‘স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হব, কিন্তু আমার তো হাত-পা নেই’
প্রকাশিত : ১৪:৪৫, ৭ মে ২০১৯
অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর পরিশ্রম দিয়ে যে কোনো প্রতিবন্ধকতাকেই জয় করা যায় এমনটাই প্রমাণ করেছে শারীরিক প্রতিবন্ধী তামান্না আক্তার নূরা।
একটিমাত্র পা-ই তার সম্বল। দুই হাত আর এক পা না থাকা মেয়েটা শুধুমাত্র এক পায়ে লিখেই এবার এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে।
ছোটবেলা থেকেই ভালো চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করার স্বপ্ন থাকলেও এইবার নিজের মনের কাছেই বার বার হেরে যাচ্ছে মেয়েটি। “আমার তো হাত-পা নেই; তাই হয়তো ডাক্তার হতে পারব না” -এমন স্বপ্ন ভঙ্গের কথাই বলছে সে।
বাংলা বাদে প্রতিটি বিষয়ে এ প্লাস পেয়েছে তামান্না। গড় ফল জিপিএ-৫। সে ঝিকরগাছার বাঁকড়া জেকে মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। তামান্না ২০১৩ সালে প্রাথমিক সমাপনী (পিইসি) ও ২০১৬ সালে জেএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পায় সে।
আগামীর স্বপ্ন প্রসঙ্গে তামান্না জানায়, ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন মেডিকেল পড়ে বিসিএস’র মাধ্যমে ভালো চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করব। কিন্তু আমার তো হাত-পা নেই। ডাক্তারির পড়ায় অনেক প্র্যাকটিক্যাল আছে। কিন্তু এক পা দিয়ে কি এতো বড় কাজ সম্ভব? এ জন্য মনোবল কমে যাচ্ছে। তবুও আমি মেডিকেলে না পড়তে পারলেও ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা সম্পন্ন করে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি কর্মকর্তা হতে চাই।
নিজের হতাশার কথা উল্লেখ করে তামান্না বলেন, এসএসসিতে ভালো হলেও আমার স্বপ্নপূরণ করতে হলে এখন ভালো কলেজে ভর্তি হয়ে ভালোভাবে পড়াশোনা করতে হবে। কিন্তু নিজের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা এবং বাবার আর্থিক অনটনে তা সম্ভব হবে কিনা চিন্তা হয়। সবার কাছে দোয়া প্রার্থনা করে তামান্না বলে, আমার জন্য দোয়া করবেন যেন আমার স্বপ্নপূরণ হয়, যেন মানুষের সেবা করতে পারি।
তামান্নার বাবা রওশন আলী বলেন, জন্মের পর থেকে আর্থিক সমস্যার পাশাপাশি সামাজিকভাবে অনেক প্রতিকূলতার মোকাবেলা করতে হয়েছে। সৃষ্টিকর্তার উপর ভরসা করেই ওর মা তাকে একটি পায়ের উপর ভর করে সব শিক্ষা দিতে থাকে। তামান্না অক্ষর জ্ঞান তার মায়ের কাছ থেকেই শেখে। সে সময় বাড়ি থেকে দূরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করিয়ে এবং নিয়মিত স্কুলে পাঠানো আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না, ফলে স্থানীয় আজমাইন এডাস স্কুলে তাকে নার্সারিতে ভর্তি করানো হয়।
তিনি বলেন, তামান্না শ্রবণ ও মুখস্থ শক্তি এতো ভালোছিল যে একবার শুনলে তা আয়ত্ত্ব করতে পারতো। অক্ষর লেখা, পায়ের আঙুলের ফাঁকে চক ধরিয়ে লেখা, তারপর কলম ধরিয়ে লেখা আয়ত্ত্ব করে সে, বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টানো, পায়ের আঙুলের ফাঁকে চিরুনি, চামচ দিয়ে খাওয়া, চুল আঁচড়ানো সহজেই সে রপ্ত করে। এক পর্যায়ে নিজের ব্যবহৃত ঠেলাগাড়িটি এক পা দিয়ে চালানোও শেখে। আর তার দক্ষতা সবার নজরে আসে।
তামান্নার বিষয়ে ঝিকরগাছার বাঁকড়া জেকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, নূরা খুবই প্রতিভাবান। তার লেখা খুব স্পষ্ট ও চমৎকার। এবার এই প্রতিষ্ঠান থেকে মোট ১৬০ জন পরীক্ষায় অংশ নেয়। তার মধ্যে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পরীক্ষা দেয় ৪৭ জন যাদের মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১৪ জন। অকৃতকার্য হয়েছে একজন।
তিনি বলেন, এই ফলাফলে আমরা সবাই খুশি। নূরার প্রতি শিক্ষক ও তার সহপাঠীদের দারুণ সহযোগিতা ছিল।
তামান্নার গ্রামের বাড়ি ঝিকরগাছা উপজেলার বাঁকড়া ইউনিয়নের আলীপুর গ্রামে। বাবার নাম রওশন আলী। ময়ের নাম খাদিজা পারভীন শিল্পী। বাবা স্থানীয় ছোট পোদাউলিয়া দাখিল মাদ্রাসার (নন এমপিও) বিএসসির শিক্ষক। মা গৃহিণী, তিনি বাড়ির কাজ দেখাশোনা করেন। তিন সন্তানের মধ্যে সেই সবার বড়, মেজ মেয়ে মুমতাহিনা রশ্মি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে আর ছোট ছেলে মহিবুল্লাহ তাজের বয়স চার বছর।
২০০৩ সালের ১২ ডিসেম্বর নূরা জন্মগ্রহণ করে। জন্মের পরে এই দম্পতি মেয়েকে দেখে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। কিন্তু সে কারও বোঝা হোক- এটা তারা চাইতেন না। তাই ছয় বছর বয়সে অনেক চেষ্টা করে নূরাকে তার মা লেখা শেখিয়েছেন। প্রথমে পায়ের ভেতর কাঠি দিয়ে এবং পরে কলম দিয়ে লেখা শেখান। মাত্র দু’মাসেই মেয়ে পা দিয়ে লেখা ও ছবি আঁকা রপ্ত করে ফেলে। পরে নূরাকে ভর্তি করান বাঁকড়ার একটি স্কুলে। তাকে স্কুলে আনা নেওয়ার কাজটা করতেন তার বাবা-মা।
টিআই/
আরও পড়ুন