকায়।
ঈদের আগে বাজারের চাহিদা পূরণে শহরের বিভিন্ন কারখানায় দিন-রাত উৎপাদন চলে সেমাইয়ের। সেমাই কারখানার আয়তন এবং অর্ডার অনুযায়ী উৎপাদন নির্ভর করে। প্রতিদিন গড়ে একেকটি কারখানায় ২০ মণ পর্যন্ত সেমাই তৈরি করা হয়। কাঁচামাল হিসেবে থাকে ময়দা, ডালডা।
যেভাবে তৈরি হয় সেমাই
এখন প্রায় সব কারখানায় যান্ত্রিক পদ্ধতিতে সেমাই তৈরি হয়। এরপর প্যাকেটে ভরে বাজারজাত করেন ব্যবসায়ীরা। প্রথমে সরু ফালি করে ময়দার মণ্ড কেটে রাখেন কারিগররা। সেগুলো গোলাকার করার পর লাচ্ছার খামির বানানো হয়। তেল ও ডালডা দিয়ে ভাজলে হয়ে যায় সেমাই। তারপর তেল ঝরাতে স্তূপ করে রাখা হয় কারখানায়। ঝরে পড়া গরম তেল আবারও চুলায় ঢেলে ভাজা হয়।
ঈদ উপলক্ষে উৎপাদনে ব্যস্ত হয়ে ওঠে কারখানা। রমজানের কিছুদিন আগে থেকে এই পেশায় যুক্ত হয় বিপুলসংখ্যক শ্রমিক। ঈদ ঘনিয়ে এলে তাদের ব্যস্ততা বাড়ে। প্রতিদিন ৮০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা পারিশ্রমিক মেলে। প্রতিষ্ঠান ভেদে কেউ কেউ বেতনভুক্ত হিসেবে কাজ নেয়। ঈদকে কেন্দ্র করে মাত্র দুই মাস ব্যস্ত থাকেন সেমাই কারখানার শ্রমিকরা। বছরের বাকি সময় বিস্কুট, চানাচুরসহ অন্যান্য কারখানায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন তারা।
তবে সেমাই উৎপাদনের অধিকাংশ কারখানার বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)-র অনুমোদন নেই। ঢাকায় অসাধু ব্যবসায়ীরা বেশি মুনাফার লোভে মানহীন সেমাই তৈরিতে ময়দায় মিশিয়ে দেয় রঙ ও বিষাক্ত রাসায়নিক। তাছাড়া যত্রতত্র গড়ে ওঠা সেমাই কারখানায় নিম্নমানের পাম অয়েল ও ডালডা ব্যবহারের অভিযোগ তো পুরোনো। ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযানের কারণে অসংখ্য কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।
সূত্র: ডয়েচে ভেলে
এসবি/