জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট
স্বল্পমূল্যে রোগ নির্ণয়ের সুযোগ থাকলেও ভিড় নেই
প্রকাশিত : ১৯:০০, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ | আপডেট: ১৬:৪৯, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮
লাল ফিতার দৌরাত্ম বা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা যাই বলি না কেন, সেটি যেন আষ্টেপিষ্টে বেঁধে ফেলেছে সরকারের স্বাস্থ্য খাতের অন্যতম প্রতিষ্ঠান জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট। দৃষ্টিনন্দন-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, অবকাঠামোগত ব্যাপক সংস্কার ও সরকার নির্ধারিত স্বল্পমূল্যে রোগীদের বিভিন্ন রোগ নির্ণয়ের সুযোগ থাকলেও রোগীদের তেমন উপস্থিতি নেই এ প্রতিষ্ঠানে। ইনস্টিটিউটের কম মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার বিষয়ে তেমন কোনো প্রচারনাও চোখে পড়ে না। এজন্য আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে দোষছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা।
সারাদিনে বিভিন্ন পরীক্ষা নিয়ে যেসব রোগী আসেন তাদের অনেককেই পরীক্ষা না করিয়ে ফেরত যেতে হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ বলছে পরীক্ষার জন্য যেসব ক্যামিকেল জাতীয় দ্রব্য (রিএজেন্ট) থাকা দরকার তা এই প্রতিষ্ঠানে নেই। অন্যদিকে উর্দ্বতন কর্তৃপক্ষ বলছেন রিএজেন্ট তাদের দেওয়া হচ্ছে ঠিকই তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। ফলে সাধারন রোগীরা একদিকে যেমন সরকারের দেওয়া সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অন্যদিকে বেসকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে গিয়ে পকেট কাটা যাচ্ছে সাধারণ রোগীদের।
সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রনালয়ধীন জাতীয় প্রতিষ্ঠান জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট। গত কয়েক বছরে প্রতিষ্ঠানটির অবকাঠামোগত ব্যাপক সংস্কারের পাশাপাশি দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ তৈরীতে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। চালু করা হয়েছে CAPD প্লান্ট, জেনেটিক্স ল্যাব, আধুনিক তথ্য সম্প্রচার কেন্দ্র।
এছাড়া নতুনভাবে সাজানো হয়েছে পিএইচএল ল্যাব, ব্যাকটেরিওলজিক্যাল ও ভাইরোলজিক্যাল ল্যাব। ২০১০ সালে সরকারী স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত মূল্য চালু করার নির্দেশ জারি হলে তার ধারবাহিকতায় জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে ২০১৫ সালের অক্টোবরে সরকার নির্ধারিত মূল্যে রোগ নির্ণয় সম্পর্কিত পরীক্ষাগুলো চালু হয়।
অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি সংযুক্ত করা হয় ল্যাবরেটরিগুলোতে। ক্লিনিক্যাল প্যাথলজি, হেমাটোলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, সেরোলজি, ইমিউনোলজি, মাইক্রোবায়োলজি, আলট্রাসোনোগ্রাফি বিভাগের ল্যাবরেটররীগুলোতে সরকার নির্ধারিত স্বল্পমূল্যে চালু হয় রোগ নির্ণয় সম্পর্কিত সব ধরনের পরীক্ষা।
কিন্তু এতো আয়োজনের পরেও কোথাও যেন প্রাণ নেই- এমন নিস্পৃহ ভঙ্গিমায় চলছে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম। রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে মল ( আরএমই) পরীক্ষায় নেওয়া হয় মাত্র ২০ টাকা। প্রস্রাব ( আরএমই) পরীক্ষার ক্ষেত্রেও নির্ধারিত ফি মাত্র ২০ টাকা। এছাড়া স্টুল ( ওবিটি) পরীক্ষার ফি ৫০ টাকা, সিমেন ৫০ টাকা, এমপি ২০ টাকা, বিটিসিটি ৩০ টাকা, প্লেটিলেট ৫০ টাকা নেওয়া হয়।
একই অনুপাতে ব্লাড সুগারের পরীক্ষার ফি ৬০ টাকা, ব্লাড ইউরিয়া ৫০ টাকা, ইউরিক এসিড ১০০ টাকা, এ্যালবুমিন ৭৫ টাকা, লিভার ফাংশন টেস্ট ২০০ টাকা। সেরোলজি বিভাগের টেস্টগুলোও তুলনামূলকভাবে অনেক স্বল্পমূল্যে করানো সম্ভব এখান থেকে।
প্রস্রাব ( প্রেগনেন্সী) পরীক্ষায় এখানে নেওয়া হয় মাত্র ৮০ টাকা। ব্লাডগ্রুপিং ও রেসাস ( ডি) ফ্যাক্টর ১০০ টাকা, ডেঙ্গু (আইসিটি) ৩০০ টাকা, ভিডাল টেস্ট ৮০ টাকা। একইভাবে এইচবিএসএজি ২২০ টাকা, এফটি-৪ ২৫০ টাকা, রোবেলা আইজিজি ৩০০ টাকা, রোবেলা আইজিএম ৩০০ টাকা, এইচআইভি আইসিটি ২০০ টাকা।
মাইক্রোবায়োলজী বিভাগে ইউরিন কালচার ফি ২০০ টাকা, ব্লাড কালচার ফি ২০০।
মোট ৭৯ ধরনের পরীক্ষা এখানে করানো সম্ভব। ইমিউনোলজি বিভাগে যে পরীক্ষার জন্য রোগী বেশী আসে সেটা হলো টিএসএইচ। এর ফি জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয় মাত্র ২০০ টাকা। পক্ষান্তরে রাজধানীর অন্য ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে ঘুরে দেখা গেছে এর ফি ৯০০ থেকে ১২০০ টাকা। আবার একই বিভাগে টি-৪, টেষ্টোষ্টেরন, সিএ১২৫ - এর সরকার নির্ধারিত ফি যথাক্রমে ২০০, ২৫০ ও ৩৫০ টাকা যা জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়। কিন্তু রাজধানীর অন্য ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে এই পরীক্ষার জন্য নেওয়া হচ্ছে ৯০০ টাকা।
প্রায় চারগুণ বা পাঁচগুণ কম মূল্যে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে রোগ নির্ণয় পরীক্ষার সুযোগ থাকলেও আশানুরূপ ভাবে রোগীর দেখা মিলছে না এখানে। এর জন্য রোগ নির্ণয়ের জন্য যে ক্যামিকেল থাকা দরকার তার অপর্যাপ্ততা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুক্র ও শনিবার এখানে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী সপ্তাহিক ছুটি। ৩০ আগস্ট এখানে ( মাইক্রোবায়োলজী বিভাগে) সারাদিনে রোগী ছিল মাত্র ২৭ জন। এর আগের দিন ২৯ আগস্ট ছিল ২৪ জন। তার আগের দিন অর্থাৎ ২৮ আগস্ট ছিল ৩৪ জন। ২২ আগস্ট সারাদিনে রোগী এসেছেন ৩৯ জন। এর আগে ৮ আগস্ট রোগী এসেছিল ৩৫ জন।
ইনস্টিটিউটের রেজিষ্ট্রার সূত্রে জানা গেছে, এ যাবতকালে মাইক্রোবায়োলজী বিভাগে সর্বোচ্চ রোগীর সংখ্যা ছিল ৪৭ জন। পর্যাপ্ত সুবিধার পরও রোগীর সংখ্যা এতো কম কেন এমন প্রশ্নের জবাবে ইনস্টিটিউটের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান প্রদীপ কুমার দে জানান, রোগী আসে ঠিকই কিন্তু পরীক্ষা না করিয়ে অনেককে ফেরত যেতে হয়। ফলে সরকার নির্ধারিত স্বল্পমূল্যের সেবা থেকে বঞ্চিত হতে হয় ভুক্তভোগীদের। কেন ফেরত পাঠানো হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে নিয়মিত ক্যামিকেল সরবরাহ করা হয় না। মূলত রিএজেন্ট- এর অভাবে সব ধরনের পরীক্ষা এখানে করা সম্ভব হয়ে উঠে না।
জানা গেছে, দেশে এখন সব ধরনের রিএজেন্ট সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়মিত থাকলেও সরকারের এ প্রতিষ্ঠানটিতে রিএজেন্ট খুব একটা আসছে না। এর জন্য আমলাতন্ত্রকে দায়ী করলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মকর্তা।
সরকার প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে যথেষ্ট আন্তরিক হলেও প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কোনো তহবিল নেই। ফলে কোনো প্রয়োজনীয় উপাদানে ঘাটতি দেখা দিলে তা কেনার জন্য টাকা চেয়ে আবেদন করতে হয় সংশ্লিষ্ট দফতরে। নানা টেবিল ঘুরে আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে বাজেট আসতে আসতে ব্যায় হয় প্রচুর সময়। রিএজেন্ট-এর ক্ষেত্রেও একই জটিলতা পোহাতে হয়।
তবে প্রয়োজনের তুলনায় এতো কম রিএজেন্ট সরবরাহ করা হয় যাতে মাসের অধিকাংশ সময়েই কোনো না কোনো বিভাগে বেশ কয়েক ধরনের রিএজেন্টের অভাব দেখা দেয়। এ বিষয়ে ডা. প্রদীপ কুমার দে বলেন, প্রতিটি পরীক্ষার জন্য আলাদা আলাদা রিএজেন্ট দরকার হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব তহবিল না থাকায় নিয়মিত রিএজেন্ট সরবরাহ নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
ডা. প্রদীপ কুমার দে আরও বলেন, আমাদেরকে ন্যূনতম একটা ফান্ডও যদি দেওয়া হয় তাহলেও রোগীদের এভাবে পরীক্ষা না করিয়ে ফেরত যেতে হবে না। তাদের সঠিক সেবা দেওয়াটা সম্ভব হতো।
এদিকে স্বল্পমূল্যে সরকারি এ প্রতিষ্ঠানে রোগ নির্ণয়ের এমন এমন সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অবহিত নন সাধারণ মানুষ। এজন্য বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে গিয়ে পকেট কাটা যাচ্ছে রোগীদের। প্রতিষ্ঠানটির সামনে দুটি বিলবোর্ড ছাড়া আর কোথাও কোনো প্রচার চোখে পড়ে নি। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বার বার কর্তৃপক্ষকে এ সব বিষয়ে তাগিদ দেওয়া হলেও এখনো কোনো সাড়া মেলেনি বলেই অভিযোগ করছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা।
আ আ/ এআর