স্বর্ণ দুয়ার খুলে দিবে তাঁতশিল্প
প্রকাশিত : ১৯:৩৪, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | আপডেট: ২১:৩০, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
আবহমান বাংলার ঐতিহ্যে লালিত তাঁত শিল্পের রাজধানী সিরাজগঞ্জ। জন্মভূমির প্রতি আমাদের প্রত্যেকেরই দায়বদ্ধতা রয়েছে। এই দায়বদ্ধতার জায়গা থেকেই আমাদেরকে এইমর্মে কমিটেড হ'তে হবে যে, তাঁত শিল্পকে আমরা যথাযোগ্য মর্যাদায় বাঁচিয়ে রাখবো।
সরাসরি রঙিন সুতায় মেশিনে তৈরি কাপড়ের সাথে প্রতিযোগিতায় পাল্লা দিয়ে তাঁত শিল্পকে টিকে থাকতে হলে উৎপাদন থেকে বিপণন পর্যন্ত একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এই পরিকল্পনার প্রথম ধাপে তাঁতিদেরকে সুলভ মূল্যে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে রঙিন সুতা সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, উৎপাদিত তাঁতপণ্য বাজারজাত করার জন্য সিরাজগঞ্জে একটি আন্তর্জাতিক মানসম্মত বিপণন কেন্দ্র সৃষ্টি করতে হবে। তৃতীয়ত, তাঁত শিল্প এবং তাঁতপণ্যের দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক সমকালীন চাহিদা ও রুচি তৈরীর জন্য সিরাজগঞ্জে আন্তর্জাতিক মানের ফ্যাশন ডিজাইন ইন্সটিটিউট ও মার্কেট প্রমোশন সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের স্থায়ীভাবে ব্যবস্থা করতে হবে। সিরাজগঞ্জে স্থাপিত ইকোনমিক জোন এবং শিল্প পার্ক তাঁত শিল্প ও তাঁতপণ্যের উৎপাদন থেকে বিপণন পর্যন্ত এ জাতীয় সহযোগী কার্যক্রম অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুত আছে।
জীবন ও জীবিকার টানাটানিতে আমাদের দেশের অনেক ঐতিহ্যবাহী শিল্পের পথ ধরে তাঁত শিল্পও বিলুপ্তির দ্বার প্রান্তে এসে উপনীত হয়েছে। টেকসই, পাকা রং, আকর্ষণীয় কারুকাজ এবং সস্তা দামের জন্য পাবনা সিরাজগঞ্জের তাঁতের কাপড়ের কদর এক সময় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কিন্তু সময়ের প্রেক্ষাপটে কলের কাপড়ের সাথে পাল্লা দিয়ে প্রতিযোগিতায় এই তাত শিল্প এবং এর উপর নির্ভরশীল মালিক-শ্রমিকদের টিকে থাকা এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
তাঁতীদের জীবনই এখন হুমকির মুখে। প্রচলিত পদ্ধতিতে কড়াইয়ে রং জ্বাল দিয়ে সুতা রঙিন করে মাড় দিয়ে শুকিয়ে চরকায় কেটে ড্রামে সেট করার পর শুরু হয় কাপড় বোনার কাজ। তার আগের পুরোটাই প্রস্তুতি পর্ব। অথচ রেডি স্টক রঙিন সুতায় কাপড় তৈরীর জন্য একদিকে যেমন প্রচলিত পদ্ধতির প্রস্তুতিজনিত কালক্ষেপনের প্রয়োজন হয় না, অপরদিকে স্বল্প সময়ে মেশিনে প্রচুর পরিমাণে কাপড় প্রস্তুত করা যায়।
প্রচলিত কড়াই পদ্ধতিতে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর রং করা সুতার ক্যামিক্যালাইজড বর্জ্য পানি অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র ফেলে দেয়ার কারণে ফসল উৎপাদনসহ জীব বৈচিত্র্য দারুণভাবে বিপর্যস্ত হয়। আধুনিক পদ্ধতিতে কাপড় উৎপাদনের প্রতিযোগিতার সাথে তাঁত শিল্পকে টিকে থাকতে হলে প্রচলিত কড়াই পদ্ধতিতে সুতা রং করে সময় অপচয় ও পরিবেশ দূষণ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
একটি কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনার আওতায় ক্ষুদ্র ও বৃহৎ তাঁত মালিকদের মধ্যে রং করা সুতা সরবরাহ করা গেলে এই হাজার বছরের পুরনো ঐতিহাসিক তাঁত শিল্পকে তার স্বমহিমায় ধরে রাখা যাবে। (অর্থনৈতিক অঞ্চল কিংবা শিল্প পার্ক এ ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় ভাবে রাখা যেতে পারে) উন্নত দেশে ঐতিহ্যকে সুরক্ষা করে পর্যটনে রূপান্তরিত করে জাতিসত্বাকে উপস্থাপনের পাশাপাশি উপার্জনের ক্ষেত্রও তৈরি করা হয়। সিরাজগঞ্জের শতশত তাঁতপল্লীকেও পেট্রোনাইজ করলে এই শিল্প আবার উৎসবমুখর হবে। হবে আকর্ষণীয় পর্যটন স্থান।
জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, শাহজাদপুর, এনায়েতপুর, বেলকুচি, উল্লাপাড়া, সদর, কামারখন্দ, কাজীপুর থানা জুড়ে প্রায় ১৪ হাজার ৮৫০টি তাঁত কারখানায় ৪ লাখ ৫ হাজার ৬৭৯টি হস্ত ও ইঞ্জিনচালিত তাঁত রয়েছে। বর্তমানে ৪৬ হাজার ৪০৩টি তাঁতি পরিবার তা পরিচালনা করছে। জেলার মোট ৩২ লাখ ২০ হাজার ৮১৪ জন মানুষের মধ্যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ২০ লাখ ৮ হাজার ১৫৬ জন তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িত।
সিরাজগঞ্জে তাঁতশিল্প যেখানে সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে সেখানে লোডশেডিং বড় দুর্ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিনের বেশির ভাগ সময় বিদ্যুৎ না থাকায় আয় রোজগার অনেক কমে গেছে। তাই প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ। অন্যদিকে পাউন্ড প্রতি সুতার দাম বেড়েছে ৫০-৬০ টাকা, বিভিন্ন রঙের দাম কেজিতে বেড়েছে ২-৩ হাজার টাকা। এছাড়া তাঁতে ব্যবহৃত অন্যান্য পণ্যের দামও ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে এখানে ইতিমধ্যে ২০-২৫ ভাগ তাঁত কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আরো অনেক তাঁত বন্ধ হওয়ার পথে রয়েছে।
সমস্যা যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে সম্ভাবনা। তাঁত শিল্পের দিকে নজর দিলে বা এ শিল্পকে পৃষ্ঠপোষকতা দিলে তাহলে স্বর্ণ দুয়ার খুলে দিবে তাঁতশিল্প।
তাঁত শিল্পের উৎপাদিত পণ্য বিশ্বব্যাপী বিপণনের জন্য আমাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মালিকপক্ষদের উদ্যোগে অথবা তাঁত বোর্ড একটি ভালো মানের শোরুম করতে পারেন।
প্রাথমিক অবস্থায় অন্ততপক্ষে বছরে এক কোটি নারী/পুরুষদের কাছে এই শিল্পের উৎপাদিত পণ্য পৌঁছে দেয়া অথবা তাদের দৃষ্টিতে আনার একটি পরিকল্পনা করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র অথবা আমাদের এম্বাসিগুলো এর প্রচারণা চালাতে পারেন। ক্ষুদ্র শিল্পই আমাদের অর্থনীতির অন্যতম মূল চালিকা শক্তি।
এসি
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।