সোনালী আঁশে সোনালী দিনের আভাস
প্রকাশিত : ২০:৩৩, ১৯ জানুয়ারি ২০২৩ | আপডেট: ১৫:৫২, ২১ জানুয়ারি ২০২৩
১লা জানুয়ারী, ২০২৩ আন্তর্জাতিক বানিজ্য মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পাটখাতের উন্নয়নের জন্য পাট ও পাটজাত পণ্যকে ২০২৩ সনের ‘বর্ষপণ্য’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি যে পাটখাতের উন্নয়ন চান তারই ইঙ্গিত বহন করে এ ঘোষণা।
বাণিজ্য মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি বলেন “পাট এক সময়ের সোনালী আঁশ, আমাদের দেশে পাটের চাহিদা কিন্তু কোন দিন শেষ হবে না। পাটজাত পণ্য পরিবেশ বান্ধব, আমরা এ পাটের জন্ম আবিস্কার করতে পেরেছি। এখন থেকে আমরা অনেক ধরনের পাটপণ্য উৎপাদন করতে পারবো, পাটের সবটুকুই কাজে লাগে, পাতা থেকে শুরু করে, আঁশ থেকে শুরু করে, পাটখড়ি ও কাজে লাগে, কাজেই সেই পাটকেই আমাদের এখন গুরুত্ব দিতে হবে।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, “সরকারী পাটকল গুলোকে উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। যারা চাইবেন তারা পাটকল নিতে পারবেন, সেটা চালু করতে পারবেন এবং সেখানে যে জায়গা আছে সেখানে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদন করে বাজারজাত করতে পারবেন। সারা বিশ্বে পরিবেশ বান্ধব এ পাটপণ্যের এখন বিরাট চাহিদা সৃষ্টি হচ্ছে। সে সুযোগটা নিতে হবে”।
আশাকরি ভবিষ্যতে পাট ১ নং অর্থকরী ফসলে রুপ নিবে কারণ পাটজাত পণ্য ১০০% দেশীয় মূল্য সংযোজন করে।
তাছাড়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, গত ০৯/০১/২০২৩ তারিখে পাট ও পাটজাত দ্রব্যকে কৃষিজাত পণ্য হিসেবে গণ্য করার ঘোষণা প্রদান এবং একই সঙ্গে এ ঘোষণাকে দৃড়ভাবে বাস্তবায়ন করার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন। এ ঘোষণা ছিল বাংলাদেশ জুট মিলস এসোসিয়েশনের প্রাণের দাবী, তিনি তা পূরণ করেছেন। পাট ও পাটজাত দ্রব্য এখন থেকে কৃষিজাত পণ্য হিসেবে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা প্রাপ্ত হবে। তিনি পাটকে ভালোবেসে ২০১৬ সনের ৬ মার্চকে জাতীয় পাট দিবস ঘোষণা করে বাংলাদেশের পাটকে সারা পৃথিবীর কাছে নতুন করে পরিচয় করে দিয়েছিলেন। ১৯৭৫ এর কালো অধ্যায়ের পর পাটখাতের উন্নয়নের জন্য এত বড় ঘোষণা আর কেহ দেয়নি, তিনি কৃষকদের নিয়ে ভাবেন আর তাইতো কৃষকদের উন্নতির জন্য যার যতটুকু জমি আছে তা চাষ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। বাংলাদেশের কৃষকদের উন্নতি করা ছিল জাতির পিতার স্বপ্ন, সে স্বপ্ন বাস্তবায়নে তিনি অনেক ধাপ এগিয়ে এসেছেন, আজ বাংলার কৃষকের চোখে মুখে শান্তির রেখা ফুটে উঠেছে, তাদের মাঝে কোনো হাহাকার নেই, আছে প্রশান্তির ছায়া, কারণ বিগত কয়েক বছর ধরে কৃষকগন পাটের ন্যায্য মূল্য পেয়ে আসছেন।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেক্টারের সহায়তায় ২৮২টি পাটজাত পণ্যকে বহুমুখী পাটজাত পণ্য হিসেবে গত ৬ অক্টোবর ২০২০ তারিখে গেজেট প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। তাছাড়া পাট আইন- ২০১৭ ইং এর ৯ ধারায় বহুমুখী পাটজাত পণ্যের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, বহুমুখী পাটজাত পণ্য অর্থ প্রচলিত পাটজাত পণ্য যথা:- হেসিয়ান, সেকিং, সিবিসি এবং ছয় কাউন্ট ও তদূর্ধ্ব পাট সূতা ব্যতীত এইরুপ কোনো পণ্য যে পণ্য প্রস্তুতে পাট বা পাটজাত দ্রব্য ব্যবহারের আধিক্য নূন্যতম পঞ্চাশ ভাগ। সরকারের এরুপ নীতিগত ও আইনগত সহায়তার প্রেক্ষিতে নতুন নতুন উদ্যোক্তাগন বিশেষ করে মহিলা উদ্যোক্তাগন বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করণে এগিয়ে এসেছেন। গত বছর বাংলাদেশ থেকে বহুমুখী পাটপণ্য রপ্তানি হয়েছে ৭০০ (সাতশত) কোটি টাকা (সূত্র ইপিবি)। জেডিপিসি এর সূত্র মতে ২২- ২৩ অর্থ বছরে এ পর্যন্ত ৩৬৬ জন উদ্যোক্তা ১,৪০০ (এক হাজার চারশত) কোটি টাকার বহুমুখী পাটজাত পণ্য বাংলাদেশ থেকে বিদেশে রপ্তানি করেছেন বলে জানা যায়।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীন জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার টি ২০২২ সনে প্রতিষ্ঠিত একটি শায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের অধীনে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৮৬২। এ সকল প্রতিষ্ঠানে প্রায় ২০, ০০০ (বশি হাজার) কর্মী কাজ করে যার মধ্যে প্রায় ৬০% মহিলা। এ সংস্থাটি বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদনে উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও পণ্যের মানের উর্ধ্বগতির জন্য উদ্যোক্তাগনকে প্রশিক্ষন প্রদান করে থাকেন।
এ প্রতিষ্ঠান মাঝে মধ্যে বহুমুখী পাটপণ্যের দেশে ও বিদেশে মেলার আয়োজন করে, বহুমুখী পাটপণ্যের প্রসার ঘটানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানটিতে ১ টি ডিসপ্লে সেন্টার রয়েছে, সেখানে আগ্রহী ব্যক্তিগন তাদের পছন্দমতো পণ্য ক্রয় করতে পারে। আবার উদ্যোক্তাগন আগ্রহী হয়ে বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদনের জন্য নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান স্থাপন করছেন।
বিজেএমএ এর অধীনে বর্তমানে ২২৬ টি জুট মিল রয়েছে। আগামীতে এ সংখ্যা বৃদ্ধি পয়েে দ্বগিুণে উন্নীত হবে বলে আশা করছি।
সকল মিলে চিরাচরিত পাট পণ্য যেমন: স্যাকিং, হেসিয়ান, সিবিসি উৎপাদিত হয়। পরিবেশ বান্ধব এই পাট ও পাটশিল্পের সাথে প্রায় ৪/৫ কোটি লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। বাংলাদেশের ঐতিহ্য এ শিল্পকে রক্ষা করার জন্য Export Development Fund এর আদলে Jute Sector Development Fund গঠন করে পাটশিল্পে স্বল্পসুদে ঋন প্রদান করা হলে মিল মালিকগন চিরাচরিত পাটপন্যের সাথে সাথে মিলের খালি জায়গায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে, বহুমুখী পাটপন্য উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ হবে এবং বেশি মূল্যে দেশে ও বিদেশের বাজারে পাটপণ্য ও বহুমুখী পাটপণ্য বিক্রি/রপ্তানি বাড়াতে সচেষ্ট হবে।
উল্লেখ্য বহুমুখী পাটপণ্যরে কাঁচামাল হিসেবে যে ফাইন জুট ফেব্রিকস (এফজেএফ) ব্যবহৃত হয় তা কিন্তু বড় বড় জুট মিলেই বৃহৎ পরিমানে উৎপাদিত হয়ে থাকে। বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন আধুনিক যন্ত্রপাতি। ১ (এক) কেজি পাট ব্যবহার করে ১ (এক) টি বস্তা তৈরী করা হলে তা দেশে বা বিদেশের বাজারে বিক্রি হয় সর্বোচ্চ ১০০ (একশত) টাকা কিন্তু আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে ১ (এক) কেজি পাট দ্বারা বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদন করা গেলে তা বিদেশের বাজারে মূল্য হবে ২০০০/- (দুই হাজার) টাকার ও বেশি। এতে পাটজাত পণ্য থেকে রপ্তানি আয় কয়েকগুন বেড়ে যাবে ও ঐ পরিমানে বৈদেশিক মুদ্রার আয়ও বেড়ে যাবে। আর সেজন্য প্রয়োজন স্বল্প সুদে Jute Sector Development Fund (JSDF)।
ভারত সরকার তার দেশের পাটকলসমূহের পুরাতন মেশিনারীজ পরিবর্তন করে নতুন মেশিনারীজ স্থাপনের জন্য মেশিন মূল্যের ৩০% হারে মিল মালিকদের অনুদান প্রদান করে থাকে। বাংলাদেশের অধিকাংশ পাটকলের মেশিনারীজ ৫০/৬০ বছরের পুরাতন। এসব পুরাতন মেশিনারীজ পরিবর্তন করে নতুন মেশিন ক্রয় করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে পাটকল মালিকদের ৩০% হারে অনুদান প্রদান করা হলে পাটকল মালিকগন পুরাতন মেশিনারীজ বিক্রি করে যে অর্থ পাবে তার সাথে সরকারি অনুদান এবং নিজস্ব অর্থ যোগ করে নতুন মেশিনারীজ ক্রয় করে মিলে স্থাপন করতে পারবে। নতুন মেশিনারীজ স্থাপন করা হলে মিলের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে, উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পেয়ে পণ্যের একক মূল্য কমে যাবে। তাতে আন্তর্জাতিক বাজারে পাটপণ্য অন্যান্য দেশের পাট পণ্য ও বিকল্প পণ্যের সাথে প্রতিদ্বদ্ধীতায় টিকে থাকতে পারবে এবং অধিক পরিমান বৈদেশিক মূদ্রা আয় করতে সক্ষম হবে।
পাটের সোনালী রং যা সূর্যের আলোতে আলো ছড়ায়, তা যে কোন মানুষের মনকে আলোড়িত করে। উন্নত মানের পাটের সে সোনালী অংশ দ্বারা দামী শাড়ী, বাহারী পোষাক, ও সোনালী ব্যাগ তৈরী করা সম্ভব। আজকে আমরা চিরাচরিত পাটজাত পণ্য উৎপাদনে চিন্তা করি কতটুকু পাট দিয়ে তৈরী ব্যাগ কত টাকায় বিক্রি হবে, কত লাভ বা ক্ষতি হবে ইত্যাদি। কিন্তু আমরা যদি উন্নতমানের পাট দ্বারা উন্নতমানের কাপড়, শাড়ী, বাহারী পোষাক ও সোনালী পলিথিন ব্যাগ তৈরী করতে পারি এবং নতুন নতুন বহুমুখী পাটপণ্য তৈরী করতে পারি তবে অল্প কয়েক বছরের মধ্যে এ পাটখাত থেকে ৮/১০ বিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব হবে। তাছাড়া পাট দ্বারা পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন করা সম্ভব হলে তাও এদেশের অর্থনীতিতে স্বর্ণ দূয়ার খুলে দিবে। জাতিকে এ সুযোগ থকেে বঞ্চতি করা যাবে না ।
পাট কি আজ শুধু ব্যাগ তৈরী করে? পাট দ্বারা সয়েল সেভার তৈরী করে তা রাস্তা নির্মান ও নদী ভাংগন রোধে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাছাড়া পাট দ্বারা শপিং ব্যাগ, ল্যাডিস ব্যাগ, স্কুল ব্যাগ, পার্টি ব্যাগ, টেবিল ক্লথ, ঘরের পর্দা আরও অনেক কিছু তৈরী করা যায়। বহুমুখী পাটপণ্যের গুনগতমান বৃদ্ধিরজন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষণ। সরকার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদনের সাথে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্কাসদের দক্ষ করে তুলতে পারেন এবং উন্নত মানের বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। তাছাড়া এখাতে গবেষণার ও প্রয়োজন রয়েছে। ইদানিং লক্ষ্য করা গেছে যে, সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড করদাতাদের উৎসাহিত করার কাজে পাটের ব্যাগ প্রদান করে থাকে। এমনি করে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যদি এ ব্যাগ ব্যবহার করতে উৎসাহিত হয় তবে এ খাতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রসার ঘটবে। বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীগন তাদের টেবিলের সৌন্দর্য বর্ধনে যদি পাটের জিনিষ ব্যবহার করে তবে বহুমুখী পাট পণ্যের ব্যবহার কয়েকগুন বেড়ে যাবে। তাছাড়া বিদেশীরাও আমাদের পণ্যের ব্যবহার দেখে তারাও উৎসাহিত হবে এ ধরনের পরিবেশ বান্ধব পণ্য ব্যবহার করার জন্য।
সম্প্রতিকালে অর্থমন্ত্রণালয় এডিবি এর মাধ্যমে SEIP প্রকল্প দ্বারা পাটশিল্পখাতের শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে যার মাধ্যমে এ শিল্পের উৎপাদন কয়েকগুন বৃদ্ধি পাবে, তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় দেশের ১ (এক) কোটি ২০ (বিশ) লক্ষ ছাত্র / ছাত্রীদের মঝে জাতির পিতার ছবি ও জাতীয় স্মৃৃতি সৌধের ছবি সম্বলিত পাটের ব্যাগ প্রদানের উদ্যোগ গ্রহন করেছেন এবং এ জন্য পাটের ব্যাগের ১ (এক)টি Specification ও তারা অনুমোদন করেছেন। এ ভাবে দেশে বিদেশে বহুমুখী পাটপন্যের ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যে স্বপ্ন তা পূরণ হবে এবং এভাবে পাটের সোনালী আঁশ আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সোনালী দিন নিয়ে আসবে এবং দেশকে বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে পড়তে হবেনা। পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে ১০০% বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করা সম্ভব হবে। অন্য কোনো শিল্প দ্বারা ১০০% বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করা সম্ভব নয়।
লেখক: চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ পাটকল সমিতি (বিজেএমএ)।
এসি
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।